ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৪ জুলাই ২০২৫, ২৮ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

জুলাইগাথা

জীবিকার টানে ঢাকা গিয়ে প্রাণ যায় ভোলার ৪৮ জনের

ছোটন সাহা, ভোলা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৫৬, জুলাই ২৩, ২০২৫
জীবিকার টানে ঢাকা গিয়ে প্রাণ যায় ভোলার ৪৮ জনের

২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় জীবিকার তাগিদে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন ভোলার বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ৪৮ জন। তারা রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলনের মধ্যে শহীদ হন।

এক বছর পেরিয়ে গেছে সেই ট্র্যাজেডির— তবু স্বজন হারানোর শোক ভুলতে পারেনি শহীদ পরিবারের সদস্যরা। কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ ভাই, কেউবা সন্তান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবারই আজ নিদারুণ সংকটে। সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা। জীবিকার সন্ধানে শহরে যাওয়া সেই মানুষগুলোর আর কেউ ফেরেনি। তারা রয়ে গেছে শুধুই স্মৃতির বুকে।

নিহতদের মধ্যে একজন ভোলায়, বাকিরা সবাই ঢাকায় শহীদ হন। মৃত্যুর পর সকল শহীদের দাফন সম্পন্ন হয় নিজ নিজ পারিবারিক কবরস্থানে। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে শহীদ হন তারা। আজও প্রিয়জনদের ভুলতে পারেননি পরিবারগুলো।

জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা ২১ দিনের মধ্যে মাত্র তিন দিনেই প্রাণ হারান ৩৩ জন। এর মধ্যে ১৯ জুলাই শহীদ হন ১৩ জন, ৪ আগস্ট ১১ জন এবং ৫ আগস্ট শহীদ হন ৯ জন।

শহীদদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্র, দোকানের কর্মচারী, ট্রাক চালক-হেলপার, রাজমিস্ত্রি, গার্মেন্টসকর্মী, ফুটপাতের দোকানদার, সিএনজি চালক, মসজিদের ইমাম, রিকশা চালক ও শ্রমিক। তারা সকলেই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এক বছর পার হলেও থামেনি স্বজন হারানোর সেই কান্না।

শহীদদের মধ্যে ভোলা সদর উপজেলার ১২ জন, দৌলতখানে ৩ জন, তজুমদ্দিনে ১ জন, লালমোহনে ১১ জন, চরফ্যাশনে ১২ জন এবং বোরহানউদ্দিন উপজেলায় শহীদ হয়েছেন ৯ জন।

ভোলা সদর উপজেলার শহীদরা হলেন— ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মো. শামিম হাওলাদার (৩৮), স্কুল শিক্ষার্থী মিরাজ ফরাজী (১৮), রিকশাচালক মো. ইমন (২২), ফার্নিচার ব্যবসায়ী মো. দেলোয়ার (৩৬), মুদি দোকানদার মো. মহিউদ্দিন (২৬), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জুলফিকার আহমেদ শাকিল (২৩), সিকিউরিটি গার্ড আলাউদ্দিন মল্লিক (৫৭), শ্রমিক মো. রনি (২৩), ছাতা মেরামতকারী মো. জসিম উদ্দিন (৪৪), প্রাইভেটকার চালক মো. বাবুল (৪০), শ্রমিক জহিরুল ইসলাম শুভ এবং দোকান কর্মচারী মো. হাছান (১৮)।

দৌলতখান উপজেলার শহীদরা হলেন— ফুটপাতের দোকানদার মো. শাহজাহান (২৬), রাজমিস্ত্রি মো. রিয়াজ (২৬) এবং গাড়ি চালক মো. শহিন (২৪)।

বোরহানউদ্দিন উপজেলার শহীদরা হলেন— বিকাশকর্মী মো. নহিদুল ইসলাম (২১), ট্রাক শ্রমিক মো. সুজন (২২), রাজমিস্ত্রি মো. ইয়াছিন (২৩), রিকশাচালক মো. জামাল উদ্দিন (৩৫), কলেজ শিক্ষার্থী দীপ্ত দে (২২), গৃহকর্মী লিজা আক্তার (২৩), দোকান কর্মচারী মো. নয়ন (৩৪), গার্মেন্টসকর্মী মো. জাকির হোসেন (২৬) এবং গার্মেন্টসকর্মী মো. সোহেল রানা (২২)।

তজুমদ্দিন উপজেলার শহীদ হলেন— জুট ব্যবসায়ী মো. মনির হোসেন (৩৪)।

লালমোহন উপজেলার শহীদরা হলেন— হোটেল কর্মচারী মো. আরিফ (১৭), লন্ড্রি দোকানি মো. মোছলেহ উদ্দিন (৩৫), রিকশাচালক মো. আক্তার হোসেন (৩৫), মসজিদের ইমাম মুফতি শিহাবউদ্দিন (৩০), মিষ্টির দোকানের কর্মচারী মো. শকিল (২০), মাইক্রোচালক মো. হাবিবুল্লাহ (৪০), হোটেল কর্মচারী মো. সাইদুল (১৪), কোম্পানির সেলসম্যান মো. ওমর ফারুক (১৭), সিএনজি চালক মো. সবুজ (২১), ট্রাক হেলপার মো. আক্তার হোসেন (২৭) এবং সবজি বিক্রেতা মো. হাসান (৩০)।

চরফ্যাশন উপজেলার শহীদরা হলেন— ফুটপাতের দোকানি মো. সিয়াম (১৫), বেসরকারি চাকরিজীবী মো. রাকিব মোল্লা (২৫), কোম্পানির সেলসম্যান মো. সোহাগ (১৭), রাজমিস্ত্রি মো. বাহাদুর হোসেন মনির (১৮), গার্মেন্টস কর্মী মো. ফজলু (২৮), রাজমিস্ত্রি মো. ফজলে রাব্বি (২০), ইন্টারনেট কর্মী মো. হাসনাইন (২৫), কলেজ শিক্ষার্থী মো. মমিন (১৯), ট্রাক চালক মো. হোসেন (২৫), দোকান কর্মচারী মো. হাবিবুর রহমান (২৯), মুদি দোকানের কর্মচারী মো. ওমর ফারুক (১৬) এবং দর্জি মো. তারেক (১৮)।

দৌলতখানের শহীদ শাহজাহানের স্ত্রী ফাতেহা বলেন, তার স্বামী ঢাকায় পাপস বিক্রি করতেন। ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাদের ৭ মাস বয়সী একমাত্র সন্তান বাবার মুখ দেখতে পারেনি।

ভোলা সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের শহীদ রনির মা মাইনুর বেগম বলেন, রনি ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে টাইলস মিস্ত্রির কাজ করতো। ৫ আগস্ট সকাল ১০টায় ছেলের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়। তিনি ছেলেকে অনুরোধ করেছিলেন বাইরে না যেতে। বলেছিলেন, ‘একদিন ভাত না খাইলে মানুষ মরে না। ’ কিন্তু বিকেল ৪টার দিকে ঢাকা মেডিকেল থেকে ফোন আসে— রনি গুলি খেয়ে মারা গেছে।  

কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাইনুর বেগম। তিনি বলেন, পুতে বাড়িতে আসলে আপেল, মাল্টা, কমলাসহ বিভিন্ন ফলফ্রুট আনতো খাইতাম। টাকা আইনা আমার হাতে দিতো। এখন পুতে নাই খাইতেও পারি না। মাইনষের পুতে আনে আমি চাইয়া থাকি, আমার কি পেট ভরে? আমার পুতে মারা গেছে তারে তো আর ফিরে পামু না। এই জন্য বড় পেলাডাও কুমিল্লা কাজ করতো, তারেও এখন আর কাজ করতে দেই না। বাড়িতেই থাহে। তবে আমি বাইচা থাকতে আমার পুতের হত্যার বিচার চাই। যেই ডাকাইতে আমার পুতেরে মারছে তাদেরও মৃত্যু দেইখা যাইতে চাই।

বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের উত্তর বাটামারা গ্রামের শহীদ নহিদুল ইসলামের মা বিবি ফাতেমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার মেয়ের পর আল্লায় একটা ছেলে দিছিল, আমার সেই ছেলেটারে বুক থেকে ছিনাইয়া নিয়া গেল, আমার সন্তানকে কে গুলি কইরা হত্যা করছে। সংসারে যে একটা বাত্তি জ্বালাইবো সেই লোকও নাই। একটা ছেলে আছিল আল্লায় বুকের থেইকা ছিনাইয়া লইয়া গেছে। আমার সংসারের বাত্তি জ্বালানোর আর কেউ রইলো না। আমার পুতের (ছেলের) খুব মেধা ছিল পড়ার। নিজে চাকরি-বাকির করতো নিজে পড়াশোনাও করতো। বাপের সংসারে অভাব। নদী ভাঙছে কিছু নাই। চাকরি কইরা ভোলা কলেজে ভর্তি হইছে। আমি একটা ছেলে পাইয়া আল্লার কাছে বড় খুশি হইছিলাম। কিন্তু আল্লায় বুক থেকে ছিনাইয়া লইয়া গেল। এক বছর হইছে বাবার মুখটা দেখি না। এখনো মনে হয় ঢাকা থেকে বাড়িতে আইবো। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।

এভাবেই এখনো ভোলার শহীদ পরিবারগুলোয় চলছে কান্না-আহাজারি। কেউ কাঁদছে স্বামী হারিয়ে, কেউবা সন্তান হারিয়ে। এই কান্না যেন থামার নয়।

ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি শহীদ হয়েছেন ভোলার সন্তানরা। স্বজন হারানো পরিবারগুলোর ক্ষতি কখনোই পূরণ হবার নয়। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে শহীদ পরিবারগুলোর পাশে থাকার চেষ্টা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও যেকোনো প্রয়োজনে প্রশাসন তাদের পাশে থাকবে।

এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।