‘আগর ফেরদৌস বর রুয়ে যামিন আস্ত, হামিন আস্ত হামিন আস্ত হামিন আস্ত’ (পৃথিবীতে যদি কোনো বেহেশত থাকে, তবে তা এখানে, এখানে, এখানে)। কাশ্মীরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এমনটাই বলেছিলেন মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর।
সেই কাশ্মীরকে আর সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেখা ‘বেহেশত’ বলা যায় না। বরং এটি যেন এক রাজনীতির দাবার বোর্ড, উন্মুক্ত বন্দিশালা, কিংবা যুদ্ধক্ষেত্র। যেখানে রাজনৈতিক হিসাব-নিকেশের মারপ্যাঁচে ঘুম হারাম হয় নিরীহ কাশ্মীরিদের। রক্ত ঝরে প্রায়ই। যার জেরে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় চিরবৈরী ভারত ও পাকিস্তান। ঝরে আরও আরও প্রাণ। ‘ভূস্বর্গে’র প্রতিটি কোণে কোণে যেন এখন তাই চাপা কান্না। প্রতিধ্বনিত হয় গুম হয়ে যাওয়া নিরীহ কিশোর-তরুণের চিৎকার। যেন ভেসে আসে বেঘোরে প্রাণ হারানো শত শত আদমসন্তানের অভিশাপ।
বিভাজন যেখান থেকে
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার আগে এখনকার জম্মু ও কাশ্মীর নামে পরিচিত গোটা এলাকা ছিল ডোগরা রাজাদের শাসনে। এর আয়তন ছিল দুই লাখ ২২ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এখন এই বিশাল অঞ্চল তিনটি আলাদা ভাগে বিভক্ত। ভারতের অধীনে রয়েছে প্রায় এক লাখ বর্গ কিলোমিটার, যা মোট ভূমির ৪৫ শতাংশ। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আছে ৭৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার, অর্থাৎ ৩৬ শতাংশ। আর চীনের নিয়ন্ত্রণে ৩৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার বা ১৬ শতাংশ। একটা সময় পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে একটি চুক্তি হয়, যার ফলে চীন পাকিস্তানের অধীনে থাকা আরও পাঁচ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটার ভূমি পায়। এতে চীনের নিয়ন্ত্রিত এলাকা বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশে পৌঁছায়।
১৯৪৮ ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষের পর ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান কাশ্মীরের একটি অংশ দখল করে, যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত। আর বাকি অংশ ভারতের শাসনে চলে আসে। এরপর ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর চীন কাশ্মীরের আরও একটি অংশ দখল করে নিয়ে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে।
কাশ্মীরের বিভাজন এবং কাশ্মীরিদের বর্তমান বিপর্যয়ের শিকড় বহু আগে রোপিত। ১৭৫২ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর কাশ্মীরে শুরু হয় আফগান শাসনের অধ্যায়। এর স্থায়িত্ব ছিল ১৮১৯ সাল পর্যন্ত। আফগান শাসন ছিল কাশ্মীরিদের জন্য বেশ পীড়াদায়ক। কিছু শাসক সুশাসক হিসেবে পরিচিত হলেও বেশিরভাগই ছিলেন অত্যাচারী। আফগান শাসকদের দুর্বলতার কারণে এবং জনসমর্থনের অভাবে শিখ সাম্রাজ্যের রাজা রঞ্জিত সিং ১৮১৯ সালে আফগানদের পরাজিত করে কাশ্মীর অধিকার করেন। শিখ শাসন ১৮১৯ থেকে ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এরপর ১৮৪৫-১৮৪৬ সালের ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হলে ব্রিটিশরা কাশ্মীরের ওপর অধিকার পায়।
শিখ সাম্রাজ্যের অধীনে জম্মু, কাশ্মীর, লাদাখ, এবং বালতিস্তানসহ বেশ কিছু প্রদেশ ছিল। জম্মুর শাসক ছিলেন ডোগরা জমিদার গুলাব সিং, যিনি পরে লাদাখ ও বালতিস্তানও অধিকার করেন। গুলাব সিং ব্রিটিশদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধে শিখদের পক্ষ নেননি। যুদ্ধ শেষে ৯ মার্চ ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়, যার মাধ্যমে কাশ্মীরসহ শিখ সাম্রাজ্যের কিছু এলাকা ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। এর এক সপ্তাহ পর ১৬ মার্চ ১৮৪৬-এ অমৃতসরে গুলাব সিং ও ব্রিটিশদের মধ্যে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, ৭৫ লাখ রুপির বিনিময়ে গুলাব সিং কাশ্মীরসহ বেশ কিছু পাহাড়ি জেলার মালিকানা লাভ করেন। ফলে একটি ভূখণ্ড এবং তার জনগণ অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যায়।
প্রখ্যাত কবি আল্লামা ইকবাল এ ঘটনা প্রসঙ্গে কাশ্মীরিদের ‘বিক্রি হয়ে যাওয়া জাতি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও এ ধরনের ভূখণ্ড বিক্রি বা হস্তান্তরের ঘটনা এটিই একমাত্র নয়। কথিত আছে, ডাচরা নিউইয়র্ক সিটি ছেড়ে দিয়েছিল সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে। যুক্তরাষ্ট্র ১৮৬৭ সালে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের একটি অংশ ৭.২ মিলিয়ন ডলারে কিনেছিল, পরে যেটির নাম হয়েছিল আলাস্কা। তবে ১৮৪৬ সালে কাশ্মীর বিক্রির ঘটনা ‘জাতি বিক্রি’র সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। ” ৭৫ লাখ রুপির এই চুক্তি কাশ্মীরি জাতিসত্তার মূল ধাক্কা হিসেবে আজও সামনে উঠে আসে।
১৯৪৭ সালের পর কাশ্মীর সংকটের মূল কারণ ছিল ওই ‘বিক্রি চুক্তি’। যদিও কাশ্মীরিরা কখনো ওই চুক্তি মেনে নেননি। শিখ শাসনের সময় কাশ্মীরের শাসক ছিলেন শেখ গোলাম মহিউদ্দীন। তার মৃত্যুশয্যায় তার ছেলে শেখ ইমামুদ্দীন কাশ্মীর গুলাব সিংয়ের হাতে দিতে অস্বীকার করেন। এর ফলে যুদ্ধ শুরু হয় এবং গুলাব সিং পরাজিত হন। তবে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাহায্যে তিনি আবার জয়লাভ করেন এবং শেখ ইমামুদ্দীন পরাজিত হন।
এরপর ডোগরা জমিদাররা কাশ্মীরিদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। তারা প্রায় ১০০ বছর ধরে (১৮৪৬-১৯৪৭) কাশ্মীর শাসন করেন এবং কাশ্মীরিদের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করতেন। যদি সেই সময় ব্রিটিশরা হস্তক্ষেপ করতো এবং ডোগরা শাসন থেকে কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণে নিতো, তাহলে কাশ্মীরের ইতিহাস হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারতো। যদি কাশ্মীর সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের আওতায় আসতো, তবে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিবেচনায় গোটা কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হতে পারতো এবং পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধেরও ঝুঁকি তলানিতে থাকতো।
ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার পর দুটি প্রধান সমস্যা সামনে আসে- দেশভাগ এবং দেশীয় রাজ্যগুলোর ভবিষ্যৎ। প্রথমত, দেশভাগে ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ হিসেবে বিভক্ত হয়। দ্বিতীয়ত, ৫০০ এরও বেশি দেশীয় রাজ্য কী করবে, তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। দেশীয় রাজ্যগুলো ছিল ব্রিটিশশাসিত অঞ্চলের বাইরে, যেগুলোর শাসকরা ব্রিটিশদের অনুগত ছিলেন। ভারত ও পাকিস্তান এই রাজ্যগুলোকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিল। অধিকাংশ দেশীয় রাজ্য ভারতেই যোগ দেয়, তবে কয়েকটি রাজ্য প্রথমে রাজি হয়নি। এরমধ্যে কাশ্মীরও ছিল।
১৯৪৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের শাসক ছিলেন মহারাজা হরি সিং। পাকিস্তানের সঙ্গে পরিবহন এবং অন্যান্য পরিষেবা বজায় রাখার জন্য তার একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি ছিল। সেসময় উপমহাদেশ ভাগের সময় ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও ভারতের নেতা জওহরলাল নেহরু মত দেন, কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য জনগণের রেফারেন্ডাম (গণভোট) নিতে হবে। অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছে অনুসারে কাশ্মীর ভারত অথবা পাকিস্তান- যে কারও সঙ্গেই যেতে পারবে। কিন্তু হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে কিংবা ভারতের সঙ্গে যেতে। বিপরীতে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে। এই অচলাবস্থার মধ্যে ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে কাশ্মীরের মুসলিম জনগণ রাজা হরি সিংয়ের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তখন হরি সিং ভারতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ সংক্রান্ত চুক্তিতে সই করেন। তার আহ্বানে ভারত সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে ভারতে। আর হরি সিংহের পূর্বেকার চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ক্ষুব্ধ হয় পাকিস্তান। শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।
যুগে যুগে যুদ্ধ
ভারত-পাকিস্তান প্রথম যুদ্ধ বাঁধে ১৯৪৭-৪৮ সালে। ওই যুদ্ধে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে ভারত কাশ্মীরের বিষয়টি উত্থাপন করে এবং সেখানে গণভোট, পাকিস্তানি সেনাদের প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়।
কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি ১৯৪৮ সালে কার্যকর হলেও পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে এবং তখন কাশ্মীর কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এর এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে, যার নাম হয় ‘আজাদ কাশ্মীর’। ভারতের কাছে যা ‘অধিকৃত কাশ্মীর’। আর দুই-তৃতীয়াংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকে, যেটাকে দিল্লি এখন বলে ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ নামে।
এই অঞ্চল নিয়ে ১৯৬২ সালে ভারতের সঙ্গে চীনেরও যুদ্ধ বাঁধে। তখন চীন কাশ্মীরের আকসাই চিন অংশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়, এবং পরবর্তী বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের কাছে ছাড় দেয়।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের দ্বিতীয় যুদ্ধটি ঘটে ১৯৬৫ সালে। এরপর আবার এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এরপর ১৯৭১ সালের যুদ্ধ এবং ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তির মাধ্যমে বর্তমানে প্রচলিত ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণরেখা চূড়ান্ত রূপ পায়।
১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ দখল করে, যেটি নিয়ন্ত্রণরেখা দিয়ে চিহ্নিত ছিল না। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান-সমর্থিত বাহিনীর বিরুদ্ধে আরেকটি সংক্ষিপ্ত এবং তিক্ত লড়াইয়ে জড়ায়। ‘কারগিল যুদ্ধ’ নামে পরিচিত ওই যুদ্ধের অনেক আগে ভারত ও পাকিস্তান দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠে।
হামলা, সংঘাত, নিপীড়ন ও জটিলতা
গোটা কাশ্মীর যেন এখন এক জ্বলন্ত ‘অগ্নিকুণ্ড’। কাশ্মীরের সমস্যা এতটাই গভীর যে, এই ভূখণ্ড নিয়ে ভারত সরকারও শান্তিতে নেই। দেশভাগের সময় এখানে যে অশান্তির বীজ রোপিত হয়েছিল, তা আজও মুছে যায়নি। জম্মু অঞ্চলে হিন্দু বসতির সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ানোর চেষ্টা করা হলেও শ্রীনগর অঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। শ্রীনগর অংশটি আজাদ কাশ্মীর বা পাকিস্তান সীমান্তবর্তী হওয়ায় সেখানে সবসময়ই যুদ্ধাবস্থা বিদ্যমান এবং সেখানকার সীমান্তে প্রায়ই প্রাণহানি ঘটে। ভারত এর জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনলেও সেখানকার অনেকের কাছে এটি ‘স্বাধিকারের সংগ্রাম’।
অনেক কাশ্মীরির ভাষ্য, কেবল সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দিয়ে ভারত কাশ্মীরকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু কাশ্মীরিরা নিজেদের বরাবরই স্বাধীন জাতি হিসেবে দাবি করে। যদিও গত ৭৮ বছরে তাদের দাবিকে উপেক্ষা করা হয়েছে, তবুও দেখা যায় যে কাশ্মীরিরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি থেকে সরে আসবে না।
এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় বিক্ষোভ ও বিদ্রোহীদের দমনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নীতি সেখানকার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
কাশ্মীরে বিদ্রোহী তৎপরতা ১৯৮৭ সালে বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের পর জেকেএলএফ নামে একটি সংগঠনের উত্থানের মাধ্যমে বড় আকারে শুরু হয়। ভারত অভিযোগ করে যে, পাকিস্তান সীমান্তের ওপার থেকে যোদ্ধাদের পাঠাচ্ছে, কিন্তু তারা তা অস্বীকার করে। ১৯৮৯ সালের পর থেকে এই রাজ্যে সহিংস বিদ্রোহ একাধিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলে।
২০১০ সালে দিল্লিনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতবিরোধী বিক্ষোভে শতাধিক যুবক নিহত হন। ওই সময় হুরিয়াত কনফারেন্সের নেতৃত্বে আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র বাহিনীর দায়মুক্তির বিশেষ আইন বাতিল, স্বাধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তান নিয়ে কঠোর নীতি গ্রহণের ঘোষণা দেয়, তবে সেসময় শান্তি আলোচনার প্রতি আগ্রহ দেখানো হয়। তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগ দেন। তবে দুই বছর পর, ২০১৬ সালে পাঠানকোটে ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ হয়, এবং ভারত পাকিস্তানভিত্তিক গোষ্ঠীকে দায়ী করে। এরপর মোদী তার পূর্বঘোষিত ইসলামাবাদ সফর বাতিল করেন, এবং তারপর থেকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ওই বছরের জুলাই মাসে ২২ বছর বয়সী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বুরহান ওয়ানি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হওয়ার পর ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে কাশ্মীরে। বুরহান ওয়ানি সামাজিক মিডিয়ায় সক্রিয় ছিলেন এবং তার ভিডিও তরুণদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল। তার ভূমিকাকে এই অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতা পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করে দিল্লি।
২০১৬ সালেই কাশ্মীরের উরিতে আরেক হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধাসামরিক পুলিশ সদস্য নিহত হন। হামলার পর ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং দ্রুত কিছু প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়। তারা পাকিস্তানের ভেতরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায়।
২০১৮ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীর রাজ্যে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বে একটি জোট সরকার ছিল, যার অংশীদার ছিল বিজেপি। তবে ২০১৮ সালের জুন মাসে বিজেপি তাদের জোট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। এ নিয়ে সেখানকার রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
২০১৯ সালের গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় ভারতের সেনাবাহিনীর বহরে আত্মঘাতী হামলায় ৪৪ জন সদস্য নিহত হন। অগাস্ট মাসে ভারত সরকার জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে, যা রাজ্যটিকে উল্লেখযোগ্য স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিল। এরপর রাজ্যটিকে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তর করা হয়। ফলে সেখানে অসন্তোষ আরও বেড়ে যায়। যদিও কঠোর সামরিকায়ন গোটা অঞ্চলকে ‘উন্মুক্ত কারাগারে’ পরিণত করে।
পুলওয়ামার ঘটনার পর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের বালাকোট শহরে কথিত ‘জঙ্গি আস্তানায়’ হামলা চালায় ভারতের সামরিক বাহিনী। তবে এর একদিন পরই ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের দু’টি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত ও পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে আটক করে পাকিস্তান। এরপর উভয় দেশ বাকযুদ্ধে লিপ্ত থাকলেও যুদ্ধ হয়নি। ২০২১ সালে ভারত ও পাকিস্তান এলওসি বরাবর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, যা পহেলগাঁওয় নিয়ে উত্তেজনা ছড়ানোর আগ পর্যন্ত কার্যকর ছিল।
পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ড এবং নেপথ্যে
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে একটি বড় হামলার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন ২৬ পর্যটক, যারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সেখানে ঘুরতে গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের পর এটি কাশ্মীরে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি, এই হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী, যা পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়্যবার শাখা।
টিআরএফের নামে প্রচারিত বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, কাশ্মীরে ভারত সরকার বাইরের রাজ্যের হাজার হাজার নাগরিককে যে অনুমতি দিচ্ছে, তার প্রতিবাদে এই হামলা চালানো হয়েছে। এই অনুমতি ভারতীয় নাগরিকদের কাশ্মীরে বসবাস ও কাজ করার অধিকার প্রদান করে।
বরাবরের মতো এই হামলার জন্যই দিল্লির নীতি-নির্ধারকরা পাকিস্তানকে দোষারোপ করেন। ভারত এর জবাবে পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় করা সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি বাতিলসহ বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ নেয়। অন্যদিকে ইসলামাবাদও বাতিল করে দুদেশের অখণ্ডতার প্রতি সম্মান রাখা সংক্রান্ত সিমলা চুক্তিসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক লেনদেন ও কার্যক্রম।
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, ইতোমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে পহেলগাঁও হামলার জবাব দেওয়ার ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। অন্যদিকে ইসলামাবাদ ৩০ এপ্রিল বলেছে, ভারত ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানে হামলার পরিকল্পনা করছে বলে তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে।
যদি ‘সবুজ সংকেত’ এর সঙ্গে ‘গোয়েন্দা তথ্য’ মিলে যায়, তাহলে এই অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ অত্যাসন্ন ধারণা করা যায়। তাতে হয়তো ঝরবে আরও রক্ত। ঝরবে আরও প্রাণ। স্বজন হারানোর কান্নায় পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লিপিবদ্ধ হবে নতুন কোনো শোকগাথা।
(বিবিসি, আল জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অবলম্বনে)
এইচএ