ঢাকা: আইন-আদালত ও রাজনৈতিক অঙ্গনে কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচিত হয়ে আসছিলেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। এবার এ আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার পিএইচডি ডিগ্রি ‘সম্পন্ন’ করেননি।
রোববার (৪ মে) সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এমন অভিযোগের কথা জানিয়েছেন তার ভাই শাহনেওয়াজ আহমেদ শিশিরের আইনজীবী এ এস এম সাজ্জাদ হায়দার।
তুরিন আফরোজদের রাজধানীর উত্তরার বাড়ি নিয়ে ভাই বোনের মধ্যে বর্তমানে আপিল বিভাগে মামলা বিচারাধীন। সোমবার (৫ মে) এ মামলা শুনানির জন্য দিন ঠিক করা হয়েছে।
পিএইচডির বিষয়ে আইনজীবী সাজ্জাদ হায়দার বলেন, অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসরের অধীনে তিনি (তুরিন আফরোজ) পিএইচডি করেছেন বলে আমরা জানি। উনি (অধ্যাপক) একটা ইমেইলের মাধ্যমে জানিয়েছেন এটা ইনকমপ্লিট। উনি এটা শেষ করতে পারেননি। ওনার (তুরিন) অন্য কোনো ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করা আছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে এটা ইনকমপ্লিট।
আইনজীবী আরও বলেন, ‘আর মায়ের ব্যাপারে ওনারা (তুরিন আফরোজের পক্ষ) বলছেন এটা আপন মা নয়। এ জন্য আমরা অ্যাডিশনাল পেপারবুকের মাধ্যমে আদালতের কাছে পেশ করেছি জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারিশ সনদ এবং বাবার বিবাহের সার্টিফিকেট। ’
তুরিন আফরোজের জন্ম ১৯৭১ সালে। তার গ্রামের বাড়ি নীলফামারী জেলার জলঢাকা থানার চাওরাডাঙ্গি গ্রামে।
তিনি ঢাকার হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন সিডনিতে বিভিন্ন সময়ে অধ্যয়ন করেন। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া থেকে পিএইচডিও করেছেন বলে জানা যায়।
পরবর্তীতে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তুরিন আফরোজ।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সমালোচনার মুখে তুরিন আফরোজ
ট্রাইব্যুনালে থাকার সময় ব্যাপক আলোচনায় থাকা তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর’ অসদাচরণের অভিযোগ ওঠে। তিনি এক আসামির সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তুরিন আফরোজ। এ মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর তুরিন আফরোজ ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়াহিদুল হককে ফোন কল করে কথা বলেন। পরে পরিচয় গোপন করে ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখা করেন।
ওই অভিযোগ ওঠার পর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ওয়াহিদুল ও তুরিন আফরোজের কথোপকথনের রেকর্ড ও বৈঠকের অডিও রেকর্ডসহ যাবতীয় ‘তথ্য-প্রমাণ’ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ২০১৮ সালের ৯ মে তাকে ট্রাইব্যুনালের সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর শৃঙ্খলা ও পেশাগত আচরণ ভঙ্গ এবং গুরুতর অসদাচরণের দায়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদ থেকে তাকে অপসারণ করে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে এক ফেসবুক পোস্টে ওই গোপন বৈঠকের কথা তিনি অস্বীকার করেননি।
বাড়ি নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে মাকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের ২০ জুন তার মা এবং ভাই সংবাদ সম্মেলন করেন। সেই সংবাদ সম্মেলনে তার মা শামসুন নাহার বলেছিলেন, ‘আজ দুই বছর তিন মাস ১৯ দিন আমি আমার বাসার বাইরে। আমার স্বামী মারা যাওয়ার ১৮ দিন পরে তুরিন আমাকে বাসা থেকে বের করে দেন। আমার দোষ তার (তুরিন আফরোজ) কিছু অনৈতিক আচরণের প্রতিবাদ করা। যেমন- আমাদের ভাড়াটিয়াদের থেকে সবসময় ভাড়ার টাকা আমিই নিতাম। আমার স্বামী অবসরে যাওয়ার পর থেকেই বাড়ি ভাড়ার টাকায় আমাদের সংসার, ওষুধ খরচ চলতো। এরপর ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি বাসা ভাড়ার টাকা জোর করে নিয়ে নেন। অপরিচিত লোকদের রাত-বিরাত ঘরে প্রবেশ নিয়ে দারোয়ান ও ভাড়াটিয়ারা অভিযোগ করলে তার সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া লাগতো। এসব বিষয়ে নিষেধ করলে ডিজিএফআই, র্যাব, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামে ভয় দেখাতো এবং বলতো ওরা সবাই তার বন্ধু। কোনো কিছু বললেই ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তারের ভয় দেখাতেন। আমি তো ধারা বুঝি না। আরও বলতো, পৃথিবীর যেখানেই থাকো সেখান থেকেই ধরে নিয়ে আসবো। ’
‘গানম্যান দিয়ে ভয় দেখাতো তুরিন। গ্রামের বাড়ি নীলফামারী যেতে পারি না, তিনি সেখানে দায়িত্ব নিয়ে জমি জমা ও বাড়ি নিজের নামে কুক্ষিগত করেছেন। প্রতিবাদ করলে প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম করেও হুমকি দেন’ বলে তখন অভিযোগ করেছিলেন শামসুন নাহার।
এখানে থেমে থাকেননি তুরিন আফরোজ। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ১১ মে ১১৬ জন আলেমের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দেওয়া হয়। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে মৌলবাদী ও সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশনেও ছিলেন তুরিন আফরোজ।
সেদিন গণকমিশনের সদস্যসচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এক হাজার মাদরাসার তথ্য-উপাত্তের ওপর তদন্ত করে এ একশ’ ধর্ম ব্যবসায়ীর তালিকা করা হয়েছে। তারা মানিলন্ডারিংসহ অন্যান্য অপরাধ করেছেন। তাদের অর্থনৈতিক জবাবদিহির আওতায় আনা হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। ’
এ ঘটনার পর এক হাজার কওমি মাদরাসা ও ১১৬ আলেম-ওলামার নামে গণকমিশনের শ্বেতপত্রকে ‘এক ধরনের মিডিয়াবাজি’ বলে আখ্যায়িত করেছে জাতীয় ওলামা–মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ। একই সঙ্গে এ তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। ২০২২ সালের ১৬ মে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করা হয়েছিল। গণকমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সদস্যসচিব তুরিন আফরোজ ‘বিতর্কিত ব্যক্তি’ বলেও মন্তব্য করেন সংগঠনটির সভাপতি নুরুল হুদা ফয়েজী।
ইএস/আরআইএস