ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আইন ও আদালত

তালাক ও খোরপোষ

মানবাধিকার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৪
তালাক ও খোরপোষ

মুসলিম পারিবারিক আইন অুনযায়ী বিয়ের মাধ্যমে স্থাপিত সম্পর্ককে আইনগত উপায়ে ভেঙ্গে দেয়াকে তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ বলে। আইনের দৃষ্টিতে বিয়ে একটি চুক্তি।

এর রয়েছে ধর্মীয় ও সামাজিক ভিত্তি। আইন অনুযায়ী একটি বিয়ের যে কোনো  পক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে। যাকে আমরা বিবাহ বিচ্ছেদ বলি।

বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী সবারই সমান অধিকার রয়েছে। যদিও আমাদের একটি প্রচলিত ধারনা আছে যে কেবল স্বামীরাই তালাক দিতে পারে।

যেকোনো সময় স্বামী চাইলেই তালাক দিতে পারে এমন ধারনাই প্রচলিত। দাম্পত্য সম্পর্ক টিকে থাকে স্বামীর মেজাজ-মর্জির ওপর। স্বামী যে ক’দিন চাইবে সে ক’দিন স্ত্রী ঘর-সংসার করবে। স্বামীর মন চাইলেই আউট।   এই ধারণা সমাজে প্রচলিত থাকলেও তা আইন ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে বেআইনী।

আইনে যদিও তালাকের ক্ষেত্রে স্বামীর অধিকার বেশি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে স্ত্রীদের তালাক দেয়ার কোনো অধিকার নেই। স্ত্রী বা স্বামীকে কিছু আইনগত শর্ত পালন করতে হয়। এ শর্তগুলো পালন করলেই তালাকের প্রশ্ন আসে। স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়া অধিকার প্রদান করতে পারে। একে আইনের ভাষায় তালাক-ই-তৌফিজ বলা হয়। অর্থাৎ স্ত্রীও তার স্বামীকে তালাক প্রদান করতে পারে।

যেসব কারণে স্বামীকে স্ত্রী তালাক দিতে পারে তা ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে কলা আছে। যদি চার বছর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকে, বা দুই বছর স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হয়, অথবা স্বামীর সাত বৎসর কিংবা তার চেয়েও বেশী কারাদণ্ড হয় তাহলে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারে।

এছাড় স্বামী কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই নির্দিষ্ট সময় যাবত (তিন বছর) দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে অথবা বিয়ের সময় পুরষত্বহীন থাকলেও স্ত্রী তালাক দিতে পারে।

ওই আইনে স্বামী যদি দুই বছর পাগল থাকে অথবা কোনো গুরুতর ব্যধিতে আক্রান্ত থাকে সেক্ষেত্রেও স্ত্রী তালাক দিতে পারে। স্বামীর ধারাবাহিক নিষ্ঠুরতার কারণেও স্ত্রী তালাক চাইতে পারে।

এছাড়া স্বামী বা স্ত্রী যখন দুইজনই তালাকের ব্যাপারে সম্মত হয় তখন একে  খুলা তালাক বলে। এছাড়া আদালতের মাধ্যমেও তালাক কার্যকর হতে পারে।  
আমাদের দেশে যতো তালাক হয় তার অধিকাংশই অন্যায়ভাবে ও আইন না মেনে সংঘটিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদের ওপর দোষ চাপিয়ে তালাক নামক অস্ত্রটি প্রয়োগ করা হয়। যার পুরো সামাজিক, পারিবারিক ও ধমীর্য় দায় বহন করতে হয় একজন নারীকে।

স্ত্রীকে ভরণপোষণ দেয়া একজন স্বামীর আইনগত দায়িত্ব। কিন্তু তালাক হয়ে গেলে স্ত্রীর ভরণপোষণ দেয়া স্বামীর ওপর বর্তায় না। প্রায় সব মুসিলম রাষ্ট্রগুলোতে এটাই প্রচলিত আইন ও রীতি। তালাকের পর নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। কিন্তু সে সময় পার হলে স্ত্রীকে ভরণ পোষণ দেয়া স্বামীর দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা।

কিন্তু ১‌৯৮৫ সালে  ভারতের একটি মামলার (মো: আহমেদ খান বনাম শাহ বানু বেগম) রায়ে বলা হয়, একদজন নারী পুন:বিবাহ না করা পর্যন্ত ভরণপোষণের অধিকার পাবে। এটি মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একই মতামত আমরা দেখি বাংলাদেশের একটি মামলায় (মো: হেফজুর বহমান বনান সামছুন নাহার বেগম) যেখানে একজন নারী তালাকপ্রাপ্তা হিসেবে যতদিন পরিচিত থাকবেন (অর্থাৎ আবার বিয়ে না করবেন) ততোদিন পর্যন্ত ভরণপোষণ পাবেন। পরবর্তীতে (১৯৯৮ সালে) হাইকোটের এ আদেশটি আপিল বিভাগ খারিজ করে দেয়। পবিত্র কুরআনের সুরা বাক্বারার ২৪১ নং আয়াতের যে ব্যাখ্যা হাইকোট দিয়েছে তা গ্রহণ করেনি আপিল বিভাগ। তবে, অন্য কয়েকটি দেশে অন্যায়ভাবে স্ত্রীকে তালাক দিলে সেক্ষেত্রে অনির্দিষ্ট বা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভরণপোষণ দেয়ার বিধান আছে।
অন্যায় ও বেআইনীভাবে কোনো নারীকে যদি তালাক দেয়া হয় সে ক্ষেত্রে ইদ্দত সময়ের বাইরেও ওই নারী যতদিন পুন:বিবাহ না করেন ততদিন ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। পাকিন্তান, মালয়েশিয়ায় এরকম বিধান আছে।   পাকিস্তানের ২০০৯ সালের  সংশোধিত পারিবারিক আইন ও মালয়েশিয়ার ১৯৮৪ সালের আইনে এই বিধান আছে। এছাড়া ইরাক, মিশর, জর্ডান, তুরস্কেও এ বিধান আছে। তবে সব দেশে যে বিধানটি একই রকম তা নয়। এ জাতীয় ভরণপোষণ দিতে হয় দুই বছর পর্যন্ত আবার কোথাও বাসস্থানের ব্যবস্থাও করে দিতে হয়।  

আমাদের এখানে বিবাহ ও তালাক সম্পর্কিত আইন হচ্ছে মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১। এ আইনের ৭ ধারায় তালাক সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে।

এখানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে, তিনি যে কোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্র সম্ভব চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ দিবেন এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিশের একটি কপি প্রদান করবেন।   কোনো ব্যক্তি যদি নোটিশ না দেয় তাহলে তিনি এক বত্সর বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

কোনো তালাক যদি প্রত্যাহার করা না হয়, তাহলে চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ প্রদানের তারিখের নব্বই দিন পর তা কার্যকর হবে।

তবে, তার আগে নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে একটি সালিশী পরিষদ গঠন করবেন এবং উক্ত সালিসী পরিষদ এই জাতীয় পুনর্মিলনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বিষয়টি যদি সমাধানযোগ্য হয়, তবে তার সমাধান করতে হবে। এটিই মূলত চেয়ারম্যান বা কমিটির কাজ। চেয়ারম্যানকে নোটিশ প্রদানের কারণ এটাই।

একই আইনের ৯ ধারায় আছে, কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে পর্যাপ্ত ভরণ-পোষণ বা খোরপোষ দানে ব্যর্থ হলে বা একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে তাদেরকে সমান খোরপোষ না দিলে, স্ত্রী বা স্ত্রীরা চেয়ারম্যানের কাছে দরখাস্ত করতে পারেন। এক্ষেত্রে চেয়ারম্যান বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য সালিশী পরিষদ গঠন করবেন এবং ঐ পরিষদ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ প্রদানের জন্য টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে সার্টিফিকেট জারী  করবেন। স্বামী যদি ভরণপোষণের কোনো টাকা যথাসময়ে বা সময়মত পরিশোধ না করে তাহলে তা বকেয়া ভূমি রাজস্ব হিসাবে তার কাছ থেকে আদায় করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫, নভেম্বর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।