ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

ভারত

মোদীর নোট বাতিল কি ফ্লপ শো হতে চলেছে!

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৬
মোদীর নোট বাতিল কি ফ্লপ শো হতে চলেছে!

নোট বাতিলের পর এক মাস কেটে গেল, যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতবাসীর কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া ৫০ দিনের এখনও ১৯ দিন বাকি।

কলকাতা: নোট বাতিলের পর এক মাস কেটে গেল, যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতবাসীর কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া ৫০ দিনের এখনও ১৯ দিন বাকি। কিন্তু প্রথম একটি মাসে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতার নিরিখে দেখতে গেলে দেখা যাবে নোট বাতিলের ফলে এখনও পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ঝুলিতে কিছুই আসেনি।

যদি না কোন কিছু ‘অলৌকিক’ কাণ্ড ঘটে তবে বাকি উনিশ দিনে বিশেষ কিছু সুবিধা হবে বলেও মনে হচ্ছে না।
 
নোট বাতিলের পর ৫০০ এবং ১০০০ রুপির নোট জমা দেওয়া, তারপর সরকার নির্ধারিত সামান্য পরিমাণে ব্যাঙ্ক থেকে অর্থ তোলা, নোট শূন্য এটিএম-এর দরজায় দরজায় ঘোরা এবং অবশেষে একটি লম্বা লাইনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আশায় বুক বাঁধা, ১০০ রুপির কয়েকটি নোট হয়তো হাতে পাওয়া যাবে। এটাই বর্তমানে ভারতের সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের পরিস্থিতি।  
 
সুকুমার রায়ের ভাষায় বলতে গেলে “......... হাতে রইল পেনসিল!” আর সেই পেনসিল বর্তমানে ‘ক্যাশ লেস ইকোনমি’ নামে জনগণের কাছে ধরা দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলকে দুই হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছিল ক্যাশ লেস ‘অ্যাপ’ কোম্পানিগুলি। আর ঠিক একমাস বাদে আলোচনার কেন্দ্রে পেটিএম, ফ্রিচার্জের মতো সংস্থাগুলি, অনেকের ক্ষেত্রে ভরসাও।
 
‘ব্লাক মানি’ বাজেয়াপ্তের বিষয়টি বর্তমানে বেশ কিছুটা আড়ালে চলে গেছে। বেশি করে সামনে চলে আসছে মানুষের ভোগান্তি এবং ক্যাশ লেস অর্থনীতির বিষয়টি। টানা তিরিশ দিন ধরে গোটা ভারতের খুচরোর সমস্যায় ব্যবসার পরিমাণ লক্ষণীয় ভাবে কমে গেছে। এর ফলে সরাসরি প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন জিডিপি-র ক্ষেত্রে অনেকটাই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে নোট বাতিল।
 
একদিকে জিডিপি-র উপর প্রভাবের আশঙ্কা অন্যদিকে নোট সমস্যায় জনগণের জেরবার হওয়ার দায় সরকার চাপাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দিকে। আর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চুপ থেকে ঘুরিয়ে দায় চাপাচ্ছে সরকারের দিকে।
 
শুধুমাত্র খুচরো ব্যবসা নয় বড় অংশের মানুষের বেতন তোলার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে। ধাক্কা খেয়েছে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যেও। শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া ডলারের দাম ৬৭ রুপির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করলেও কলকাতার বেসরকারি মানি এক্সচেঞ্জগুলির  কাছ থেকে ৬০ -৬১ রুপির বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলা টাকার বর্তমান দর ৮৩ হলেও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে ৬৯ রুপি আবার কোথাও ৭০ রুপি। ফলে তীব্র সমস্যায় পরছেন পর্যটকরাও।
 
খুচরো বাজারের অবস্থার একটা ছবি পাওয়া গেল কলকাতার নিউমার্কেটে। বিক্রেতারা জানাচ্ছেন খুচরো কম থাকায় ব্যবসার পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ সহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের পর্যটকদের আসা অনেক কমে গেছে ফলে সেই ব্যবসাও বন্ধ। তাই আশা একমাত্র ‘বড় দিন’-এর কেনাকাটা। কিন্তু তাতেও যে খুব সুবিধা হবে সে কথা তারা মনে করছেন না। একই অবস্থা হোটেলগুলোতে।
 
বিরোধী দলগুলি যথেষ্ট সোচ্চার হয়েছে। এর মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস সবথেকে বেশি এই নিয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু এতে বিশেষ ফল হয়নি। অন্তত খুচরো নোটের সমস্যার ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন হয়নি। অনেকে বলছেন এইভাবেই ‘ক্যাশ লেস’ জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে ভারতীয়রা। কিন্তু পরিকল্পনা আর বাস্তবে ফারাক অনেক। পশ্চিমবঙ্গের কথাই যদি ধরা যায় তবে এই রাজ্যের ৪২ হাজার গ্রামের মধ্যে ৯ হাজার গ্রামে কোন ব্যাঙ্ক নেই। সেখানে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করা মানুষের সংখ্যা নগণ্য। ভারতে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন মাত্র ২৯২ মিলিয়ন মানুষ। জনসংখ্যার  হিসেবে সেটাও খুবই সামান্য। তাই নোটের বদলে ‘ই ওয়ালেট’-এর প্রস্তাব অনেকের কাছেই শুধু বেমানান নয় অবাস্তব ঠেকছে।
 
প্রাথমিকভাবে যারা নরেন্দ্র মোদীর এই প্রস্তাবকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন তারাও অনেকেই একমাস বাদে তাদের মত বদলেছেন। তার বড় কারণ ব্যাঙ্কে জমা পরা বাতিল ৫০০ এবং ১০০০ রুপি নোটের পরিমাণ। ভারতের অর্থনীতিতে ২০১৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৫০০ এবং ১০০০ রুপির নোট ছিল প্রায় ১৪.১৮ লক্ষ কোটি। ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া হিসেবে দেখা যাচ্ছে জমা পড়েছে প্রায় ১১ লক্ষ কোটি বাতিল নোট। এই হিসেব থেকে বোঝা যাচ্ছে বাইরে পড়ে আছে ৩ লক্ষ কোটি রুপির নোট। এর মধ্যে আছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে জমা থাকা কিছু বাতিল ১০০০ এবং ৫০০ রুপির নোট। যেগুলি একদম শেষ দিনগুলিতে জমা হবে।
 
এর মানে প্রচুর পরিমাণ ‘ব্লাক মানি’ ঘুর পথে সাদা হয়ে গেছে, বা সরকার যাকে ‘ব্লাক মানি’ ভেবেছিলেন সেটা আদতে ‘ব্লাকমানি’ নয়। এখানেই প্রশ্ন উঠছে, এই বিপুল পরিমাণ সময় এবং শ্রম নষ্ট করে, ব্যবসার এত ক্ষতি করে, অর্থ তোলার লাইনে এতোগুলি মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে জনগণের কি সুবিধা হল? তবে কি ‘ব্লাক মানি’ উদ্ধারের থেকে সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ‘ক্যাশ লেশ’ অর্থনীতির দিকে? তবে কি ভোগান্তির শেষে শুধুই দেখা যাবে একটি ‘ফ্লপ শো’। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দেওয়া সময় এখনও কিছুটা অবশিষ্ট আছে। তারপর বোঝা যাবে সঠিক হিসেব। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের একমাস পরে যেটা দেখা যাচ্ছে তাতে বলা যায়, জনগণের হাতে আপাতত রইল শুধুই ‘পেনসিল’।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৬
ভি.এস/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।