ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

কালের কণ্ঠ গোলটেবিল

করোনাকালে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলেছে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০২০
করোনাকালে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলেছে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা: সবার জন্য স্বাস্থ্য শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক | ছবি: রাজীন চৌধুরী

ঢাকা: সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নাগরিকের মৌলিক অধিকার, এই অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। করোনাকালে এই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন কালের কণ্ঠ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের বক্তারা।

তারা বলেন, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। বসুন্ধরা গ্রুপের মতো বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় বিরাট অবদান রাখতে পারে। বসুন্ধরা গ্রুপ করোনাকালে কোভিড-১৯ হাসপাতাল তৈরি করে বড় মনের পরিচয় দিয়েছে।

মঙ্গলবার (০৮ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড মিলনায়তনে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা: সবার জন্য স্বাস্থ্য’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে কালের কণ্ঠ।

এতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, “সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব দিয়ে থাকেন যাতে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। ”

তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিটি খাতে উন্নতি করছে বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে যেখানে ইউরোপ-আমেরিকা বিপর্যস্ত, তাদের আর্থিক খাত ও স্বাস্থ্য খাত বিপর্যস্ত, সেখানে বাংলাদেশে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অর্থনীতির চাকা সচল ছিল, স্বাস্থ্য খাতও ভেঙে পড়েনি। একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি হাসপাতাল। ”

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মৃত্যুর হার অনেক কম, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে, সবাই মাস্ক পরে চললে সেটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, কম সংক্রমণ হবে। ”

জাহিদ মালেক বলেন, “সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারব, স্বাস্থ্যসেবায় আমাদের কোনো লকডাউন হয়নি। সবই খোলা রয়েছে। করোনার সময় কমিউনিটি ক্লিনিকে ডেলিভারি বেশি হয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ঠিক রাখতে হবে। মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনতে হবে। তাহলেই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। ”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, “বসুন্ধরা গ্রুপ এগিয়ে এলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় বড় প্রভাব পড়বে। বসুন্ধরা একটি বড় গ্রুপ। এ গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ১০০ কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিতে পারেন। তিনি কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিরাট অবদান রেখেছেন, কোভিড-১৯ হাসপাতাল করে দিয়েছেন, সেখানে সব আয় বাদ দিয়ে মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন— এটা বিরাট মনের পরিচয়। ”

কালের কণ্ঠ সম্পাদক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন

তিনি বলেন, “কমিউনিটি ক্লিনিকের কারণে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপ কমিউনিটি ক্লিনিকে বড় অবদান রাখতে পারে। আশা করি, তারা সেটা করে দেবেন। ”

ডা. দ্বীন মোহাম্মদ আরও বলেন, “স্বাস্থ্যসেবা মানুষের অধিকার, এটা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। এটা এখন প্রয়োজনীয় অগ্রাধিকার। সারা বিশ্বের মানুষ স্বীকার করে শেখ হাসিনার স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য। কিন্তু যারা বিরোধিতা করে, শুধু বিরোধিতার জন্য, কিন্তু তারা মনে মনে স্বীকার করে নিচ্ছে শেখ হাসিনার সাফল্যের কথা। ”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, “সরকার প্রচুর হাসপাতাল তৈরি করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যে দুটি শাখা রয়েছে, সেখানে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা শাখা, একটা মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক অধ্যক্ষের অধীনে থাকেন। যদিও তিনি হাসপাতালের প্রশাসনিক প্রধান। এই যে সমস্যা, এটা সমাধান করতে হবে। দুটি সেক্টরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। ”

ডা. দ্বীন মোহাম্মদ আরও বলেন, “স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বাড়ছে। মন্ত্রণালয়ে লাইন ডিরেক্টর রয়েছে। একটা লাইন ডিরেক্টরের ১০ কোটি টাকার কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে। একজন সচিবের ৫০ কোটি টাকার কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এজন্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অনুমোদন নিতে হয় না। তাদের একটা আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে। এই যে ক্ষমতা এখানে দুর্নীতির আখড়া। মন্ত্রণালয় না চাইলে ডিজির পক্ষে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়, এটা দিবালোকের মতো সত্য। এই যে আর্থিক ক্ষমতা, এটার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে। কারণ, একজন লাইন ডিরেক্টর ১০ কোটি টাকার কাজ করাতে পারছে কারো অনুমতি ছাড়াই। এতে দুর্নীতির সুযোগ বাড়ছে। ”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ

গোলটেবিল বৈঠকে কালের কণ্ঠ সম্পাদক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, “আমরা যারা শহরে যারা বাস করি, উচ্চবিত্তরা উচ্চ স্বাস্থ্যসেবা পাই।  কিন্তু যারা গ্রামে বাস করে তারা সেই অর্থে স্বাস্থ্যসেবা পায় না। আমরা যদি গ্রামের নিম্নবিত্ত যারা, তাদের স্বাস্থ্যসেবার কথা ভাবি, সেটা বাস্তবায়ন করি, তাহলে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে। নিম্ন আয়ের ও প্রতিবন্ধী যারা তাদের কথা ভাবতে হবে। যদি দেশকে বড় জায়গায় এগিয়ে নেওয়ার কথা ভাবি, তাহলে এই শ্রেণির মানুষের কথা ভাবতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হলে একটা দেশ বড় জায়গায় পৌঁছে। ”

তিনি আরও বলেন, “বসুন্ধরা গ্রুপের মূল স্লোগান ‘দেশ ও মানুষের কল্যাণে’। অনেক কিছু করেছে এই গ্রুপ। দেশের সবচেয়ে বড় মিডিয়া হাউস ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড। তিনটি দৈনিক পত্রিকা রয়েছে, দুটি টিভি রয়েছে। নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজ ও রেডিও ক্যাপিটাল রয়েছে। বসুন্ধরা আই হসপিটালে প্রায় বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হচ্ছে। বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে বসুন্ধরা মেডিক্যাল কলেজে সর্বনিম্ন খরচে সেবা দেওয়া হচ্ছে। যেখানে ছাত্র ভর্তি মাত্র ৫ লাখ টাকা। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বেশ কয়েকটি হাসপাতাল তৈরিরও কাজ করছেন। কেরাণীগঞ্জে প্রতিবন্ধী স্কুল পরিচালনা করছে বসুন্ধরা গ্রুপ। বাঞ্ছারামপুরে প্রায় দেড়লাখ মানুষকে ইন্টারেস্ট ছাড়া জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া হয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপ মানুষের জন্য কাজ করছে। ”

ন্যাশনাল আই কেয়ারের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, “প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে কমিউনিটি ক্লিনিকের বিকল্প নেই। যতক্ষণ না প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবার অধীনে না আসবে ততক্ষণ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে না। ”

অরবিস ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. মুনির আহমেদ বলেন, “আগামী ৩০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে কী লাগবে, সেটা আমরা জানি না। যে উন্নয়ন হচ্ছে, সেটা পরিকল্পনামাফিক হতে হবে। যদি সেটা আমরা করতে না পারি তাহলে সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে না। স্বাস্থ্য খাতে যোগ্য লিডারশিপের প্রয়োজন। যাদের নেতৃত্বে এ খাত এগিয়ে যাবে। ”

সাইটসেভার্স বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর অমৃতা রেজিনা রোজারিও বলেন, “টেকসই উন্নয়ন করতে সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার কথা ভাবিয়ে তুলেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার তিন নম্বর বিষয়টি অর্জন করতে হলে এটার বিকল্প নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করলে টেকসই উন্নয়ন হবে। ”

সাইটসেভার্স বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার সৈয়দা আসমা রাশিদা

সাইটসেভার্স বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার সৈয়দা আসমা রাশিদা বলেন, “পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনলেই বলা যাবে, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয়েছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার তিন নম্বর বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্য ও সুস্বাস্থ্য। সরকার ২০৩০ সালের যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা অর্জন করতে হলে অবশ্যই নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সমন্বয় করে কাজ করলে এই জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। ”

জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক জাহিদুল হাসান বলেন, “সরকারের একার পক্ষে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত সম্ভব নয়। এজন্য দেশের সামর্থ্যবান মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার জন্য কাজ করছে। সরকারের অন্য মন্ত্রণালয়ও বসে নেই। সবাই জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করে চলছে। ”

সিবিএম অ্যান্ড আইএনজিও চেয়ারের কান্ট্রি ডিরেক্টর মুহাম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা বলেন, “কমিউনিটি ক্লিনিকে যদি সবাইকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে হয় তাহলে ইনফরমেশন স্কিল ডেভেলপ করতে হবে। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে ইনফরমেশন বেইজড করতে হবে। শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। মোবাইল পদ্ধতির অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করতে হবে। যারা প্রতিবন্ধী তাদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। ”

গোলটেবিলে অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন সাইটসেভার্স বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার অয়ন দেবনাথ, হ্যান্ডিকাপ ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি অপারেশনাল কো-অর্ডিনেটর মো. মাজেদুল হক প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২০
টিএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।