মাত্র কয়েকদিন আগেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি এখনো সিদ্ধান্ত নেননি যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালাবে কি না। ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সবকিছু বিবেচনা করছি।
কিন্তু সেই সময় পার হওয়ার আগেই ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বিমানবাহিনী সফলভাবে হামলা চালিয়েছে বলে ঘোষণা দেন ট্রাম্প। নিজের ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ফরদো, নাতানজ ও ইসফাহানে আমাদের বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ বোমা বর্ষণ করেছে। সব বিমান এখন ইরানের আকাশসীমার বাইরে নিরাপদে ফিরেছে।
ইরানের ভূগর্ভস্থ ফরদো পরমাণু কেন্দ্র ‘ধ্বংস হয়ে গেছে’ বলেও তিনি দাবি করেন।
এ ঘোষণার মাত্র একদিন আগেও ট্রাম্প বলেছিলেন, ইরান যদি ‘শান্তি স্থাপন না করে’, তাহলে তাদের আবারও হামলার মুখে পড়তে হবে। এরও আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে পারবে না। আমরা সব বিকল্প খোলা রাখছি।
তার মানে গত এক সপ্তাহে ট্রাম্প একদিকে সময় চেয়েছেন, আবার অন্যদিকে হুঁশিয়ারি ও হামলার প্রস্তুতির কথাও বলেছেন, যা এখন সার্থকভাবে বাস্তব হয়ে উঠেছে।
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি এই হামলা শুধু ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে নয়, বরং ইসরায়েলের চলমান আক্রমণকেই পরোক্ষভাবে বৈধতা দিল। কারণ, কয়েক সপ্তাহ ধরেই ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়ে আসছিল। ট্রাম্পের বর্তমান পদক্ষেপকে সেই কৌশলগত চাপের অংশ হিসেবে দেখছেন তারা।
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, দুই সপ্তাহ সময় চাওয়ার ঘোষণাটি কি ছিল আসলে একটি কৌশলগত ফাঁদ? সময় চেয়ে ট্রাম্প কি আন্তর্জাতিক মহলকে আশ্বস্ত করেছিলেন শুধু নিজস্ব পরিকল্পনা গোপন রাখতে? বিষয়গুলো প্রশ্নবোধক চিহ্নের মাঝে পড়ে তখনই, যখন ইসরায়েলের আচরণে দুর্বলতা ধরা পড়ে। মূলত সেখান থেকেই ইরানে মার্কিন হামলার প্রত্যক্ষ আগমন দেখা যায়। কেননা, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমকে ‘বিশ্বের জন্য হুমকি’ আখ্যা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে আসছিল ইসরায়েল। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে ইরানের ভূখণ্ডে একাধিক গোপন হামলার পর ইসরায়েলি নেতারা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নেয়।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একাধিকবার বলেছেন, ইরানকে থামাতে হলে শুধু কথাবার্তা নয়, দরকার বাস্তব পদক্ষেপ। তাই তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আলোচনার বদলে প্রতিক্রিয়া দেখানোর’ আহ্বান জানান। এছাড়া ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও আইডিএফের শীর্ষ জেনারেলরাও ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সামরিক সহায়তা কামনা করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্টিলথ বোমারু এবং ৩০ হাজার পাউন্ড ক্ষমতাসম্পন্ন বাঙ্কার বাস্টার বোমা ছাড়া ইরানের ফরদো বা নাতানজের মতো গভীর ভূগর্ভস্থ স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। ফলে অনেকেই মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলা ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি চাপেরই প্রতিফলন।
আবার ১৩ জুন ইসরায়েলের হামলার পর ইরান বসে থাকেনি। তাদের ধারাবাহিক হামলায় ন্যুজ হয়ে পড়ে তেল আবিবসহ কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ইসরায়েলি শহরগুলো। গত ৯ দিনে ইরান থেকে ছুটে আসার হাইপারসনিক, ব্যালাস্টিক মিসাইল, হাজারো ড্রোন হামলায় কার্যত পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে ইসরায়েল। কি করবে ভেবে না পেয়ে জনগণের আড়ালে দখলদার সরকার তার পরম বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রকে বার বার ডাকতে শুরু করে।
তেল আবিবের রাস্তায় রাস্তায় বিলবোর্ড ব্যানারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ছবি ছেপে ‘Mr President, finish the job!’ লিখে নিজেদের দুর্বলতার পরিচয় পুরো পৃথিবীকে দেখায় ইরসায়েল সরকার। ফলে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে দুই সপ্তাহ বিশ্লেষণ ও কূটনৈতিক পথের কথা বললেও, ইসরায়েলের সেই আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প ঐকান্তিকভাবে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ স্থাপনাগুলোর ওপর হানার আদেশ দেন।
ট্রাম্পের ‘দুই সপ্তাহ সময়’ চাওয়ার ঘোষণা আসলে কৌশলগত ফাঁদ ছিল কিনা, সেটি বিশ্লেষণ করতে হলে তার অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা ও হোয়াইট হাউজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিস্তারিত জানা দরকার, যা প্রকাশ্যে আসেনি। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখে বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, এই সময় চাওয়ার ঘোষণাটি ছিল একধরনের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ধোঁয়াশা সৃষ্টি করার কৌশল।
প্রথমত, ট্রাম্প হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। তার ‘চিন্তা করছি’, ‘হয়তো হামলা করব, হয়তো নয়’ কথাগুলো বলাও ‘ইরানকে চুপ করিয়ে রাখার’ কৌশল। যাতে এ সময়র মধ্যে তিনি তার ‘স্ট্র্যাটেজি’ তৈরি করতে পারেন বা কূটনীতিকেরা সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। অল্প সময়ের জন্য হলেও ট্রাম্পের বার্তায় ‘অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য সরাসরি যুদ্ধ বা হামলার আশঙ্কা নেই’ বলে ধারণা করেন বিশ্লেষকরা।
এর মধ্য দিয়ে ইরানের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়কেও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রাখতে চেয়েছেন তিনি, যাতে তারা সংহত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন।
দ্বিতীয়ত, এই ধরণের সময় চাওয়া তাকে রাজনৈতিকভাবে আরও ‘দায়িত্বশীল ও বিচক্ষণ নেতা’ হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। সবাই মনে করছিল, তিনি হঠাৎ করে যুদ্ধ চান না। কিন্তু, বাস্তবে তিনি হয়তো তখনই হামলার ছক তৈরি করে রেখেছিলেন এবং সময় চেয়ে সেই প্রস্তুতি গোপন রেখেছিলেন।
তৃতীয়ত, হামলার ধরন ও লক্ষ্যবস্তুর সুনির্দিষ্টতা, যেমন বি-টু স্টিলথ বোমারু দিয়ে ফরদোর মতো ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় নির্ভুল আঘাত প্রমাণ করে এটি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ছিল না, বরং দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল।
এ থেকে বোঝা যায়, ট্রাম্প ইরানে হামলার বিষয়ে সচেতন ছিলেন। এটিকে তার ‘পরিকল্পিত কৌশলগত ফাঁদ’ বলাই যৌক্তিক।
এমজে