ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ভারত

গল্প হলেও সত্যি!

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৯
গল্প হলেও সত্যি! রোকসানা ও তার সন্তান শাওন

কলকাতা: জীবন কখনো কখনো গল্পকেও হার মানায়। একেকজনের জীবনের ঘটে যাওয়া একেকটি ঘটনা কল্পনার চেয়েও অবিশ্বাস্য হয়ে ওঠে! তেমনই এক করুণ গল্প যশোরের ছাতিয়ানতলা গ্রামের রোকসানা খাতুনের। 

হারিয়ে যাওয়া বোনের ছেলে ইমন ভারতের মথুরায় হাজতবাস করছে খবর পেয়ে ছয়মাসের সন্তান শাওন আর সঞ্চিত সবটুকু সম্বল নিয়ে পারি দেন ভারতে। হাজতে গিয়ে দেখা করেন ইমনের সঙ্গে।

 

ছোটপর্দার বদৌলতে ভাঙা ভাঙা হিন্দি বোঝেন রোকসান। তাই দিয়েই উকিল তারাচন্দের সঙ্গে চালিয়ে যান কথোপকথন। উকিলের কাছ থেকে বুঝে নিতে চান কিভাবে ফেরত পেতে পারেন বোনের ছেলেকে।

‘আমি ৯০ দিন ভারতে থাকতে পারবো। আমার ভিসা দেখে বলুন, এই সময়ের মধ্যে পারবো সব কাজ মেটাতে। ’ তারাচন্দ রোকসানাকে বলেন, ‘এখনো ২২ দিন সময় আছে। আশা করছি পারবেন। ’ 

একদিকে আদালতের হ্যাপা, অন্যদিকে ভারতে বসবাসের মেয়াদ শেষের দিকে। রোকসানা ঠিক করেন সময় নষ্ট করলে চলবে না। খোঁজ যখন পেয়েছি, পরেও আসা যাবে। ফিরতেই হবে নির্দিষ্ট সময়ে।

১৮ ডিসেম্বর রোকসানা মথুরা থেকে ফিরে আসবেন কলকাতায় এমনই মনস্থির করেন। এরই মধ্যে উকিল তারাচন্দ জানান, ২০ ডিসেম্বর কোর্টে তারিখ পড়েছে। থেকে গেলে হয়তো ফেরত নিয়েই যেতে পারবেন ইমনকে। কথামতো থেকে যান রোকসানা। কিন্তু আইনি জটিলতায় জামিন পায়নি ইমন।  

কলকাতায় ফিরে আসতে হয় রোকসানাকে। সঞ্চিত সম্বলটুকু তখন শেষ রোকসানার। রাত কাটে শেয়ালদহ স্টেশনে। পরদিন বনগাঁ হয়ে পৌঁছান হরিদাসপুর। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা আটকে দেন রোকসানা ও তার সন্তানকে।

ভারতে অবস্থানের মেয়াদ ৯০ দিন অতিক্রম করে ৩ দিন বাড়তি হয়ে গেছে। ৯৩ দিনের কারণে দিতে হবে জরিমানা। রেহাই পেতে রোকসানা কাকুতি-মিনতি করেন। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা জানান, ‘বিনা জরিমানায় যদি ছেড়ে দেই তাহলে চাকরি চলে যাবে আমাদের!’

রোকসানা বুঝতে পারেন উপায় নেই। জানতে চান কত দিতে হবে। ইমিগ্রেশন কর্তারা জানান জরিমানা এখানে নেওয়া হয় না। দিতে হবে কলকাতার এফআরআরও অফিসে। তারা লিখে দেন ঠিকানা।  

কলকাতা ফিরে আসেন রোকসানা। পৌঁছান রবীন্দ্রসদনের পাশে এফআরআরও অফিসে। কর্মদিবস শেষ সেদিন অফিস বন্ধ। সন্তান কোলে শীতের রাতটা রোকসানার কাটে রবীন্দ্রসদনের ফুটপাতে। পরদিন দেখা হয় এফআরআরও কর্তাদের সঙ্গে। দেখেশুনে কর্তারা জানান এখন তাদের মাথা পিছু দিতে হবে ৩শ’ ডলার। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২১ হাজার ৬৫০ রুপি। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় রোকসানার। থরথর করে কাপতে থাকে তার হাঁটু। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে পানি। কোথা থেকে রোকসানা দেবে ৬শ’ ডলার? কিডনি বেচে বা ভিক্ষা করেও উঠবে না এই টাকা! তাহলে কি রোকসানা আর কোনদিন দেশের মাটি ছুঁতে পারবে না?

পাঠকদের জেনে রাখা ভালো ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশি মুসলিম হলে ৯১ দিন থেকে ১৮০ দিন ওভার স্টে হলে মাথাপিছু জরিমানা গুণতে হয় ৩শ ডলার। সংখ্যালঘু হলে পড়বে ১শ’ রুপি। আবার ১৮১ থেকে দুই বছর এবং দুই বছরের বেশি ওভার স্টে হলে যথাক্রমে জরিমানা পড়ে ৪শ’ এবং ৫শ’ ডলার। সংখ্যালঘু হলে ২শ’ এবং ৫শ’ রুপি। সেক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি রোগী বা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ভারতে অবস্থানের নির্দিষ্ট কারণ জানালে বিষয়টা ভিন্ন। তবে দুই ক্ষেত্রেই জানাতে হবে ফরেনার রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসে (এফআরআরও)। সে যাই হোক এসব সরকারি ব্যাপার। ফিরে যাই রোকসানার কাছে।

এফআরআরও কর্তারা রোকসানাকে লিখে দেন বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের ঠিকানা। সেখানে পৌঁছান রোকসানা। খোঁজখবর চলে রোকসানার সঠিক নিবাস যশোরে কিনা! ঠাণ্ডার মধ্যে দুই রাত রোকসানর কাটে শেখ মুজিব সরনির ফুটপাতে। এরপর একটা কাগজ পান রোকসানা। বাংলাদেষি কর্তারা জানান কাগজটি ইমিগ্রেশনে দেখালে তাকে দেশে ঢুকতে দেবে। আনন্দের সীমানা নেই রোকসানার। সালাম জানিয়ে রওনা দেয় বেনাপোলের উদ্দেশে। ইমিগ্রেশন কর্তারা জানান চিঠি দিলে হবে না। নির্দিষ্ট জরিমানা দিতে হবে তাও আবার অনলাইনে।

হায়রে অদৃষ্ট! আজ কাকে দোষ দেবে রোকসানা? নিজের ধর্মকে নাকি নিজের দেশকে বা সেই ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তাকে? নাকি অতি গরিব হয়ে জন্ম নেওয়া অদৃষ্টকে। রোকসানা এতদিনে বুঝতে পারে অরণ্যে রোদন করে লাভ নেই। ফিরে যান দূতাবাসে। উপহাইকমিশনও কোনো উপায় খুঁজে পায় না। অবশেষে হর্তাকর্তারা বসেন আলাপে। ঠিক হয় কর্মচারী থেকে কর্মকর্তারা, সামর্থ্য অনুয়ায়ী ভরবেন জরিমানা। ফেরত পাঠাবেনই রোকসানা ও তার সন্তানকে।  

রোকসানা সাহস করে বলেন, ‘স্যার আমাকে একটু আশ্রয় দেন, ফুটপাতে মাথায় ব্যাগ নিয়ে শুতে ভরসা পাই না। ব্যাগটায় পাসপোর্ট আছে। ব্যাগটা চুরি হলে আমি তো শেষ!’ সমস্যা যেন পিছু ছাড়ছে না উপহাইকমিশন কর্তাদের। হোটেলে রাখার খরচ কি ভাবে দেবে? একেতো দিতে হবে ৪৩ হাজার ৩শ রুপি।

অবশেষ ঠিক হয় রোকসানার মাথা গোজার ব্যবস্থা। দেওয়া হয় খাবার খরচ, গরম কাপড়, কাথা-বালিশ-তোশক। রোকসানার ঠাঁই হয় চার দেওয়ালের মাঝে। অনলাইনে ভরা হয় জরিমানা। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন নামকরা একটি পরিবহনের বাসমালিক।

কেমন লাগছে ফিরে যেতে পেরে? ঠোঁটের ফাঁকে স্মিত হাসি আর অশ্রুভরা দুচোখে রোকসানা বলেন, স্যারদের ঋণ কোনোদিন ভুলব না। আপনাকেও ভুলব না। যশোরে এলে দাওয়াত রইল বাসায় আসার। ধীরে ধীরে বাস ছাড়ল। অবশেষে দেশে ফিরতে পারলো ছোট্ট শাওন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৯
ভিএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।