ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

এক্সপি’তে আক্রান্ত ‘রাতের শিশু’

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৬
এক্সপি’তে আক্রান্ত ‘রাতের শিশু’

ঢাকা: জেরোডার্মা পিগমেন্টোসাম (সংক্ষেপে এক্সপি) নামে দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত ১২ বছরের শ্রাবণী জামান তূর্ণা ও ৮ বছরের মোনিম উজ্জামান খান। সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি এমনকি তীব্র আলোও ভয়ঙ্কর এই দুই ভাই-বোনের জন্যে।

 

অতি ক্ষুদ্র আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিও এই শিশুদের সংবেদনশীল ত্বককে আক্রান্ত করে নিমিষেই। আর তাইতো এদের বলা হয়ে থাকে ‘রাতের শিশু’।

 

পৃথিবীতে এ ধরনের শিশুর সংখ্যা খু্ব বেশি নয়।

ইস্ট-ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. জামালউদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করছেন এই শিশুদের।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পুরোপুরি রোদ থেকে রক্ষা করতে পারলে এই শিশুরা ৪০ বছরেরও বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারবে। তাদের পুরো জীবনটাই সূর্যের আলো প্রতিরোধক পরিবেশে বাঁচতে হবে। সকাল আটটা থেকে দুপুর ২টার সূর্যের আলো বিশেষভাবে প্রতিরোধ করতে হয়।

তিনি বলেন, জন্মগতভাবে এ শিশুদের ত্বকে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি প্রতিরোধের জন্যে প্রয়োজনীয় এনজাইমের অনুপস্থিতি রয়েছে। তাদের ত্বক রোদের আলো সহ্য করতে পারে না এবং কালো হয়ে যেতে থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি বাড়তে থাকে। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির কারণে তাদের এপিডার্মাল সেলের ডিএনএ ধ্বংস হতে থাকে।
 
ডা. জামাল জানান, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর মিলিয়ে এ ধরনের ৭ জন শিশু রোগীকে দেখেছেন তিনি। রোগটি পুরোপুরি সেরে উঠবে না। তবে সূর্যের আলো প্রতিরোধক ব্যবস্থায় রেখে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে।

অন্য সবার মতো ত্বক নয় এ শিশুদের। বাসায় আত্মীয়-স্বজনদের শিশুরা এলেও তাদের সঙ্গে মিশতে চায় না। মোনিম খেলনা নিয়ে এগিয়ে গেলেও দূরে চলে যায় ওর বন্ধুরা। আবার বড়রাও প্রশ্ন করে বসেন, ‘বাবা কোন ক্লাসে পড়ো?’ জবাব দিতে পারে না শিশুরা।

এখনো স্কুলে যায় না মোনিম। আর অনেক অনুরোধের পর বাসার পাশের একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে তূর্ণাকে। পুরো শরীর কাপড়ে মুড়িয়ে মাসে এক বা দু’দিন স্কুলে যায় সে। সেখানে তাকে বসতে দেওয়া হয় আলাদা বেঞ্চে।

দুই শিশুর বাবা তারেক উজ্জামান খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘রোগটি কোনো ছোঁয়াচে নয়। অনেক স্কুলের অনেক অধ্যক্ষকে অনুরোধের পর বাসার পাশের একটি স্কুল ভর্তি নেয় মেয়েকে। কিন্তু ওর কাছ থেকে দূরে থাকে সহপাঠীরা’।

তিনি বলেন, ‘মেয়ে বড় হচ্ছিল। বলতো, বাবা স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে। আসলে ওই বয়সে শিশুদের ইচ্ছে থাকে অনেক। আমি অনেক স্কুলে যাই ওকে ভর্তি করাতে। এ স্কুলেও প্রথমে কেউ নিতে চাচ্ছিলেন না। আমি কান্নাকাটি করে শিক্ষকদের রাজি করিয়েছি’।

দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় কাজ করছেন তারেক। আর স্ত্রী লতিফা আক্তার মনি স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করেন।

চিকিৎসকরা বলেছেন, জেরোডার্মা পেগমেন্টোসা জিনগত বৈশিষ্ট্যের ফলে সৃষ্ট রোগ। তারেক বলেন, ‘আমাদের দু’জনের পরিবারের কারো মধ্যেই এ রোগ নেই’।

২০০৪ সালে জন্ম তূর্ণার। দেড় বছরের মাথায় ধরা পড়ে বিভীষিকাময় এই রোগ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে ভারতের মাদ্রাজের বড় বড় চিকিৎসকদের কাছেও বাবা-মা নিয়ে গেছেন শিশুটিকে। সবাই একই কথা বলেছেন, রোগ থেকে মুক্তি মিলবে না। সূর্যের আলো প্রতিরোধক ব্যবস্থা করে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

এক সময় চোখের সমস্যা ধরা পড়ে। রক্তলাল হতে থাকে তূর্ণার চোখ। দেখে মনে হচ্ছিল, চোখের পাতা গলে পড়ছে। লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে দেশের বড় চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হন।

৪ বছর পর ২০০৮ সালে দ্বিতীয় সন্তান নেন তারেক-লতিফা দম্পতি। মোনিমও জন্ম নেয় একই বিভীষিকাময় রোগ নিয়েই। এরপর থেকে দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত সন্তানদের নিয়ে শুরু হয় আরো বেশি কষ্টের যাত্রা।

তূর্ণার মতো মোনিমের চোখও আক্রান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে তূর্নার চোখে দু’বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে ভারতে নিয়ে। মোনিমের চোখেও প্রয়োজন অস্ত্রোপচারের।

এখন দুই শিশুরই ত্বকের চিকিৎসক একজন, চোখের চিকিৎসকও একজনই। একসঙ্গেই চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে যেতে হয় তাদের।

মোনিমকে স্কুলে দেননি বাবা। বরং নিজেই কিছু পড়াশোনা শেখানোর চেষ্টা করছেন। বলেন, ‘বাসায় শিক্ষক রেখে পড়াতেও বড় খরচ বহন করতে হয়। ওদের জীবন এখন টেলিভিশনের কার্টুন আর কমিকস বইয়ে বন্দি। সন্ধ্যার পর আমি কখনো কখনো বাসার আশেপাশে নিয়ে হেঁটে বেড়াই’।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম থেকে শুরু করে ভারতের শ্রীরামচন্দ্র মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, শংকর নেত্রালয় পর্যন্ত সন্তানদের নিয়ে দৌঁড়েছেন এই বাবা-মা। গত সাড়ে ১০ বছর ধরে চালানোর পর সন্তানদের চিকিৎসার ব্যয় এখন অনেক ভারি হয়ে উঠেছে তারেকের কাছে।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘নিজের সন্তানতো। ফেলেতো দিতে পারি না। বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পুরো বাসাকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করে রাতের মতো পরিবেশ তৈরি করে রাখতে হয়। তূর্ণার চোখে আরেকটা অপারেশন করতে হবে। এখন থেরাপি দিয়ে যতোটা সম্ভব ভালো রাখা যাচ্ছে। মোনিমেরও অস্ত্রোপচার প্রয়োজন’।

উত্তরা ১০নং সেক্টরের বাসায় চোখে সানগ্লাস পরেই থাকে দুই শিশু। চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি ভাড়া করে, পুরো শরীর কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের।

তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকদের পরামর্শ মতে, ওদের বসবাসবান্ধব পুরোপুরি একটা ঘর তৈরি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভাড়া বাসায় থাকি, আজ এখানে তো কাল ওখানে। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে যতোটুকু জেনেছি, সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি থেকে দূরে রাখতে হবে আমাদের সন্তানদের। ঘরের বৈদ্যুতিক বাতিগুলোও হতে হবে ওদের উপযোগী। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এগুলো আমার সাধ্যের বাইরে। নিজের একটা ফ্ল্যাট, সেটাকে অতি বেগুনি রশ্মিরোধক করা, ঘরে উন্নত বাতি লাগানো, এগুলো আমার পক্ষে সম্ভব না’।

‘এমনিতেই দুই সন্তানের চিকিৎসা বাবদ প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে আমাদের। টাকার অভাবে ছেলেটার চোখের অপারেশনও করাতে পারছি না। আপাতত ওদের চোখের দু’টি ড্রপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছি। কারো কাছে হাত পাতবো, সেটাও সম্ভব হচ্ছে না’।

তূর্ণা ও মোনিমকে একটু সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্যের হাত বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। তাদের সর্ম্পকে জানতে যোগাযোগ করুন বাংলানিউজের সঙ্গে [email protected] এই ঠিকানায়।   তারেক উজ্জামানের ০১৭১২২৬৩৮৯৬ মোবাইল নম্বরেও যোগাযোগ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ০২৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৬
এমএন/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।