ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

‘অনৈতিক বৈষম্যে বড় হচ্ছে বাংলাদেশের শিশুরা’

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১২
‘অনৈতিক বৈষম্যে বড় হচ্ছে বাংলাদেশের শিশুরা’

ঢাকার একটি বস্তিঘরে ঠুনকো একটি কাঠের চৌকির এক কোনায় বসে অপুষ্টিতে ভোগা একটি শিশুর মুখে ফিডার থেকে দুধ তুলে দিচ্ছিলেন মিলিন ক্লাস। শিশুর মা হালিমার মুখে শুনছিলেন ওর জন্ম সময়ের কথা।

কথাগুলো যেনো বিশ্বাসই হচ্ছিলো না মিলিনের।

হালিমার কাহিনী অবিশ্বাস্য। বলছিলেন, ছোট মেয়েটি জন্মের সময় তার ৫ বছরের বড় মেয়ে তিথিই শুধু সেখানে উপস্থিত ছিলো। সেই এর জন্মধাত্রী, সেই কেটেছে তার নাড়ি। এখনো দিনে ছয় ঘণ্টা ছোট বোনের দেখাশোনা করে তিথি।

এসব কথা শুনে বারবার শিউরে উঠছিলেন বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী মিলিন ক্লাস। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো।

হালিমার দুই কন্যা সন্তানের প্রসঙ্গে মিলিন বলছিলেন, এই শিশু দুটি আমার দুই শিশুর সমান বয়সী। আভা ও হিরো- তাদের আমি এক দণ্ডের জন্যও চোখের বাইরে করতে পারি না। আর এই দুটি শিশুকে ঘরে রেখে তাদের মা দীর্ঘ সময় বাইরে থাকে। বাইরে তাকে থাকতেই হয়, কারণ কাজে যাওয়া ছাড়া তার যে আর কোনোই উপায় নেই।

‘ছোট্ট তিথি নিজের হাতে বোনের ভূমিষ্ট হওয়ার কাজ করেছে। নিশ্চয়ই এসময় তাকে এমন সব কিছু দেখতে হয়েছে যা এমন একটি কোমল প্রাণের জন্য উপযুক্ত নয়’, স্বগোতক্তি মাইলিনের। ছোট্ট একটি শিশুর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা হৃদয় ভেঙ্গে দেওয়ার মতো।

মিলিন বলেন, আমার দুই সন্তান নিয়ে হালিমার দুই সন্তানের পাশে যখন বসেছিলাম তখন বার বার মনে হচ্ছিলো এদের মধ্যে কত বিস্তর ফারাক। Myleene

মিলিন ক্লাস, ৩৩, বাংলাদেশে সেভ দ্য চিলড্রেন এর নবনিযুক্ত দূত। সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘কোনো শিশুই মৃত্যুবরণের জন্য জন্মায় না’ শীর্ষক প্রাচারাভিযান দ্বিতীয় বছরে পড়েছে। এই অভিযানের মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বে শিশুদের অপুষ্টি ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিষ্ঠানটি।

গবেষণা মতে, বাংলাদেশে বস্তির ১৭ শতাংশ শিশুই অভুক্ত থাকার কারণে মারা যায়। আর অর্ধেক শিশুই অপুষ্টির কারণে সঠিকভাবে বড় হয়ে উঠতে পারে না।

‘এই দেশে দারিদ্রের মাত্রা রিতিমতো মর্মাহত করে’, বললেন মিলিন।

তিনি বলেন, বস্তির নারী ও শিশুদের জন্য ছোট্ট কাচাঘর ও আব্রু ঢাকার সামান্য কাপড়টুকুর বাইরে আর কিছু নেই।

তাদের প্রতিটি দিনই সংগ্রামের। সামান্য খাদ্য সংগ্রহ করে তারা একেকটি দিন টিকে থাকে। তাদের ভবিষ্যত বলতে কিছু নেই। নেই কোনো আশা বা স্বপ্ন।

শিশুদের জন্য এইসব মায়েদের একটাই কামনা, ওরা যেন বেঁচে থাকে।

বাংলাদেশে অপুষ্টির শুরুটা অবশ্য মায়ের কাছ থেকেই। গর্ভাবস্থায় এই মায়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে কম ওজনের। প্রয়োজনীয় খাদ্যেরও ঘাটতিতে থাকে তারা। ফলে তাদের সন্তানও জন্ম নেয় কম ওজন নিয়ে। মায়ের বুকে দুধের পরিমান কম থাকে। বাজারের পুষ্টিকর দুধ কেনার সামর্থ তাদের থাকে না।

উপরন্তু মায়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত, ফলে নবজাতকের জন্য কোন খাদ্যটি ভালো হবে তা তাদের অজানা, শ্রেফ চালের গুঁড়োয় চিনি মিশিয়ে জ্বাল দিয়েই শিশুকে খেতে দিতে দেখেছি অনেককে, বলেন মিলিন।

তিনি বলেন, এর মধ্যে পুষ্টিকর কিছুই নেই। ফলে শিশুগুলো দ্রুত তাদের ওজন হারাতে থাকে। পক্ষান্তরে আমি যদি আমার দুটি শিশুর কথাই বলি তাহলে বলবো তারা প্রচুর পরিমানে বিশুদ্ধ খাবার খেতে পাচ্ছে, দুধ পাচ্ছে।

‘আমার কাছে শিশুদের জন্য এই বৈষম্যকে খুবই অনৈতিক মনে হয়,’ বলেন মিলিন। রাজধানী ঢাকার ৩০ শতাংশ মানুষের বাস বস্তিতে। বস্তির ঘরে বসে হালিমার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো মিলিন ক্লাসের। তার কাছে মনে হচ্ছিলো হালিমার দুই মেয়ে তিথি ও তিশা মোটেই স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে উঠছে না।

হালিমা বলছিলেন তার কথা- ৯ বছর বয়সে বাবা-মা হারিয়ে বড়ভাই ও ভাবীর সংসারে অনেকটা কৃতদাসের জীবন ছিলো তার। এর পরে বিয়ে হলে হালিমার মনে হচ্ছিলো- এবার বুঝি তার জীবনের গতি ফিরবে। কিন্তু দুই সন্তানের জন্ম হওয়ার পর তার স্বামী তাকে ছেড়ে যায় এই অভিযোগে যে, হালিমা আর আগের মতো সুন্দরী নেই। এরপর সন্তান ও নিজের ভরনপোষণের জন্য ঝাড়–দারের কাজ নেন হালিমা।

শিশু তিশার মাথাভর্তি খুজলি-প্যাচরা। হালিমা বলছিলেন, ওষুধ দেওয়ার অর্থ তার নেই। দুমুঠো খাবার তাদের জোটেনা। ক্ষুধায় মাঝে মধ্যে নিজেই অজ্ঞান হয়ে যান।

মিলিন বলেন, ‘আমার বুক ভেঙ্গে কান্না আসছিলো, কিন্তু হালিমার সামনে কাঁদতে পারছিলাম না, পাছে সে তার শেষ মনোবলটুকুও হারিয়ে ফেলে। তবে হালিমা ও তার সুন্দর মেয়ে দুটির কষ্ট আমাকে সত্যিই বিক্ষুব্ধ করে তুলছিলো। ’

বস্তিতে মিলিনের আরও দেখা হয় অন্তরার (২০) সঙ্গে। তিন মাসের মেয়ে সন্তানটির নাম রেখেছেন রুপা। সাড়ে ৬ পাউন্ড ওজন নিয়ে জন্মানোর পর থেকেই ওজন হারাচ্ছে সে। এখন রুপার ওজন সাড়ে চার পাউন্ড।

মিলিন বলেন, ‘অন্তরা খুব উৎসাহভরে তার সন্তানটিকে আমার কোলে তুলে দিলো আমি তার ওজন অনুভব করে চমকে গেলাম। ’

শরিরের প্রতিটি হাড় স্পষ্ট এবং গায়ের চামড়া ধুসর বর্ণের।

‘আমি বুঝতে পারছিলাম কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নিলে শিশুটি শিগগিরই মারা যাবে। তবে এ নিয়ে তার মায়ের মধ্যে তেমন উদ্বেগ লক্ষ্য করলাম না। তার বলার যেনো কিছুই নেই। সে কি বলবে, নিজেই তো ভুগছে অপুষ্টিতে। তার বুকে দুধ নেই যে বাচ্চাটিকে খাওয়াবে। তিন মাসের শিশুটির খাবার এখন চালের গুলো জ্বালিয়ে তৈরি পাতলা হালুয়া,’ বলছিলেন মিলিন ক্লাস।

‘মন সায় দিচ্ছিলো না এমন পরিস্থিতিকে এভাবে ফেলে রেখে যাই। সেভ দ্য চিলড্রেনকে ধন্যবাদ প্রতিষ্ঠানটি এমন হাজারো শিশুকে সহায়তার দায়িত্ব নিয়েছে,’ বলেন তিনি।

একটি হাসপাতালে গিয়েও একই চিত্র চোখে পড়ে মিলিনের। অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে এমন শিশুদের চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালটি। চ্যারিটির মাধ্যমে চলে। একজন পুষ্টিবিদ এখানে মায়েদের পুষ্টিশিক্ষাও দেন। ২০ শয্যার হাসপাতালের একটি শয্যায় মিলিনের দেখা হয় ১৫ বছরের কিশোরী মা রিনা ও তার শিশুপুত্র তুহিনের সঙ্গে। তুহিনের বয়স তিন মাস, আর ভয়াবহ রকমের শুকনো।

রিনা জানালো, তার বিয়ে হয় ১৩ বছর বয়সে। এখন তার স্বামী তাকে প্রায়শই মারধোর করে। এই শিশুটিকে সঠিকভাবে লালন পালনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও জ্ঞান কোনোটিই তার নেই। গর্ভাবস্থায় দিনে এক বেলার বেশি খাবার জুটতো সেকথাই জানালেন রিনা।

মিলিন বলেন, ‘তুহিনের ছোট্ট দুটি পায়ে এতটুকু চর্বি নেই। তার অস্পষ্ট কান্নার শব্দে বেরিয়ে আসে কষ্ট ও বেদনা। মনে হচ্ছিলো কান্নার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে শিশুটি।

‘এসময় আমার নিজের ছেলো হিরোর কথা মনে মনে পড়লো। ও যখন ক্ষুধার্ত থাকে তখন কত জোরে শব্দ করে কাঁদে। দুটি শিশুর মধ্যে কতই না পার্থক্য,’ বলেন মিলিন।

চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে মিলিন জানলেন, রিনার ছেলেটি হয়তো কখনোই সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে না।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিলো, কতই গভীর ও বড় এই সমস্যা। আর দরিদ্র এইসব মায়েদের জন্য কত কিছুই না করা প্রয়োজন। ’

তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে আমরা কত ভাগ্যবান। আমরা জানি সেখানে বিনামূল্যের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা আমাদের শিশুদের নিরাপদ ও সুস্থ্য রাখবে। কিন্তু এখানে শিশুরা সে সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি। এখানের মাযেরাও পৃথিবীর সব মায়েদের মতো চায় তাদের সন্তানরা ভালো থাকুক।

বাংলাদেশ সময় ২১২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।