ঝিনাইদহ: কলকাতায় নৃশংসভাবে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা হিসাবে উঠে এসেছে আক্তারুজ্জামান শাহিন নামে এক মার্কিন নাগরিকের নাম। আলোচনায় এসেছে ঝিনাইদহের একটি গ্রামের মাঠের মাঝে ২৭ বিঘা জমিতে গড়া শাহিনের বিশাল বাংলো বাড়িটি।
এই বাংলোর ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। চারপাশে ঝোপঝাড় ও কাঁটাতারের বেড়াবেষ্টিত বাংলো ঘিরে এলাকাবাসীর কাছে রহস্যের শেষ নেই। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরলে সেই আলিশান বাংলোতে বন্ধুদের নিয়ে শাহিন কী করতেন - তা জানতে উদগ্রীব অনেকেই।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, এমপি আনারের ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার এই শাহিন। নির্জন এলাকার এই বাংলোতে শাহিন তার ব্যবসায়িক পার্টনার আনারসহ অন্যান্য বন্ধু এবং সহকর্মীদের নিয়ে মিটিং করতেন।
আক্তারুজ্জামান শাহিনের পরিচয় প্রসঙ্গে জানা গেছে, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের এলাঙ্গী গ্রামের আসাদুজ্জামান কাটু মিয়ার ছেলে আক্তারুজ্জামান শাহিন। কাটু মিয়ার ৫ সন্তানের মধ্যে শাহিন সবার ছোট। ছাত্রজীবনে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন তিনি। বর্তমানে থাকেন মার্কিন মুলুকে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক তিনি। এক সময়ের পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান টুটুল ডাক্তারের আপন চাচাতো ভাই শাহীন। টুটুল ডাক্তার বেশ কিছুদিন আগে ক্রসফায়ারে নিহত হন। শাহিনের ভাই কোটচাঁদপুর পৌর মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিম।
স্থানীয়রা জানায়, আমেরিকায় যাওয়ার কিছুদিন পর ব্যবসা শুরু করেন শাহিন। এরপর প্রায় ১১ বছর আগে এলাঙ্গী গ্রামের মাঠের মাঝে ২৭ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলেন বিশাল এই বাংলো। নির্জন এলাকায় মাঠের মাঝে বাড়ি হওয়ায় অনেক টাকা খরচ করে বাংলোতে বিদ্যুতের সংযোগ নিতে হয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা বিধায় বাংলোতে প্রবেশের কোনো উপায় নেই। কেবল দূর থেকেই দেখা মেলে।
জানা গেছে, বাংলোবাড়ির নিরাপত্তায় বসানো রয়েছে শতাধিক সিসি ক্যামেরা। ভেতর থেকে ২৪ ঘণ্টা মনিটর হয়। শাহিনের এই বাংলোতে আরো আছে সুইমিংপুল, ক্রিকেট, গলফ খেলার ব্যবস্থাও। শরীরচর্চার জন্য জিমের সব উপকরণও এনে সেট করা হয়েছে সে বাংলোতে।
স্থানীয়রা বলছেন, বাংলোবাড়ির আগে ওই স্থানে একটি ইটের ভাটা ছিল। ইটের ভাটা ভেঙে সেখানে তৈরি করা হয়ে একটি বিশাল এই বাংলো। আমেরিকা থেকে ফিরলে প্রায়ই এই বাংলোতে বন্ধুদের নিয়ে ওঠেন শাহিন। গাড়ির বহর নিয়ে সোজা প্রধান ফটক দিয়ে নিজের বাংলোতে ঢুকে পড়েন। অন্যান্য গাড়িতে থাকতেন ভিআইপি সব গেস্ট। বাংলোতে নিজস্ব বাবুর্চি রয়েছে শাহিনের। বেশ কয়েকদিন রান্না করে চলতো ভুরিভোজ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাঙ্গী গ্রামে পাকা রাস্তার সঙ্গে মাঠের মাঝখানে বিশাল একটি বাংলো। প্রবেশ করার মাত্র একটিই রাস্তা। প্রধান ফটকে তালা ঝোলানো। ভেতরে ঢোকা সম্ভব হয়নি। বাংলোটির একটি ছবি নেওয়ার জন্য ঘুরতে হয় অনেকখানি পথ।
স্থানীয়রা জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরলে প্রায় এসে এই বাংলোতে থাকতেন শাহিন। তবে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এই বাংলোয় আসেননি তিনি। এখন এখন আর কেউ থাকেন না এখানে। আর বাংলাদেশে ফিরলে ঢাকার গুলশানের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন শাহিন।
এলাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম ও লোকমান হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, দীর্ঘ ১০/১১ বছর আগে শাহিন এই বাংলোটি নির্মাণ করেছেন। বাড়িটির ভেতরে কী হয় তা বলতে পারেন না তারা। মাঝেমধ্যে দেখেন গাড়িতে করে লোকজন আসা যাওয়া করে। গাড়ির ভেতরে কারা থাকে তাও দেখা যায় না। রাতে অনেক সময় ঢাক-ঢোল, গান-বাজনার আওয়াজ শোনা যায়।
ওই গ্রামের লিয়াকত আলী জানান, এই বাংলোটি ২৭ বিঘা জমির ওপর নির্মিত। শাহিন প্রায়ই এই বাংলোতে এসে থাকেন। তার সঙ্গে লোকজনও থাকে। বাড়ির ভেতরে আছে গরু, ছাগলের ফার্ম। মাঠের মাঝে এই স্থানে আগে ছিল ইটের ভাটা। ভাটা তুলে দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলো করেছেন শাহিন।
শাহিনের আলিশান বাংলোবাড়ি দেখভাল করেন আব্দুর রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তি। তিনি বাড়িটির প্রধান ফটকের দারোয়ান।
তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি দিনের বেলায় প্রতিদিন ৩০০ টাকা বেতনে কাজ করি। ভেতরে বিদেশি ৩টা কুকুর আছে। তাদের খাওয়ানো ও দেখাশোনা করি। এর বাইরে আমি আর কিছু জানি না।
শাহিনের ভাই কোটচাঁদপুর পৌর মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিমের সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা হলে তিনি বলেন, শাহিন আমার ছোট ভাই। সে আমেরিকা থেকে মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসতো। আমার পৌর নির্বাচনের সময় এসে কিছুদিন ছিল। নির্বাচন শেষে আবার চলে যায়। সর্বশেষ গত রমজানের আগে একবার এসেছিল। এখানে এলে সে তার বাংলোতেই থাকে। চলে যাওয়ার আগে বাড়ি এসে সবার সঙ্গে একবার দেখা করে যায়।
এমপি আনারের সঙ্গে শাহিনের কতদিনের বন্ধুত্ব জানতে চাইলে সহিদুজ্জামান সেলিম বলেন, সে তো মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। লেখাপড়া চলাকালে তাদের বন্ধুত্ব ছিল না। এখন আমেরিকার নাগরিক। আমেরিকা চলে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সময় থেকে ১০ বছর আগে তাদের বন্ধুত্ব হয়েছে।
একটি সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে শাহিনের একটি বাড়ি রয়েছে। সেই বাড়ির ঠিকানা ৩৭৯ ইস্ট সেভেন্থ স্ট্রিট ব্রুকলিন। বছরের ছয় মাস নিউইয়র্কে আর ছয় মাস বাংলাদেশে ভাগাভাগি করে থাকেন শাহিন। তিনি একজন স্বর্ণ চোরাচালানকারী বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৩ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০২৪
এসএএইচ