মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশের আট বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গারা মাদক কারবার ছাড়াও বিভিন্ন অপরাধকাণ্ডে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা কিশোরদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে দিনে গড়ে ৫৪ হাজার ৮৮৪ পিস ইয়াবার চালান কক্সবাজারের সীমান্তপথে বাংলাদেশে ঢুকছে। ইয়াবা ছাড়াও ঢুকছে ক্রিস্টাল মেথ (আইস), হেরোইন, কোকেন, গাঁজা, আফিম, বিদেশি মদ, ফেনসিডিলসহ আরও নানান মাদক।
সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোজ রোজ রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটুক বা না ঘটুক, মাদকের চালান সমানে ঢুকছেই।
জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তরেখা ২৭১ কিলোমিটার। তার মধ্যে ৬৩ কিলোমিটার নাফ নদ ও বাকি ২০৮ কিলোমিটার পাহাড়ি স্থলপথ। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর মাদকদ্রব্য উদ্ধারের তালিকায় ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য বাড়ছেই।
পথঘাটের পরিচিতি ও ভাষাগত কারণে মায়ানমার থেকে মাদক পাচারের বাহক বা পাচারকারী হচ্ছে মূলত রোহিঙ্গারাই। মাদকের চালান এপারে পৌঁছার পরই শুরু হয় হাত বদলের পালা। মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান আসার চিত্র ফুটে উঠেছে বিজিবির সাম্প্রতিক তথ্যে। গত ১৩ আগস্ট বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়নে এক বছরে উদ্ধার করা মাদকদ্রব্য ধ্বংস করা হয়।
তার মধ্যে ছিল দুই কোটি ৩৩ হাজার ৯৪৯ পিস ইয়াবা, ১৪০ কেজি ক্রিস্টাল মেথ (আইস), ২৫.৯৯৮ কেজি হেরোইন, ৪.৪০৫ কেজি কোকেন, ৫২.৮ কেজি গাঁজা, চার কেজি আফিম, ৮০০ পিস টার্গেট ট্যাবলেট, ২২ হাজার ১৫৫ বোতল বিদেশি মদ। এ ছাড়াও ছিল ৬১ হাজার ৪৯১ ক্যান বিয়ার, ১৬৯ বোতল ফেনসিডিল, এক হাজার ৭৯৯ লিটার বাংলা মদ ও দুই বোতল হুইস্কি। এক বছরে উদ্ধার করা ইয়াবার হিসাব করে দেখা গেছে, দিনে গড়ে উদ্ধার করা হয়েছে ৫৪ হাজার ৮৮৭ পিস ইয়াবা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার সীমানায় মাদক পাচারে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা। বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের মাদকবিরোধী অভিযানে মাদকসহ ধরা পড়া পাচারকারি ও মাদক কারবারিদের ৮০ শতাংশই রোহিঙ্গা।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরসহ আশপাশের রোহিঙ্গা আস্তানাগুলোয় রয়েছে মাদক মজুদকেন্দ্র। এসব কেন্দ্র থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মাদকদ্রব্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা কেবল মিয়ানমার থেকে উখিয়া-টেকনাফের শিবিরে মাদক এনেই থামছে না, তারাই আবার দেশের নানা প্রান্তে চালান পৌঁছেও দেয়। এমনই একজন রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ইলিয়াছ। তিনি রোহিঙ্গা শিবির থেকে বের হয়ে ইয়াবার কারবারের লাভের টাকায় মহেশখালীতে গিয়ে ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে বাংলাদেশি নাগরিক বনে গেছেন। পরে ইয়াবা ব্যবসাকে আড়াল করার কৌশল হিসেবে কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী ইসলামপুরে ওয়ামী একাডেমির ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি পাহাড়তলীর হালিমাপাড়ায় ফার্মেসি ব্যবসাও রয়েছে তাঁর। ইয়াবা কারবারের টাকায় ইসলামপুরে জমি কিনে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মাদক কারবারিচক্রে রয়েছে শতাধিক রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা ইলিয়াছ সম্প্রতি আরেক সহযোগী রোহিঙ্গা রশিদ মাঝিসহ (৩৩ হাজার পিস ইয়াবাসহ) ফেনীতে র্যাবের হাতে ধরা পড়েন। এরপর ইলিয়াছের বহু অজানা তথ্য বের হয়। এলাকাবাসী জানায়, ওয়ামী একাডেমির পরিচালক হাবিবুল্লাহসহ এটির পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই রোহিঙ্গা। তাঁরা সবাই এখন পাহাড়তলীতে নিজেদের বাড়িঘর করে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। হাবিবুল্লাহ-ইলিয়াছ ও তাঁদের সঙ্গীরা দীর্ঘদিন ধরেই ইয়াবা কারবারে জড়িত। তাঁরা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দিয়েও ইয়াবা পাচার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ইসলামপুরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ইয়াবা কারবারে কোটিপতি বনেছেন বহু ব্যক্তি। তাঁদের একজন হামিদ উল্লাহ অল্প দিনেই কোটিপতি হয়েছেন। তিনি ইয়াবাসহ ধরা পড়ার পর জেল খেটে সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কক্সবাজার শহরের ইসলামপুর রোহিঙ্গা পল্লীতে ইলিয়াছ, আজিজ, হামিদুল্লাহ, হাবিবুল্লাহসহ আরো অনেক রোহিঙ্গা ইয়াবা কারবারিচক্রের সদস্য বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। পুলিশসহ স্থানীয় সূত্র জানায়, এসব ইয়াবা কারবারি রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগ রোহিঙ্গা শিবিরের বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে রাত যাপন করে। এ ছাড়া তারা বারবার বাসা বদল করে। তারা এটা করে থাকে গ্রেপ্তার এড়াতে।
অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্য : ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা ঢল নামার সময় কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বাসিন্দারা আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের নিজের পাতের ভাত ও নিজের বিছানা পেতে দিয়েছিলেন। রোহিঙ্গা শিবির স্থাপনের জন্য স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের জায়গা দিয়েছিল নিজেদের বাড়িঘরের আঙ্গিনায়ও। অথচ আজ ওই সময়ের আশ্রয়হীন রোহিঙ্গারাই স্থানীয় লোকদের ওপর হামলে পড়ছে। রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের অপহরণ করে আদায় করছে মুক্তিপণের অর্থ। রোহিঙ্গা শিবিরের সাধারণ রোহিঙ্গারাও এসব সন্ত্রাসী ও ডাকাতদলের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। টেকনাফ-উখিয়ার লোকসংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। আর উপজেলা দুটির ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরসহ আশপাশে রয়েছে তারও দ্বিগুণ- প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, স্থানীয়রা এখন সংখ্যালঘু হয়ে রোহিঙ্গাদের কাছেই অসহায় হয়ে পড়েছেন। রোহিঙ্গা শিবির ও সীমান্তের পাহাড়ে রয়েছে কমপক্ষে সাতটি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী। এ ছাড়াও রয়েছে টেকনাফের পাহাড়ে আরো প্রায় অর্ধশত ডাকাতদল। স্থানীয় সূত্র জানায়, এসব দলে নেতৃত্ব দিচ্ছে রোহিঙ্গারাই। রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক সাতটি সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে রয়েছে—আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন বা আরএসও, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন অর্গানাইজেশন বা এআরএসও, আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি বা এআরএ, ইসলামী মাহাজ, আরাকান রোহিঙ্গা লিবারেশন আর্মি ও কম্পানি গ্রুপ। এসব দলের ক্যাডাররাও মাদক কারবারে জড়িত। এসংক্রান্ত তথ্য রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে। এসব সংগঠন আধিপত্য বিস্তার, অস্ত্র ও মাদক বেচাকেনা, চাঁদাবাজি ও অপহরণের ঘটনায় পরস্পরের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।
রোহিঙ্গা শিবিরসংলগ্ন টেকনাফের পাহাড়ে রোহিঙ্গা ডাকাতরা স্থানীয়দের যোগসাজশে এলাকার লোকজনকে অপহরণ করে আদায় করছে মুক্তিপণ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্র ও শনিবার টেকনাফে সাত ব্যক্তি অপহৃত হন। তার মধ্যে গত শনিবার বিকেল পর্যন্ত পাঁচজন মুক্তিপণ দিয়ে অপহরণকারীদের কবল থেকে মুক্তি পান। তবে গতকাল পর্যন্ত অন্য দুজনের সন্ধান মেলেনি।
তিন শতাধিক খুন : কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দীন চৌধুরী জানিয়েছেন, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় ২৩১টি মামলা করা হয়েছে, যেখানে খুনের মামলা হয়েছে ১৫টি। এসব মামলার বিপরীতে হত্যার শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন। অনেক ক্ষেত্রে একটি ঘটনায় একাধিক খুনের ঘটনাও ঘটেছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে মাদকসংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১১০টি। একই সময় অপহরণসংক্রান্ত ১৬টি ও ধর্ষণসংক্রান্ত মামলা করা হয়েছে ১২টি।
তিনি জানান, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত তিন শতাধিক খুনের ঘটনায় ২৮৭টি মামলা করা হয়েছে।
এনডি