হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশি মৃত্যুবরণ করলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের নিয়ে মদিনাতে তার জানাযার নামাজ আদায় করলেন। এতে সুযোগ সন্ধানী মুনাফেকরা অপপ্রচার শুরু করলো।
তাদের অভিযোগ সমূলে খণ্ডন করে আল্লাহতায়ালা সূরা আল ইমরানের ১৯৯ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ করে জানিয়ে দিলেন, প্রয়াত হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশি জন্মসূত্রে অমুসলিম খ্রিস্টান হলেও বিশ্বাস ও কর্মে তিনি একজন খাঁটি মুসলিম ছিলেন। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আহলে কিতাবদের মধ্যে অনেকেই এমন আছে যারা আল্লাহর অনুগত হয়ে তার প্রতি ঈমান রাখে। তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে সে সবের প্রতিও ঈমান রাখে। তারা আল্লাহর বাণীর বিনিময়ে সামান্য মূল্য ক্রয় করে না। তাদের জন্য তাদের রবের কাছে পুরষ্কার রয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। ’ -সূরা আল ইমরান : ১৯৯
আহলে কিতাবের শাব্দিক অর্থ গ্রন্থের অনুসারী। কোরআনে কারিমের পরিভাষায় আহলে কিতাব বলা হয় তাদের, যারা এমন গ্রন্থ অনুসরণের দাবি করে যা আল্লাহতায়ালা অবতীর্ণ করেছিলেন- কোরআন অবতীর্ণ করার পূর্বে। যেমন- তাওরাত, যাবুর ও ইনজিল। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা কোরআনের ভাষায় আহলে কিতাব।
ঈমানের শাব্দিক অর্থ যদিও বিশ্বাস- কিন্তু যে কোনো বিশ্বাসের নাম ঈমান নয়। ঈমান শব্দটি কোরআন ও ইসলামের নিজস্ব একটি পরিভাষা। বিশ্বাসকে ঈমান বলার জন্য কোরআনের সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত আছে। যখন সে শর্তগুলো ঠিক থাকবে- তখনই সে বিশ্বাসকে ঈমান আখ্যা দেওয়া যাবে। তেমনি একটি শর্ত হলো- আল্লাহর অনুগত হয়ে বিশ্বাস করা। অতএব, কেউ যদি আল্লাহর অবাধ্য হয়ে আল্লাহর অস্তিত্বে ও গুণাবলিতে বিশ্বাস রাখে, সে বিশ্বাসের স্বীকৃতি ও ঘোষণা দেয় তবে তার বিশ্বাসকে ঈমান বলা যাবে না। আর এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাকে মুমিন বা মুসলিম বলা যাবে না। আল্লাহর অস্তিত্ব ও গুণাবলিতে বিশ্বাসী সর্বস্বীকৃত অমুসলিমের উদাহরণ হলো- অভিশপ্ত ইবলিশ। সে আল্লাহকে বিশ্বাস করে, আল্লাহর গুনাবলিকে বিশ্বাস করে কিন্তু তার বিশ্বাসকে ঈমান বলা যাবে না। তাকে মুমিন বা মুসলিম বলা যাবে না। সহজ কথায়, কোনো অবাধ্য বিশ্বাসী ঈমানদার নয় বরং অনুগত বিশ্বাসী ঈমানদার।
বর্ণিত আয়াতে ‘তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে’ বাক্যে সম্বোধন করা হয়েছে শেষ নবীর উম্মতকে। তাই এ বাক্যে অবতীর্ণ গ্রন্থ দ্বারা কোরআন উদ্দেশ্য। আর ‘তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে’ বাক্যের সর্বনাম দ্বারা বুঝানো হয়েছে- আহলে কিতাব। তাই এ বাক্যে অবতীর্ণ গ্রন্থ দ্বারা তাওরাত, যাবুর ও ইনজিল উদ্দেশ্য।
একজন মুসলিমের পরিচয় হলো- সে আল্লাহর অবতীর্ণ সব গ্রন্থকে বিশ্বাস করে। একজন মুসলিম বিশ্বাস করে তাওরাত, যাবুর, ইনজিল ও কোরআন আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন। এ সবগুলোই আল্লাহর বাণী। তাই তাওরাত, যাবুর ও ইনজিলের অনুসরণের দাবিদার হয়ে কেউ যদি কোরআনকে অস্বীকার করে- তবে সে পরকালীন মুক্তি পাবে না। পরকালীন মুক্তির জন্য, পরকালে পুরস্কৃত হওয়ার কোরআনকে স্বীকার করতে হবে, কোরআনকে বিশ্বাস করতে হবে, কোরআনের অনুসারী হতে হবে।
পবিত্র কোরআনে যেভাবে তাওরাত, যাবুর ও ইনজিল অবতরণের ইতিহাস বর্ণিত আছে- সেভাবে তাওরাত, যাবুর এবং ইনজিলেও কোরআন অবতরণের ভবিষ্যদ্বাণী ও সুসংবাদ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে যেভাবে হজরত মুসা, হজরত ঈসা আলাইহিস সালামদের ইতিহাস আছে- সেভাবে তাওরাত, যাবুর ও ইনজিলে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী ও সুসংবাদ আছে।
ভবিষ্যদ্বাণী ও সুসংবাদের পাশাপাশি পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোতে শেষ নবীকে চিনতে পারার মতো যথেষ্ট আলামত বলে দেওয়া হয়েছে। যেন, শেষ নবীর আগমনের পর কেউ তাকে চিনতে ভুল না করে। ভুল বুঝে, অজ্ঞাতসারে বা না জেনে তাকে অস্বীকার করে কেউ যেন চির জাহান্নামী হয়ে না যায়। পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোতে যুগে যুগে মানুষের হাতে বহু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের পরেও শেষ নবীকে চিনতে পারার মতো আলামতগুলো তখনও অবশিষ্ট ছিল এবং এখনও আছে। আহলে কিতাবের অনেক আলেম সে সব আলামত গোপন করত। জনসাধারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা আলামতের কথা অস্বীকার করত। তারা আশঙ্কা করত, এ আলামতগুলো জানতে পারলে জনগণ তাদের আনুগত্যের পরিবর্তে শেষ নবীর আনুগত্য করবে। ফলে তাদের নেতৃত্ব, আধিপত্য খর্ব হবে। সমাজ থেকে তাদের সুবিধা গ্রহণের দিন শেষ হয়ে যাবে।
তাদের গ্রন্থে বর্ণিত আলামতগুলো ছিল আল্লাহর বাণী। তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব ছিল তা প্রচার করা। কিন্তু তারা আল্লাহর বাণী গোপন করার বিনিময়ে দুনিয়ার বিভিন্ন সুবিধা উপার্জন করত। তবে সব আহলে কিতাব এমন ছিলো না। তাদের অনেকেই আল্লাহকে ভয় করে- এ হীন কাজ থেকে বিরত থাকত। তারা আল্লাহর বাণীর বিনিময়ে দুনিয়ার সম্পদ ও সুবিধা গ্রহণ করত না। অর্থাৎ দুনিয়া নষ্ট হওয়ার ভয়ে আল্লাহর বাণী গোপন করত না। যে সত্য বাণী বললে নিজের ক্ষতি হবে তা বলা থেকে বিরত থাকত না, তাতে কোনো বিকৃতি সাধন করত না বা কোনো অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিতো না। বরং আল্লাহর সঠিক বাণী তারা জনসাধারণের কাছে প্রচার করত। এ ধরনের সৎ, নির্মোহ, নির্ভীক আলেমদের প্রশংসা এ আয়াতে করা হয়েছে।
আয়াতে বর্ণিত ‘সামান্য মূল্য’ দ্বারা উদ্দেশ্য দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধা। কেননা, দুনিয়ার বিশাল থেকে বিশাল যে কোনো প্রাপ্তি আখেরাতের ছোট থেকে ছোট যে কোনো প্রাপ্তির তুলনায়ও অতি সামান্য।
বর্ণিত আয়াতের সারকথা, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কেউ যদি আল্লাহর প্রতি অনুগত হয়ে তার ওপর ঈমান আনে, কোরআনের ওপর ঈমান আনে, তাদের আসমানি গ্রন্থে শেষ নবী সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী আছে তা গোপন না করে- তবে সে পরকালে পুরস্কৃত হবে, মুক্তি লাভ করবে। সে মুসলিম বলে গণ্য হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৬
এমএ/