ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

গল্প

প্যারিসে ঘুরে বেড়ানো/পর্ব-২

বাস্তিল ডে’র বিভ্রান্ত অভিসার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০১৭
বাস্তিল ডে’র বিভ্রান্ত অভিসার প্যারিসে ঘুরে বেড়ানো

বাস্তিল ডে’র বিভ্রান্ত অভিসার
পর্ব-২

আমরা আবার সাঁজেলিজের সরনিতে পায়চারি করি। আমাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে একজন মানুষ ভারী মিষ্টি হেসে  ‘হ্যালো’ বলেন।

তার বুকে বাঁধা হারনেস থেকে উঁকি দিচ্ছে ধবধবে সাদা পশমের তুলতুলে একটি ল্যাপডগ। ছোট্ট এ কুকুরটিকে এতো কিউট দেখায় যে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। বয়সে প্রৌঢ় মানুষটি কাছে এসে খুব ইনভাইটিং ভাবে বলে, ‘ মঁশিয়ে, আমার ছোট্ট ডগটির নাম ডেইজি বু-বু, স্বভাবে সে খুবই সামাজিক। তুমি চাইলে তার তার পশম স্পর্শ করে আদর করতে পারো। ’ আমি কুকুরটির উলগুটির মতো লোমে হাত বুলিয়ে ক্যামেরার দিকে ইশারা করলে তিনি মৃদু হেসে বলেন,  ‘নো প্রবলেম। ইউ মে টেক আ পিকচার। ’ ডেইজি বু-বু’র ছবি-টবি তুলে ভদ্রলোককে জোরালো রকমের ধন্যবাদ দিয়ে আমরা আবার ফিরে যাই বিজয় তোরণের দিকে। বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে আমি এক্সাইটেডভাবে ম্যানুয়েলকে বলি,  ‘ আমার ধারণা এ কুত্তা ক্যারি করা লোকটি হচ্ছে সিক্রেট সার্ভিসের গুপ্ত ওয়াচার। ’ সে আমার পর্যবেক্ষণের প্রশংসা করে বলে, ‘ইউ আর ড্যাম রাইট। ’
আমি এবার জানতে চাই,‘ম্যানুয়েল, তুমি এত শিওর হচ্ছো কীভাবে। ’
সে পেশাদারি ভঙ্গিতে হেসে জবাব দেয়,‘ লিসেন বাডি, তোমার অরিজিন ভারতবর্ষে হলেও তুমি দেখতে অনেকটা মধ্যপ্রাচ্য বা পারস্যের মানুষজনদের মতো। ওয়াচারদের কাজ হচ্ছে তোমার মতো চেহারার মানুষদের উপর নজরদারি করা। এই লোক কিন্তু ইনটেনশনালি তোমার কাছাকাছি হয়েছে। ডেইজি বু-বু হচ্ছে গন্ধ শুঁকে বোমা-বারুদের উৎস আবিষ্কারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর। তোমার জামাকাপড়ের তলায় খতরনাক কোনো এক্সপ্লোসিভ লুকানো থাকলে সে আওয়াজ করে তার হ্যান্ডলারকে সতর্ক করে দিতো। ’
আকাশে জঙ্গিবিমানের ফর্মেশন
ম্যানুয়েল স্পষ্টত অধীর হয়ে আছে। তার চোখে ঝড়ো মেঘের মতো জমছে প্রতীক্ষার স্ট্রেস। সে আমার দিকে এক শলা সিগারিলো অফার করে বাতাস বাঁচিয়ে তাতে আগুন দেয়। তখনই সরনির অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে শরীর-মন চনমন করে ওঠা বাদ্য-বাজনা। পর্যটকরা ওদিকে তাক করে ট্রাইপডে বসানো ভারী সব ক্যামেরা। এয়ারফোর্স ব্যান্ডের বাদ্য যেন পাঁজরে সৃষ্টি করছে খরস্রোতা নদী সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার উদ্যম। পুরুষদের কেউ কেউ তাদের নারীসঙ্গীর কোমর এক হাতে পেঁচিয়ে নেচে ওঠে। আমাদের সামনে কিস্তলী চুলের এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী তার অর্ধউন্মোচিত স্তনে দারুণ দোল তুলে খানিক কাঁধ ঝাঁকায়। দর্শকদের কেউ কেউ তার দিকে ফিরে মুখে আঙুল দিয়ে শিস দিলে তার ডান্সে চলে আসে আফ্রো-ক্যারিবিয়ান জোশ। খুব সুচারু ভঙ্গিতে বঙ্কিম হতে থাকে তার শরীর। ঠিক খেয়াল করিনি কখন যে যুবতীটি মুখে পরে নিয়েছে কুমিরের মুখোশ। এখন তার হাতের মুদ্রায় তৈরি হচ্ছে বুকে হেঁটে বেজায় ক্ষুধার্ত এক কুমীরের নদীর ঢালু পাড় বেয়ে চরে উঠে পড়ার দৃশ্যপট। তার দোদুল্যমান শরীরে পথচারী দর্শকদের দৃষ্টি যেন শিলাবৃষ্টির মতো ঝরে।

এয়ারফোর্সের ব্যান্ড চলে আসে আমাদের খুব কাছে। এরা ফরাসি বিপ্লবের ধ্রুপদী কোনো সিম্ফনি জমিয়ে বাজাচ্ছে। দর্শকরা দু’পাশে সরে দাঁড়িয়ে তাদের কুচকাওয়াজের সুযোগ করে দেয়। বাজনাওয়ালাদের সামনে মার্চ করছে তরুণ ক্যাডেটদের একটি চৌকস দল। তাদের সাদা গ্লাভস্ পরা হাতের কব্জিতে বসা একটি করে ঈগল পাখি। বাদ্যবাজনার সুর-লয়ে বিশাল খেচরগুলো ডানা ঝাপটিয়ে বজায় রাখছে তাল-মান। ম্যানুয়েল জ্বলন্ত সিগারিলো হাতে টেলিফোনে কথা বলতে বলতে ভিড়ে বাউলি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। ফাৎনায় টান পড়লে বড়শি বাওয়া মানুষের চোখেমুখে যে রকম ছড়ায় উদ্দীপনা, সে রকম আগ্রহ নিয়ে ম্যানুয়েল স্ক্যান করছে ভিড়ের তাবৎ কিছু। গাছপালার ছায়াতল থেকে বেরিয়ে আসতেই চোখ চলে যায় আকাশে। উড়ে আসে এগারোটি জঙ্গিবিমানের নজরকাড়া ফর্মেশন। তাদের লেজের ধোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে ফরাসি পতাকার গোলাপি-নীল বর্ণবিভা।
চাঁদতারা ঝাণ্ডা হাতে আলজিরিও ট্রুপ
আকাশে উড়ে আসছে একটার পর একটা ধীরগতি প্রপেলার প্লেন। মাথার ওপরে ডিসপ্লে হচ্ছে গেলো একশো বছরে বিবর্তিত হওয়া নানাবিধ বিমানের মডেল। ম্যানুয়েল এক্সাইটেডভাবে আমার কাঁধে চাটি মেরে বলে, ‘ম্যান, আগাথা ইজ হিয়ার। কিন্ত তাকে স্পট করতে পারছি না। ’ সে আইফোনের স্ক্রিনে তার ছবিতে ইঙ্গিত করে বলে,‘বাডি, পে অ্যাটেনশন, লুক ফর হার। ’ আকাশে নিচু হয়ে উড়ে আসা জঙ্গিবিমানগুলোর মডেল থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারি না। ম্যানুয়েল আবার কনুই এর খোঁচা দেয়। এবার ভালো করে দেখে না নিলে অ্যান্টিক ক্যাটাগরির এ বিমানগুলোকে আর কখনো উড্ডীন হালতে দেখার মওকাও আসবে না। এদিকে আমার সুহৃদ তাড়া দিচ্ছে অভিসারে আসা তার উদ্দীষ্ট নারীকে স্পট করার। ঠিক বুঝতে পারি না কুল বজায় রাখবো, নাকি শ্যামকে তুষ্ট করাই এ মুহূর্তে অধিক জরুরি।

আগাথার তালাশে চারদিকে বোবা দৃষ্টিতে ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছি, হঠাৎ করে বোশেখী ঝড়ে গাছ থকে ঝরে পড়া নারকেলের মতো দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ব্যবহৃত একটি যুদ্ধবিমান থেকে চারদিকে ছিটকে পড়ে কয়েকজন প্যারাট্রুপার। দর্শকরা উল্লাসে হাততালি দেয়। তখনই খেয়াল করি ম্যানুয়েল অত্যন্ত আদরে এক নারীর কোঁকড়া চুল সরিয়ে দিয়ে কনিয়াকের গ্লাস আলোয় তুলে ধরার মতো তার পানপাতা শেইপের মুখখানা তার দিকে তুলে ধরে গাঢ়ভাবে অবলোকন করছে। সে মৃদুস্বরে আগাথাকে কিছু বলছে। দর্শকদের কোলাহলে আমি তেমন কিছু শুনতে পাই না। তবে ম্যানুয়েল তার ঠোঁটে চুমো খেলে আগাথা তার সুঠাম বুকে নিজেকে সমর্পণ করে। ম্যানুয়েলের হাত তার কোমর পেচিয়ে অনুভব করছে নারীটির শরীর। খিলখিল হেসে আগাথা তার বুক থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলে, সে তার নিতম্বে মৃদু চাটি মেরে বলে,‘হানিসাকোল, ইউ আর ওয়ে সেক্সিআর দ্যান হোয়াট আই স ইন ইয়োর পিকচারস্। ’ আগাথা চোখেমুখে শরমের কৃত্রিম ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলে বলে,‘থ্যাংক ইউ সো মাচ ম্যানুয়েল ফর ফাইন্ডিং টাইম ফর মি ইন আ শর্ট নোটিশ। ’
শহরে ঢোকার মুখ
কথাবার্তায় দুজনে মগ্ন হয়ে আছে মৃদুভাবে। এ সুযোগে আমি গ্রিক দেশের পরনারীটিকে পর্যবেক্ষণ করি ব্যাপকভাবে। অরগানজা মেটেরিয়েলে তৈরি তার স্কার্টে ভিনটেজ অনুপ্রাণিত ডিজাইনটি স্পষ্টত সুরুচির পরিচয়বাহী। একটু ঘুরে দাঁড়ালে আমি আগাথাকে সামনে থেকে সরাসরি দেখি। তার দৈহিক গঠনে প্রথম দৃষ্টিতে চোখে পড়ার মতো এমন কিছু নেই। তবে হালফ্যাশনের লিবার্টি টাই নেকের টপ পরে এসেছে বলে বুকের বিঘত অনাবৃতিতে ছড়াচ্ছে নারীশোভন মমতা। আমাকে খেয়াল করে দেখে আগাথা তার দৃষ্টি ম্যানুয়েলের দিকে আবার ফেরালে আমি মনে মনে এ মানবীর বয়সের মানসাঙ্ক কষি। সে আহ্লাদি ভঙ্গিতে একটু কাঁধ ঝাঁকায়। তাতে বেলাশেষের গোধূলি আভায় কাঁপে ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে আসা যৌবন। সে আবার গ্রীবা বাঁকালে ম্যানুয়েল আমাকে ‘রাইটার’ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি ঝাঁকাঝাঁকির প্রত্যাশায় হাত বাড়ালে সে তা ধরে থাকে একটুক্ষণ। তখনই অনুভব করি, শি লুকস্ আ বিট অনইউজ্যুয়েল। তার আসাধারণ চোখের বর্ণকে ইংরেজিতে বলা হয় ফরেস্ট গ্রিন। তা যেন স্থির হয় না কোথাও। সে আমাকে অবলোকন করতে করতে আবার আকাশে উড়ে আসা বিমানের দিকে চোখ ফেরালে আমি মনে মনে ভাবি, হোয়াই হার আইজ আর ওয়ান্ডারিং অ্যারাউন্ড ইন অল ডিরেকশনস?

মৃদু চাপে আমার হাতে অন্তরঙ্গতার পরশ ছড়িয়ে দিয়ে সে জানতে চায়,‘ সো, টেল মি রাইটার, হোয়ার আর ইউ ফ্রম?’ আমি জবাব দেই,‘সিয়েরা লেওন। ’ ‘তুমি কী সাথে করে তোমার বই বা আর্টিকেল নিয়ে এসেছো? আমাকে একটু পড়ে শোনাবে?’ আমি বিব্রত হয়ে জবাব দেই,‘ নট রিয়েলি। ’ এতে নিরুৎসাহিত না হয়ে সে বলে,‘ইউ লুক লাইক মোর অব আ পোয়েট। ’ প্রতিক্রিয়ায় আমি নীরব থাকলে সে আমার ফতুয়ার রেশমী নকশায় আংগুল বুলিয়ে বলে,‘প্রিন্স অব পার্সিয়া ফিল্মে অভিনয় করা ছোটখাট এক চরিত্র, কী যেন তার নাম, ভুলে গেছি, তার মতো চমৎকার একটি জামা পরে এসেছো, নেভার সিন আ ম্যান ওয়ারিং সাচ আ অরনেট শাইনি শার্ট। ’ আমি নিশ্চুপ থাকলে সে ম্যানুয়েলের দিকে ফিরে জানতে চায়,‘ক্যান আই কিস ইয়োর ফ্রেন্ড?’ সে উদার হেসে জবাব দেয়,‘অফকোর্স, অ্যান্ড ইফ ইউ ওয়ান্ট ইউ ক্যান প্লে হিম অ্যাজওয়েল। ’

আগাথা তার দিকে তাকিয়ে রিয়্যাক্ট করে,‘ আই অ্যাম নট ইন আ মুড ফর ত্রি-সাম। ’ ম্যানুয়েল বোধ করি তাকে যাচাই করার জন্য বলে,‘ হোয়াই নট, হি সিমস অ্যাবাইলেবল। ’ আগাথার কথায় এবার ফুটে ওঠে ব্যক্তিত্ব। সে একটু ঝাঁঝিয়ে জবাব দেয়,‘হি ইজ নট দ্যাট কাইন্ড, এ লোক মেয়েদের প্রেমে পড়ে দ্রুত, সম্পর্কে সিরিয়াস হয়, বাট নট রিয়েলি আ প্লে টাইপ। ’ ম্যানুয়েল তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলে,‘হাউ ডু ইউ নো দিস?’ আগাথা তার কথার জবাব না দিয়ে আমার খুব কাছে বলে,‘হাউ অ্যাবাউট আ কিস?’ আমি তাকাতেই এক পাশ থেকে তার প্রোফাইল চোখে পড়ে, আর মনে হয় এ নারীটি এ মুহূর্তে খুব বিপন্ন। তাকে ভালোবাসা যায় তীব্রভাবে। আমি তার রুপালি অলকচূর্ণের নিচে আলতো করে চুমো খাই। সে কিসব্যাক করে আমার গণ্ডদেশে ঠোঁট ছুঁইয়ে।
সৈনিকদের কব্জিতে বসা ঈগল
আকাশে যুদ্ধবিমানগুলো আঁকছে বিচিত্র নকশা। আগাথা ফিরে গেছে ম্যানুয়েলের বাহুবন্ধনে। সে তার পেশীবহুল দু’হাত টেনে এনে তার কোমর জড়ানোর সুযোগ করে দিয়ে বলে, ‘আজকের সময়টা আমি বরাদ্ধ রেখেছি সাবমেরিনের গানারের জন্য। কিন্তু তোমাকে ইগনোর করতে চাই না রাইটার। ডু ইউ মাইন্ড গিভিং মি সাম অব ইয়োর স্পেসাস্ টাইম? আই অ্যাম আসকিং ইউ অনেস্টলি..,’ আমি জবাবে বলি,‘হাউ অ্যাবাউট টু সে গুডবাই টু ইচ আদার নাও।
 
আমি হোটেলে ফিরে যাই, তুমি ম্যানুয়েলের সাথে সময়টা উপভোগ করো। ’ ম্যানুয়েল কিছু বলতে চায়, কিন্তু ব্যক্তিত্বময় ভঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দিয়ে আগাথা আমার চোখে চোখ রেখে বলে,‘ইউ লুক হ্যাংরি, সো অ্যাম আই। চল না আমাদের সাথে?  একসাথে লাঞ্চ করবো। কফি আফটারওয়ার্ডস্। পারহেপ্স আ গ্লাস অব কনিয়াক। প্লিজ বি মাই গেস্ট। তারপর তুমি না হয় ফিরে যেও হোটেলে। ’ ম্যানুয়েল ইশারায় আমাকে রাজি হতে ইঙ্গিত দিলে আমি ঘাড় হেলিয়ে সায় দিয়ে বলি,‘লেটস্ ফাইন্ড আ প্লেস টু ইট সামথিং। ’

চলবে...

যোগাযোগ

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১৭
এসএনএস/জেএম

আগের পর্ব পড়ুন-
** প্যারিসে ঘুরে বেড়ানো/পর্ব-১/বাস্তিল ডে’র বিভ্রান্ত অভিসার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ