ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

ওষুধের দাম লাগামছাড়া, মানুষ জিম্মি

আবু তালহা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৭, ২০১২
ওষুধের দাম লাগামছাড়া, মানুষ জিম্মি

ঢাকা: মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে অত্যন্ত জরুরি বিভিন্ন ওষুধের দাম। সাধারণ কোনো অসুখ নিয়ে কোনোমতে ডাক্তারের কাছে যেতে পারলেও ফার্মেসিতে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

অথবা গেলেও দাম জিজ্ঞেস করার পর তা কেনার সামর্থ্য অনেকেরই থাকে না।

অনেকের ধার-দেনা করার সামর্থ্য থাকলেও নিম্নবিত্তদের রোগ চেপে রাখতে হয়। দীর্ঘদিন শরীরের রোগ পুষে রাখা ছাড়া উপায় থাকে না তাদের। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিম্নবিত্ত মানুষের অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। ।

ওষুধ প্রশাসনের ১১৭টি অত্যাবশকীয় ওষুধের একটি তালিকা রয়েছে। এর অন্তর্ভুক্ত সালবিউটামল গ্রুপের ব্রডিল, সালটলিন, ভেনটোলিন (ঠাণ্ডাজনিত রোগে দেওয়া হয়)। এ ওষুধের দাম ছিল ১৬ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ২৩ টাকায়। প্রায় ৪৩ শতাংশ দাম বেড়েছে।

প্রোপ্রানল হাইড্রোক্লোরাইড-ইন্ডেভার (হাইপার টেনশন বা অস্থিরতাজনিত রোগে দেওয়া হয়) ১০ মিলিগ্রাম (এমজি) ১০০টির বক্স বিক্রি হতো ২৪ টাকায়, এখন বিক্রি হচ্ছে ৫১ টাকায় আর ৪০ এমজি ৩৪ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৬ টাকা।

স্কয়ার, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো, ইবনেসিনা কোম্পানির অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট (গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় ব্যবহার্য) ১০টির পাতা বিক্রি হতো ১০ টাকায়, এখন সেটা বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। মাঝখানে ১৫ টাকায় বিক্রি হলেও আবারও বেড়েছে।

স্কয়ারের অ্যান্টাসিড সিরাপের দাম ৫৫ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়।

পাশাপাশি একমি, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো এবং ইবনেসিনা কোম্পানির অ্যান্টাসিড সিরাপের দামও ৭৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

ব্যথার সমস্যায় ব্যবহার্য ডাই-ক্লোফেনাক, কিটোরোলাক, আইবোপ্রফেন গ্রুপের ওষুধের (ইটোরিক্স, ইটো, নো-পেইন, কলিকন, বুটাপেইন, রোলাক) দাম প্রতিটি কোম্পানিই বড়িয়েছে এক টাকা করে।

ক্যালসিয়াম ক্যাপসুলের দাম ৪২০ টাকা থেকে একমাসের ব্যবধানে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। আবার একই ওষুধ চীনা কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। দোকানিদের কাছ থেকেই এতথ্য জানা গেছে।

নভো-নর্ডিকস কোম্পানির ইনসুলিনের (ডায়াবেটিসের জন্য) দাম ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এখন বিক্রি করা  হচ্ছে ১০০ টাকায়।

এছাড়া স্কয়ার, বেক্সিমকো, পপুলার, ইনসেপ্টা, এরিস্টোফার্মা, এসিআই কোম্পানির ইনসুলিনের (১০০ আইও) দাম নেওয়া হচ্ছে ৪১৫ টাকা।

ফার্মাসিস্ট ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধনীতির তোয়াক্কা না করে দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। নিত্য ব্যবহার্য ওষুধ পর্যন্ত চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মৌলিক চহিদা থেকেই বঞ্চিত তারা।

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি কাজী ফারুক বলেন, “ওষুধশিল্পে নৈরাজ্য চলছে। যেমন দুই টাকা দামের হিস্টাসিন ট্যাবলেট এখন বিক্রি হচ্ছে পাঁচ টাকায়। তেমনি দুই টাকার রিবোফ্লবিন বিক্রি হচ্ছে পাঁচ টাকায়। দাম বেড়েছে ১৫০ শতাংশ। ”

তিনি বলেন, “আমরা অনেক চেষ্টা করেও ওষুধ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারিনি। এমনকি এই প্রশাসনের আওতায় দুটি কমিটির মিটিং নিয়মিত হয় না। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ ওষুধ কিনতে না পেরে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাবে। ”

ক্যাব সভাপতি বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো অনেক প্রতিবাদ করে আমরা বিদেশি কোম্পানিগুলোকে তাড়িয়েছিলাম, দেশি কোম্পানিগুলোর বিকাশের স্বার্থে। সাধারণ মানুষ কম দামে ওষুধ পাবে এটা ভেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো সেই বিদেশিদের জায়গাই দখল করে বসল। ”

এদিকে, ওষুধ প্র্রশাসনের মতে, যে কয়টি ওষুধের দাম বেড়েছে সেগুলো কোনভাবেই ১৮০০ জেনেরিক বা ২১ হাজার ব্রান্ডের  ৫ শতাংশের বেশি নয়। ২১ হাজার ব্রান্ড ৫ শতাংশ ওষুধের সংখ্যা হলো ১০৫০টি।

আবার কোনো কোনো ওষুধ কোম্পানি দাবি করে, খুচরা বিক্রেতারা ওষুধের দাম বেশি রাখে।

তবে মোহাম্মদপুর আলম ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা ও ফার্মাসিস্ট মোঃ খলিলুর রহমান বলেন, “খুচরা বিক্রেতাদের লাভ সীমিত, প্যাকেটের গায়ে যে দাম লেখা থাকে তার চেয়ে বেশি আমরা নিতে পারি না। কোম্পানির কাছে আমরা কমিশন পাই ১৫ শতাংশ। আর পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে থেকে নিলে ১৩ শতাংশ। ”

সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে নতুন করে ওষুধনীতি প্রণয়নের অঙ্গীকার থাকলেও, সরকার ক্ষমতা আসার সাড়ে তিন বছরেও তা সম্ভব হয়নি। ফলে ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং ভেজাল ওষুধের প্রকোপে জনসাধারণের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেন, “সরকারের এখনো যেটুকু সময় আছে এর মধ্যেই ওষুধনীতি প্রণয়নের কাজ শেষ করে যাওয়া উচিত হবে। এটা কেবল আমাদের নির্বাচনী অঙ্গিকার নয়, দেশ ও মানুষের স্বার্থেই এটা করতে হবে। ”

২০০৫ সালের ওষুধনীতিতে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রথা বাতিল করায় কিছু দেশীয় কোম্পানির অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে।

দেশীয় ওষুধশিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও ওষুধনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়নি।  তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য সুলভ মূল্যে গুণগতমানসম্পন্ন ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ।

১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্বাহী আদেশে ১১৭টি অত্যাবশকীয় ওষুধের (কন্ট্রোলড ড্রাগ) মূল্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর নির্ধারণ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। জনস্বার্থে এসব ওষুধ কোম্পানি উৎপাদন ও বাজারজাত করতে বাধ্য থাকবে বলেও আদেশে বলা হয়। বাস্তবতা হলো ১১৭টি ওষুধের প্রায় অর্ধেকই এখন আর উৎপাদিত হয় না।

সরকারের পক্ষ থেকে অত্যাবশকীয় ওষুধের চাহিদা পূরণ হয়েছে বলা হলেও শহর ও গ্রামাঞ্চলের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর চেহারা বিপরীত সাক্ষ্যই দেয়।

একাধিক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাকেন্দ্র ও থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে গড়ে ৫০ শতাংশের বেশি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধেরই কোনো সরবরাহ থাকে না।

বাংলাদেশ সময়: ১২০২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১২
এটি/এআর/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।