বিয়ে এবং ডিভোর্স শব্দ দুটি পাশাপাশি শুনে অভ্যস্ত হলেও একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। একেবারেই বিপরীতমুখি শব্দ।
নানাবিধ কারণে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিয়ে বিচ্ছেদের সংখ্যা যেন বেড়ে চলেছে। আর এটা এক পক্ষ থেকে হচ্ছে না। বিয়ে বিচ্ছেদে স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে পাঠাচ্ছেন তালাক নোটিশ। আবার অনেক ক্ষেত্রে দুই পক্ষের সমঝোতায়ই হচ্ছে খোলা তালাক। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অমনোযোগ, স্বামীর হাতে স্ত্রী নির্যাতন, শ্বশুর-শাশুড়ির হাতে পুত্রবধূ নির্যাতন, পরকীয়ায় আসক্তি, স্বামীর মাদকাসক্তি, স্বামী দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা এবং স্ত্রীর ভরণপোষণের অনীহাই এসব বিয়ে বিচ্ছেদের মূল কারণ। এ ছাড়া সামাজিক অস্থিরতা, মাদকাসক্তির প্রভাব, পরস্পরকে ছাড় না দেওয়ার মনোভাবও বিয়ে বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ।
শিক্ষা ও সচেতনতার হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কি মানুষের সম্পর্কের বন্ধনগুলো যেভাবে হালকা হয়ে যাচ্ছে- তাতে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। অথচ এমন পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
মানুষকে দুনিয়ায় দেওয়া আল্লাহর অন্যতম নিয়ামত হলো ঘর-সংসার। যাকে একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল বলা চলে। যে নিকেতনের ছায়াতলে মানবগোষ্ঠী ভালোবাসা ও অনুকম্পা, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা এবং মহৎ জীবন ও শালীনতা লাভ করে।
এই আশ্রয়ে শিশু-কিশোর ও তরুণরা বড় হয়, আত্মীয়তার সম্পর্ক বিস্তৃত হয়- ফলে পারস্পরিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এ সংসারে নারী-পুরুষ একজনের অন্তরের সঙ্গে অন্যের অন্তর যুক্ত হয়। পবিত্র কোরআনে কারিমের ভাষায়- ‘তারা তোমাদের পোষাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোষাকস্বরূপ। ’ -সূরা বাকারা : ১৮৭
পোষাক যেমন শরীরকে আগলে রাখে, তেমনি সংসারকেও নারী-পুরুষ উভয়েই আগলে রাখে সব ধরনের বিপদাপদ ও সমস্যা থেকে। এই হলো একটি সুখি সংসারের চিত্র। তবে এর উল্টোটাও দেখা যায়।
মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিতে কখনও কখনও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়- যেখানে কোনো ভালোবাসা ও প্রশান্তি সুদৃঢ় হয় না; ফলে ক্ষেত্রবিশেষ দাম্পত্য সম্পর্ক অটুট রাখা কষ্টকর হয়ে যায়। এমন বিশৃংখল অবস্থার কারণ কখনও কখনও হয়ে থাকে আভ্যন্তরীণ আবার কখনও বহিরাগত।
স্বামী-স্ত্রীর অভিভাবক অথবা তাদের আত্মীয়-স্বজনের অযাচিত হস্তক্ষেপ, স্বামী-স্ত্রীর সব কর্মকাণ্ডের পিছনে নজরদারী, পরিবারের বড়দের পক্ষ থেকে মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। আর এগুলো হয় ছোটো-খাটো বিষয়কে কেন্দ্র করে। যার উৎপত্তি অযাচিত হস্তক্ষেপ, কিংবা গুজব ও আজে-বাজে কথায় কান দেওয়া এবং সেটাকে বিশ্বাস করা।
উদ্ভুত পরিস্থিতি প্রতিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, বিবেক ও বুদ্ধি দ্বারা বিষয় ও পরিস্থিতি অনুধাবন করা। সেই সঙ্গে আরেকটি জরুরি বিষয় হলো- মনের দিক থেকে উদারতার পরিচয় দেওয়া, কোনো কোনো বিষয় দেখেও না দেখার ভান করা। কারণ সব সময় সে যা পছন্দ ও কামনা করে, তার মধ্যে মঙ্গল ও কল্যাণ হয় না, বরং কখনও কখনও সে যা পছন্দ ও কামনা করে না, তার মধ্যেই কল্যাণ হয়। বিষয়টি কোরআনে কারিমে এভাবে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা তাদের সঙ্গে সৎভাবে জীবনযাপন করবে; তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ করো, তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ। ’ -সূরা আন নিসা : ১৯
পারিবারিক সমস্যা প্রকাশের সূত্রে দেখা যায়- পারস্পরিক দায়বদ্ধতার বন্ধনে শিথিলতা, স্ত্রীর পক্ষ থেকে অবাধ্যতা, স্বভাব চরিত্রে অহমিকা এবং সাংসারিক দায়িত্ব পালনের প্রতি অনীহা। তখন প্রতিকার হবে- উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে স্ত্রীর ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া। বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্যের পথে চলার জন্য উৎসাহ প্রদান ও পরকালের কথা মনে করিয়ে দেওয়া।
কিন্তু এটা না করে কোনো কোনো স্বামী বিশ্বাস করে বসেন যে, তালাকের হুমকি দেওয়া, তালাক দেওয়া কিংবা বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটানোই হলো- দাম্পত্য বিরোধ ও পারিবারিক সমস্যার সঠিক সমাধান। ভুল, মনে রাখবেন এটা একমাত্র সমাধান নয়। যখন বিরোধ, অবাধ্যতা, মতানৈক্যের লক্ষণ প্রকাশ পাবে, তখন তালাক বা তালাকের হুমকি প্রদান করা তার প্রতিকার নয় বরং তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দেয়।
ইসলাম বলেছে, এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রীকে বুঝাবে, প্রয়োজনে অভিভাবকদের দিয়ে দরবার করবে। তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে স্ত্রীর অহমিকা ও অবাধ্যতার মোকাবেলায় শয্যা বর্জন করবে। শয্যা বর্জন করার অর্থ শয়নকক্ষ বর্জন করা নয়। তার পরও পরিস্থিতির প্রতিকারে কোনো অবস্থাতেই স্ত্রীকে অপমান করা, গোপন বিষয় প্রকাশ করা যাবে না।
দাম্পত্য দ্বন্দ্ব নিরসনের ব্যাপারে যখন সব উপায় ব্যর্থ হবে, দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে যাবে- তখন ইসলামি শরিয়ত কর্তৃক অনুমোদিত সুন্নত পদ্ধতির তালাকের মাধ্যমে সম্পর্ক শেষ করবে।
সুন্নত পদ্ধতির তালাক হলো- ঋতুমুক্তকালীন সময়ে মাত্র এক তালাক প্রদান করা। যে সময়ে সহবাস হয়নি। এ পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে তালাক প্রদান করা পরিস্থিতির প্রতিকার হিসেবে বিবেচিত। কারণ, এতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বেশ কিছুদিন সময় পায়। ওই সময়ে তারা চিন্তা-ভাবনা কিংবা পর্যালোচনা করতে পারে। ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হলে তারা পুনরায় সংসার শুরু করবে।
আরেকটি বিষয়, এই পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে তালাক প্রদানকারীকে ঋতুমুক্তকালীন সময়ের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে; আর হতে পারে যে, তখন তার মন পরিবর্তন হবে, হৃদয় জগ্রত হবে এবং আল্লাহ তার ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের জন্য নতুন কোনো উপায় করে দেবেন, ফলে তাদের সম্পর্ক তালাক পর্যন্ত গড়াবে না।
তাছাড়া স্ত্রীকে যখন রেজয়ি (প্রত্যাবর্তনযোগ্য) তালাক দেওয়া হবে, তখন তার ওপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হবে- স্বামীর ঘরে অবস্থান করা; সে বের হবে না এবং তাকে বের করেও দেওয়া হবে না। সুতরাং তার স্বামীর ঘরে অবস্থান করার মানে, প্রত্যাবর্তনের একটা পথ খোলা রাখা। ভালোবাসার সহানুভূতি উত্থাপন করার ক্ষেত্রে আশার সূচনা এবং সম্মিলিত জীবনযাপনের বিষয়টি স্মরণ করানো। ফলে এই অবস্থায় তালাকের হুকুমের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অবস্থান দূরে প্রতীয়মান হলেও চোখের দৃশ্যপট থেকে তার অবস্থান স্বামীর নিকটে।
আর এসব দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঘটে যাওয়া অনাকাংখিত ও অশান্ত ঝড়কে শান্ত করা, হৃদয়ে নাড়া দেওয়া, আপন অবস্থান বিবেচনাপূর্বক ধীরে-সুস্থে নিজ সংসার, শিশু ও পরিবারের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ লাভ। তাতে হয়তো সম্পর্ক ভাঙনের দিকে যাবে না।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৬
এমএ