ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২, ১৩ মে ২০২৫, ১৫ জিলকদ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

যুক্তরাষ্ট্র-চীন এখন কেন আলোচনার টেবিলে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:২২, মে ১১, ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্র-চীন এখন কেন আলোচনার টেবিলে?

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ শিথিল হতে পারে, এমনটি মনে করা হচ্ছে। কারণ বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ সুইজারল্যান্ডে আলোচনা শুরু করেছে।

উভয়পক্ষের শীর্ষ বাণিজ্য কর্মকর্তারা শনিবার প্রথমবারের মতো উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বসেন।  

গত জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের ওপর শুল্ক আরোপ করেন। বেইজিং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। দুই দেশই পাল্টাপাল্টিভাবে শুল্ক আরোপ শুরু করে। এতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। চীনা পণ্যে নতুন মার্কিন শুল্ক ১৪৫ শতাংশ এবং চীনে কিছু মার্কিন পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়।
 
এরপর কয়েক সপ্তাহ ধরে কঠোর এবং কখনো কখনো উত্তেজনাপূর্ণ ভাষণে উভয়পক্ষই একে অপরকে বেশি বিপদগ্রস্ত হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। তবে এবার তারা আলোচনার টেবিলে এক হয়েছে। দুই পক্ষের কর্মকর্তারা এই প্রথম শুল্ক নিয়ে আলোচনায় বসলেন। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে আলোচনা কেন? 

মুখ রক্ষার জন্য? 

কয়েক দফায় পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের পর উভয়পক্ষই সংকট ভাঙতে চেয়ে সংকেত পাঠায়। তবে, এটি স্পষ্ট ছিল না কে আগে আপস করবে।  

কোনো পক্ষই পিছু হটতে চাইছে না, বলছিলেন সিঙ্গাপুরের আইএসইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং ফেলো ও সাবেক মার্কিন বাণিজ্য আলোচক স্টিফেন অলসন। তিনি বলছিলেন, আলোচনা এখন শুরু হয়েছে, কারণ দুই দেশই মনে করছে— তারা নিজেদের সম্মান বজায় রেখেই এগিয়ে যেতে পারবে। কেউ কারও কাছে হার মানছে না—এমন ভাবমূর্তি রাখতে চায় তারা।

তবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বুধবার জোর দিয়ে বলেন, এই আলোচনা যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে ওয়াশিংটনের প্রতি একটি সদিচ্ছা হিসেবে উপস্থাপন করে জানায়, তারা মার্কিন ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই বৈঠকে বসেছে।

তবে, ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে, চীনা কর্মকর্তারাই ব্যবসা করতে বেশি আগ্রহী। কারণ তাদের অর্থনীতি ধসে পড়ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বুধবার হোয়াইট হাউসে বলেন, তারা বলছে আমরা শুরু করেছি? আমার মনে হয়, তাদের উচিত তাদের নথিগুলো ভালো করে পড়ে দেখা।  

তবে আলোচনার সময় ঘনিয়ে আসতেই প্রেসিডেন্টের সুর কিছুটা নরম হয়। তিনি বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, কে প্রথম ফোন করেছে, কে করেনি – এসব নিয়ে খেলা চলে। কিন্তু আসলে এসবের কোনো গুরুত্ব নেই। গুরুত্বপূর্ণ হলো, আলোচনার কক্ষে কী ঘটে।

আলোচনার সময়টাও বেইজিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মস্কো সফরের সময়ের সঙ্গে মিলে গেছে। শুক্রবার তিনি মস্কোর বিজয় দিবসের প্যারেডে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
 
সেদিন শি জিনপিং গ্লোবাল সাউথের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ান। এটি ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি একটি স্পষ্ট বার্তা— চীনের কাছে শুধু বিকল্প বাণিজ্যসঙ্গীই নেই, বরং তারা নিজেকে বিশ্বের বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবেও তুলে ধরছে।

এর মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে বসলেও বেইজিং নিজের শক্তি ও প্রভাব প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে।

বাড়ছে চাপ

ট্রাম্প জোর দিয়ে বলছেন, শুল্ক আরোপ করে আমেরিকা আরও শক্তিশালী হবে। অন্যদিকে, বেইজিং ঘোষণা দিয়েছে, তারা শেষ পর্যন্ত লড়বে। তবে বাস্তবতা হলো— এই শুল্কনীতিতে উভয় দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

চীনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটির কারখানাগুলোর উৎপাদন কমে গেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের পর চলতি বছরের এপ্রিল মাসে উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। সংবাদমাধ্যম কাইশিনের এক জরিপে দেখা যায়, সেবা খাতের কার্যক্রমও সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বিবিসি জানায়, চীনা রপ্তানিকারকেরা উচ্চ শুল্কের চাপে বিপর্যস্ত। তাদের পণ্য গুদামে জমে থাকছে, যদিও তারা প্রকাশ্যে দৃঢ় মনোভাব দেখাচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টা করছে।

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বার্ট হফম্যান বলেন, আমার মনে হয় চীন এখন বুঝে গেছে, কোনো চুক্তি না থাকার চেয়ে একটি চুক্তি থাকা-ই ভালো। তাই তারা বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নিয়েছে— আচ্ছা, তাহলে আলোচনা শুরু করা যাক। মে দিবসের ছুটি শেষে বেইজিং মনে করছে আলোচনার সময় এখনই।

অন্যদিকে, শুল্ক নিয়ে তৈরি অনিশ্চয়তায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি তিন বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো সংকুচিত হয়েছে। বিশেষ করে যেসব খাত চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল, তারা বেশ আতঙ্কিত। লস অ্যাঞ্জেলেসের এক খেলনা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক বিবিসিকে বলেন, পুরো সরবরাহ শৃঙ্খল বা সাপ্লাই চেইন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মুখে।

ট্রাম্প নিজেও স্বীকার করেছেন, এই শুল্কের প্রভাব ভোক্তারা অনুভব করবেন। এক মন্ত্রিসভা বৈঠকে তিনি বলেন, আমেরিকার শিশুদের হাতে এখন ৩০টি পুতুল না-থেকে থাকতে পারে দুটি পুতুল। আর হয়তো সেই দুটি পুতুল স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ডলার বেশি দামে কিনতে হবে।

শুল্ক নিয়ে অতিরিক্ত মনোযোগের কারণে মুদ্রাস্ফীতি এবং সম্ভাব্য মন্দা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ বাড়ায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমছে। ৬০ শতাংশের বেশি আমেরিকান মনে করছেন, তিনি শুল্কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।  

স্টিফেন অলসন বলেন, দুই দেশই এখন বাজার, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে কিছুটা নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য চাপের মধ্যে আছে। জেনেভায় কয়েক দিনের আলোচনা সেই উদ্দেশ্যই পূরণ করবে।

এরপর আসলে কী?  

যদিও আলোচনা নিয়ে আশাবাদী মনোভাব রয়েছে, তবে একটি চুক্তির বাস্তবায়ন হতে কিছু সময় লাগতে পারে। হফম্যান বলেন, আলোচনা মূলত অবস্থা জানার জন্য হবে। এতে পরস্পরের অবস্থান জানা যাবে। যদি সব কিছু ভালোভাবে চলে, তাহলে ভবিষ্যতে আলোচনা করার জন্য একটি এজেন্ডা নির্ধারণ করা হবে।

আলোচনা কয়েক মাস পর্যন্ত চলতে পারে, ঠিক যেমন ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে হয়েছিল। সেবার প্রায় দুই বছর ধরে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের পর ২০২০ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একটি চুক্তিতে সই করে, যার মধ্যে কিছু শুল্ক স্থগিত বা কমানো হয়।

তবে ওই চুক্তিতে বিভিন্ন জটিল বিষয়, যেমন চীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর জন্য ভর্তুকি বা বাকি শুল্ক কবে তুলে নেওয়া হবে, সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, অনেক শুল্ক বাইডেনের প্রেসিডেন্সির সময়েও বহাল ছিল এবং ট্রাম্পের নতুন শুল্কগুলো সেই পুরোনো শুল্কের সঙ্গেই যোগ হয়েছে।

অলসন বলেন, এবার যে চুক্তি হতে পারে, সেটি হলো— ফেজ ওয়ান ডিল অন স্টেরয়েডস। অর্থাৎ, এটি আগের চুক্তির চেয়ে বড় হবে এবং কিছু জটিল বিষয় সমাধান করার চেষ্টা করবে। যেমন— অবৈধ ফেন্টানিল বাণিজ্য বা বেইজিংয়ের মস্কোর সাথে সম্পর্ক।

তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, এসব সমস্যা সমাধান করতে বেশ সময় লাগবে।

অলসন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্কের যে কাঠামোগত বিরোধ রয়েছে, তা সহজে সমাধান হবে না। জেনেভায় শুধু খোলামেলা আলোচনা এবং আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছার ওপর সাধারণ বিবৃতিই দেওয়া হবে।

বিবিসি থেকে অনুবাদ করেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর রকিবুল সুলভ

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।