ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

গল্প

অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-৩)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৬
অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-৩)

পাঁচ.
হোটেল স্নোফক্সের পিছন দিকটায় বেশ রোমান্টিক পরিবেশ। বিস্তর জায়গা জুড়ে রোজগার্ডেন।

গার্ডেনের চারিধারে সারি সারি দেবদারু গাছ। প্রতিটি গাছের নিচে একটা করে বেঞ্চি পাতা। প্রতিদিন বিকেল হলেই বহিরাঞ্চল থেকে আগত দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় জমে ওঠে। বসবার জায়গা পাওয়া যায় না। সমুদ্রও খুব কাছাকাছি। চলছে রোমহর্ষক হিমেল হাওয়া। তন্মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে মনের ঘরটার একটানা নিস্তব্ধতায় গভীর তন্ময় হয়ে ডুবে যায় অলকা। বিচরণ করে আপন ভুবনে। যেদিকে দু’চোখ যায় সর্বত্রই যেন এক অভিনব বৈচিত্র্যের সমাহার, অভিনবত্বের পসরা। যা দেখে সবই নতুন লাগে। সমগ্র পৃথিবীটাই যেন এক অভাবনীয় বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যে ঘেরা। অপূর্ব! ওর চোখেমুখে অপার বিস্ময়। এ এক অনবদ্য আনন্দ উপভোগ করার মতোই মনোরম দৃশ্য। যার চারিধারে এক বর্ণনাতীত ভালোলাগার উপাদানে আচ্ছাদিত এবং সমৃদ্ধ। খুবই আনন্দদায়ক, তৃপ্তিদায়ক। আর একটানা দেখতে দেখতে ভালোলাগার মুগ্ধতার আমেজ ছড়িয়ে পড়ে ওর দেহে মনে। আর সেই আত্মমুগ্ধতায় অভিভূত অলকাকে একেবারে চুম্বকের মতো আবিষ্ট করে রাখে। উন্মুক্ত অন্তর মেলে আস্বাদন করতে থাকে প্রকৃতির বিচিত্র রূপ। চারদিকে টুরিস্টদের ভিড়। অন্যদিকে সারি সারি দেবদারু গাছের আড়ালে যুগলবন্দী তরুণ-তরুণীদের জমিয়ে আড্ডা চলছে। সবাই আনন্দ উপভোগে মশগুল। সুপ্রিয়ও গার্ডেনে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে অলকার পাশেই বসেছিল। একসময় নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, কি ব্যাপার, এত কোয়াইট কেন? কিছু বলুন!

হঠাৎ সুপ্রিয়র কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙে অলকার। হেয়ালি মনে বলল, এ্যাঁ, কিছু বললেন?
- বলছি এতো কোয়াইট কেন? কথাবার্তা কিছু বলুন!
- আর কি, আমার কথা থাক, আপনি শোনান!
- আমার কথা শুনবেন! বলে মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেল সুপ্রিয়র। কিছুক্ষণ থেমে বলল, কি আর শুনবেন। বোরিং লাইফ। রূপ নেই, রঙ নেই। সুকান্ত ভট্টাচার্যের রানার কবিতার মুখপাত্রের মতো দায়-দায়িত্বের বোঝা কাঁধে চাপিয়ে চলছে একঘেঁয়ে জীবন।

কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে অলকা বলল, কেন, আপনার অভিভাবক, আই মিন, আপনার পিতৃদেব...!
- তাহলে আর বলছি কি! বাবা জীবিত থাকলে কি আমায় এতো চিন্তা-ভাবনা করতে হতো! টিনএজে বাবাকে হারিয়েই আমার জীবনে জটিলতা দেখা দেয়। বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে চারদিক থেকে বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি হয়। ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস শুরু হয়। প্রতিটি পদক্ষেপে সমস্যায় জড়িয়ে পড়ি। ভাই-বোনরাও তখন ছোট ছিল। একা মানুষ সামাল দিতে পারিনি। ব্যস আর কি, কলেজে পদার্পণ করতে না করতেই ইতি টানতে হলো। পড়াশোনা ছেড়ে বাবার রিপ্লেসে জয়েন করে সংসারের হাল ধরি। একটু মাথা তুলে দাঁড়াতেই নাইট কলেজ করার সুযোগ পাই। তারপরই ইকোনোমিক্সে মাস্টার্স করে বর্তমানে এখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে আছি। বড় বোনের বিয়ে দিয়েছি। এবার ছোটবোনের বিয়েটা সুসম্পন্ন করতে পারলেই আমার ডিউটি শেষ। ফিউচারে পিএইচডি করার ইচ্ছে আছে। দেখি কি হয়।
ফোঁস করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, সবই ভাগ্যের লিখন বুঝলেন, ঠেকাবার সাধ্য কার!
তৎক্ষণাৎই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলে, আচ্ছা, আপনার প্রেমিক বাবুর খবর কী? সে এখন কোথায়?

মুখখানা মুহূর্তেই বিবর্ণ হয়ে গেল অলকার। অভিযোগের সুরে বলল, প্লিজ সুপ্রিয় বাবু, ওই নাম আমার সম্মুখে উচ্চারণ করবেন না। দোহাই আপনার। ওর কোনো কথা আমায় জিজ্ঞেস করবেন না। প্লিজ্, ডোন্ট মাইন্ড। ফরগেট হিম।

অজান্তে কথাটা তুলে বিপাকে পড়ে যায় সুপ্রিয়। অস্বস্তিবোধ করে। ওর ধারণাই ছিল না যে, ক্ষণিকের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় একজন অচেনা অনাত্মীয়া মহিলার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সরাসরি এ ধরনের প্রশ্ন করলে সে যে কেউ হার্ট হতে পারে। সত্যিই আপত্তিজনক।

নীরবতা ভঙ্গ করে অলকা বলল, কাম অন সুপ্রিয় বাবু, লেটস স্টার্ট। কি যেন বলছিলাম!
অপরাধ স্বীকার করে সুপ্রিয় বলল, নো নো ইউ আর রাইট। ইট ইস ইওর পার্সোনাল ম্যাটার। এ বিষয়ে আমার ইন্টারফেয়ার করাটা মোটেই উচিৎ হয়নি। আই অ্যাম সরি!

এরই মধ্যে ঘটে যায় একটি বিভ্রান্তিকর ঘটনা। যা ক্ষণপূর্বেও কল্পনা করেনি। অনাকাঙ্ক্ষিত হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে একজন অল্পবয়স্ক মহিলার সাথে প্রশান্তকে নজরে পড়তেই মুহূর্তের মধ্যে মন-মানসিকতা বিষাদে ছেয়ে যায় অলকার। যাকে ওর মিলির মতোই লাগল। কিন্তু তাইবা কী করে সম্ভব! চোখ পাকিয়ে দেখতেই লোকের ভিড়ে মিলিয়ে গেল। ভাবল, ওর চোখের ভুল হয়তো। আর হলেও তাতে কিইবা এসে যায়। প্রশান্তর সাথে বহুদিন আগে থেকেই ওর কথাবার্তা বন্ধ, যোগাযোগ বন্ধ। কোনো রিলেশনই নেই। সব সম্পর্ক ছিন্ন করে এসেছে। মরুক গে। যা খুশি করুক! তবু মন থেকে কিছুতেই অপসারিত করতে পারে না। মিলিকে মনে পড়তেই ওর উচ্ছ্বসিত আনন্দে ভাটা পড়ে গেল। ওকে প্রচণ্ড ভাবিয়ে তুললো। সন্ধানী চোখে গার্ডেনের চারদিকে নজর বুলাতে থাকে। অস্থির হয়ে ওঠে। এইমাত্র দেখলাম গেল কোথায়? কোথাও নজরে পড়ছে না। নিশ্চয়ই দেখতে পেয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। মুখ দেখাবার রাস্তা নেই তাই লজ্জায় সরে পড়েছে। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়! এ চত্বরে ঘুরে আসতেই হবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মুখোমুখি দেখা। চমকে ওঠে অলকা। ওহ! মাই গড! হাউ ইস দিস পসিবল? এরা দুজনে কী করতে এসেছে এখানে?

মনের সন্দেহ যে কখনো বাস্তবে পরিণত হতে পারে তা ভাবতে পারেনি অলকা। নিজের চোখ দু’টোকে কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। ক্ষণপূর্বে যে মহিলাকে প্রশান্তর সাথে দেখেছিল সে আর অন্য কেউ নয় ওরই মামাতো বোন মিলি। দু’জনে হাত ধরাধরি করে পুর্ণোদ্যমে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে গার্ডেনের দিকেই আসছিল। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আচমকা প্রশান্ত আর মিলির আবির্ভাবে ওর সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো। স্বগতোক্তি করে ওঠে, ‘স্পর্ধার বলিহারি। কতবড় দুঃসাহস। তোর এতটুকু ডর ভয় নেই! তুই কেমন করে ওই শয়তানটার ফাঁদে পা দিলি! মামা-মামীর কথা একবার চিন্তা করলি না! মানুষ পেলি না তুই? এতবড় কলকাতা শহরে কি ছেলের অভাব? শৈলেন মামার মতো একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির মুখে চুনকালি ঘষে দিয়ে এ তুই কি করলি পোড়ামুখী!’
 
দাঁতে দাঁত চেপে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাতে থাকে অলকা। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে। খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। অপ্রস্তুত সুপ্রিয় তখন ওর চেহারার বিবর্তন লক্ষ্য করে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে হাঁ করে থাকে। ব্যাপারটা কিছুই বুঝলো না। কিছুক্ষণ থেমে বলল, হোয়াট হ্যাপেন্ড অলকা? আর ইউ ওকে?
ততক্ষণে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়েছে মিলি। কিন্তু প্রশান্তর কোনো বিকার নেই। প্রতিক্রিয়া নেই। মনে মনে হকচকিয়ে গেলেও তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে দিলো না। উল্টে বিদ্বেষে ভরে ওঠে। অলকার দিকে লক্ষ্য করে বলল, তুমিও এখানে! ভেবেছ কেউ জানবে না, অ্যাঁ! সঙ্গে কাকে ধরে নিয়ে ঘুরছো?

প্রশান্তর কথা শুনে লজ্জায় অপমানে ফেটে পড়ে অলকা। অ্যাম্ব্রেসিং ফিল করে। চেয়েছিল বিবেকবিহীন প্রশান্তকে উপেক্ষা করে অবিলম্বে স্থান পরিবর্তন করবে, রোজগার্ডেন থেকে বেরিয়ে আসবে। কোনোভাবেই ওর সাথে ইনভল্ব হবে না, সুপ্রিয়কেও ইনভল্ব হতে দেবে না। কিন্তু ভাবলেশ ও কাণ্ডজ্ঞানহীণ প্রশান্তর বেপরোয়া মনোভাব এবং দৃষ্টি ভঙ্গিমা লক্ষ্য করে ক্রোধ সম্বরণ করতে পারলো না। ধৈর্য্যচ্যুতি হয়ে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। অলকা চিৎকার করে ওঠে, ইতর, দুঃশ্চরিত্র, লম্পট, এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও বেহায়ার মতো কথা বলতে তোমার লজ্জা করছে না? তুমি মানুষ না জানোয়ার? কোথায় গেল তোমার জয়ন্তি, শর্মিষ্ঠা, সুচন্দ্রা? গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার! কোনদিনও আর মুখ দেখাবে না! শয়তান কোথাকার!

চটে যায় প্রশান্ত। বিকৃত মুখায়বে রূঢ় গলায় বলে ওঠে, তুমি কোন স্বতী-সাবিত্রী হয়েছ? গলাবাজি করছো! নিজেও তো সাথে নিয়ে ঘুরছো। কিছু বুঝি না মনে করেছ!

চিৎকার চেঁচামিচি শুনে রোজগার্ডেনের লোকজন সব ছুটে আসে। একে অন্যের দিকে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সুপ্রিয়ও এতক্ষণ বিমূঢ় ম্লান হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল কিন্তু ইন্ডায়রেক্ট ওকে ইনভল্ব করতেই ও গর্জন করে ওঠে-হোয়াট ননসেন্স! আপনি কেমন ভদ্রলোক মশাই, একজন মহিলাকে এতো লোকের মাঝে অপদস্ত করতে আপনার বিবেকে এতটুকু বাঁধলো না! রাবিশ!

দু’হাতে করতালি দেয় প্রশান্ত। বলে-বাহ! ফ্যান্টাস্টিক। আজকাল বডিগার্ডও সঙ্গে রাখা হয় বুঝি! কবে থেকে চলছে এসব?   

সুপ্রিয়র মতো ধীরস্থির, মার্জিত এবং রুচিসম্মত একজন শিক্ষকের পক্ষে অকারণে এ ধরনের কটূক্তি শ্রবণ করা বড় অসহনীয়। অবাঞ্ছণীয়। সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। স্বাভাবিক কারণেই প্রশান্তর হীন জঘন্য মন্তব্যগুলি তীরের মতো ছুটে এসে ওর আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। ওর ইমেজ নষ্ট করে দেয়। মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। ইচ্ছে হচ্ছিল পাল্টা জবাব দিতে। প্রশান্তকে এটাক করতে। কিন্তু হতবিহ্বল অলকার মুমূর্ষু মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে সয়ে গেল। ওর প্রবৃত্তিই হলো না। ক্ষীণ মৃদু স্বরে শুধু বলল, প্লিজ স্টপ ইট। কেন অহেতুক তামাশা ক্রিয়েট করছেন  আপনি?

প্রশান্ত তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, মাইন্ড ইওর ওউন বিজনেস। ভ্রু-যুগল উত্তোলেন করে বলে,  হু আর ইউ?
পরক্ষণেই সুপ্রিয়র মুখের দিকে অদ্ভুতভাবে একপলক চেয়ে বলে, আরে মশাই আপনি! তাইতো এতক্ষণ চেনা চেনা লাগছিল। আপনিও ফেঁসে গিয়েছেন? চালিয়ে যান।

প্রশান্ত কথা বলছে ঠিকই কিন্তু ওর নজর অলকার দিকে। পকেট থেকে একটা দেশি মদের বোতল বের করে বলে, দেবো নাকি ঢেলে! একপেগ পেটে গেলে সব ঘুচে যাবে।
সহাস্যে গলার স্বর বিকৃতি করে বলে, ‘ভালোবাসা হচ্ছে! সমুদ্রের পটভূমিতে এসে ভালোবাসা হচ্ছে!’ বলে বোতলের ছিপিটা খুলে এক চুমুকে টেনে নিলো বেশ খানিকটা। গ্রাহ্যই করলো না কাউকে। চারিদিকে মানুষের ভিড়। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। মদের উগ্র গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসছে। কি বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি!

আচমকা অনাকাঙ্ক্ষিত বিরূপ পরিস্থিতির কবলে পড়ে যন্ত্রণাকাতর অলকা দিশা খুঁজে পায় না। বিচলিত হয়ে পড়ে। ঈর্ষাণ্বেষী প্রশান্তর হীনমন্যতা, রূঢ়তা ও সংকীর্ণতায় ওর দৃঢ়ভাবে অনুমেয় হয়, প্রশান্তর মতিগতির ঠিক নেই। ঘোর এখনো কাটেনি। বিপদ অবশ্যম্ভাবী। একেবারে অবধারিত। মানে মানে কেটে পড়াই শ্রেয়।
অগত্যা, সেই অনাগত বিপর্যয় থেকে নিস্তার পেতে সুপ্রিয়কে বলল, চলুন সুপ্রিয় বাবু! এখানে এক মুহূর্তও নিরাপদ নয়। শিগগিরই চলুন। বলে কটাক্ষ দৃষ্টিতে প্রশান্তর আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে অবিলম্বে গার্ডেন থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে।

বাইরের কাণ্ডকারখানা পর্যবেক্ষণ করে হতভম্ব হয়ে যায় সুপ্রিয়। প্রচণ্ড ভাবিয়ে তোলে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ওর মস্তিষ্কের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে ক্ষণপূর্বের ঘটনাবলির প্রতিচ্ছবি। ওর ভাবতেই অবাক লাগছে, একই পৃথিবীর মানুষ অথচ এদের আচরণ, মনোবৃত্তি কত তফাৎ। এরা কেন পারে না সহজ সরলভাবে জীবন-যাবন যাপন করতে। জীবনকে পরিচালনা করতে। কষ্ট হয় অলকার জন্য। কলকাতা থেকে এতদূরে এসেও বেচারি এতটুকু শান্তি পেলো না। এঞ্জয় করতে পারলো না। কিন্তু এজন্য ওই দায়ী। নিজেকেই অপরাধী মনে হয় সুপ্রিয়র। ওতো আসতেই চাইছিল না। একরকম জবরদস্তি করে ওকে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু প্রকৃতির মনমাতানো উচ্ছ্বাসে সমুদ্রের তনুতটে বসে মুক্ত বাতাস উপভোগ করতে এসে এরূপ বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হবে তা কে জানতো! কিন্তু তখনও কি ভাবতে পেরেছিল সুপ্রিয়, এ এক চরম পরিণতির পূর্বাভাস!

গার্ডেন থেকে বের হতেই পিছন থেকে বিকট শব্দে ছুটে আসে প্রশান্ত। মদের বোতলটা ছুড়ে মারে অলকার গায়ে। কিন্তু বোতলটা দ্রুত গতিতে এসে পড়ে সুপ্রিয়র মাথার উপর। সঙ্গে সঙ্গে বোতলটা ভেঙে টুকরো হয়ে একাংশ বিদ্ধ হয়ে শুরু হয় রক্তপাত। তা দেখে অলকা আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, সুপ্রিয় বাবু! ও মাই গড, আর ইউ ওকে?
 
থরথর করে হাত-পা কাঁপতে শুরু করে অলকার। বাক্যাহত হয়ে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্য বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে দুইহাতে রক্তাক্ত ক্ষতস্থান চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ে সুপ্রিয়। উপায়ান্তরহীন হয়ে অলকা তাৎক্ষণাৎ একটানে ওর শাড়ির আঁচল থেকে একটুকরো কাপড় ছিঁড়ে নিয়ে বেঁধে দেয় সুপ্রিয়র মাথার চারিদিকে।

ওদিকে অতিরিক্ত মদ্যপানে শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছিল প্রশান্ত। কিন্তু হুঁশ হারায়নি। ঈর্ষায় মুহ্যমান হয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। চোখমুখের বিশ্রী ভঙ্গিমায় অলকার অস্তিত্বে আঘাত হেনে অবিশ্রান্ত অশ্লীল মন্তব্য করতে থাকে। স্থান-কাল-পাত্র কিছুই গ্রাহ্য করছে না। কিন্তু সুপ্রিয়ও একজন পুরুষমানুষ। সুঠাম সবল হাট্টাগোট্টা তরুণ যুবক। ওইবা কম কিসে! ওরও আত্মসম্মানবোধ আছে, পৌরুষত্ব আছে। চলমান ঘটনার বিপদগ্রস্ত সময়ে কোনো মানুষই নিজের পৌরুষত্বের অপমান কখনো বরদাস্ত করবে না।

হঠাৎ অলকার হাত শক্ত করে ধরে বলে, আপনি আসুন আমার সাথে। দেখবো ওর কতবড় হিম্মত আছে। বলে ভিড়ের মধ্যে থেকে অলকাকে টেনে নিয়ে আসে। মুহূর্তের জন্য বাকরূদ্ধ হয়ে গিয়েছিল অলকা। ভিতরে ভিতরে কেঁপে ওঠে। কোনো কথাই আর উচ্চারিত হয় না। কিছুদূর গিয়ে বলে, এ আপনি কী করছেন সুপ্রিয় বাবু? হাতটা ছাড়‍ুন।
- না অলকা, আজ আমার জন্যই আপনি অপমানিত হলেন, অপদস্ত হলেন। এতবড় একটা মিথ্যে অপবাদ, কলঙ্কের দাগ আপনার কপালে লেপে দিয়ে গেল। আপনাকে নির্বিকারে শুনতে হলো। আমাকে একটু সময় দিন। আপনার ওই কলঙ্কের দাগ আমিই মুছে দেবো।
চোখেমুখে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা অলকার। চাপা উত্তেজিত হয়ে বলে, মানে? আপনি কি করতে চাইছেন?
- অপবাদের দাগ মুছতে গিয়ে অন্তত প্রায়শ্চিত্ত করবার সুযোগ কি আমায় একবার দেবেন না অলকা?
- তা হয় না সুপ্রিয় বাবু। আমি ধোঁকা দিতে পারবো না আপনাকে। তাছাড়া মনেরও একটা ব্যাপার আছে। আপনি মনকে ফাঁকি দেবেন কী করে?

ঠোঁট চিবিয়ে ফিক করে একটা শুকনো হাসি ফুটিয়ে সুপ্রিয় বলল, সরি! অধিকারের সীমাটা বোধহয় একটু বেশিই লঙ্ঘন করে ফেলেছিলাম। ডোন্ট মাইন্ড!
কোণা চোখে তাকিয়ে বলে, বুঝেছি আপনি ভালোবাসার কথা বলছেন? পৃথিবীতে ভালোবাসাই কী সব? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। কারণ পৃথিবীতে বিশ্বাস আর ভরসা এই দুটোই সবচে’ বড় জিনিস। সেটা না থাকলে ভালোবাসা কোনোভাবেই জন্ম নিতে পারে না। নইলে আমরণ টিকে থাকা কখনোই সম্ভব হতো না। কথাটা একটু ভেবে দেখবেন মিস গাঙ্গুলি। বলে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শুরু করে।

ইতিমধ্যে হঠাৎ রাস্তার বিজলি বাতিগুলি জ্বলে ওঠে। চমকে ওঠে অলকা। কথায় কথায় কখন যে অন্ধকার নেমে  গিয়েছে ওর হুঁশই ছিল না। মুখ তুলে দেখে, আশেপাশে জনশূন্য। লোকজন কোথাও নেই। মিলি আর প্রশান্ত দুজনেই উধাও। দূরে দেখা যাচ্ছে দু-একজন হাঁটাচলা করছে। চাপা উৎকণ্ঠায় অলকা বলল, দাঁড়ান সুপ্রিয় বাবু, কথা শেষ হয়নি।

পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে সুপ্রিয়র নজরে পড়ে, চলার শক্তি নেই অলকার। বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। লক্ষ্যভ্রষ্টের মতো শূন্য দৃষ্টিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারাক্রান্ত মন। চোখেমুখে বিষন্নতায় ভরা। সুপ্রিয় গহীনভাবে অনুভব করে, ওর মানসিক পরিস্থিতি। ওর মনবেদনা। ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে বলল, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি মিস গাঙ্গুলি। আপনি কোনোভাবেই প্রস্তুত নন। কিন্তু আজ যা ঘটল, তা তো নিজের চোখেই সব দেখলেন। আর বেকায়দায় যে প্রস্তাব আমি দিয়ে ফেলেছি তা পূর্ব পরিকল্পিত না হলেও একেবারে অবাঞ্ছনীয়ও নয়! ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখবেন।

শান্ত গলায় অলকা বলল, কিন্তু আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি সুপ্রিয় বাবু। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুই মনে করি। আপনার কাছ থেকে এমন একটা প্রস্তাব আসবে এ আমি কখনো আশা করিনি।
- ছি ছি, একথা বলে আমায় ছোট করবেন না মিস গাঙ্গুলি। আমি অন্যায় কিছু বলিনি। আপনার ক্ষতি হোক, এ আমি কখনোই চাইবো না। শুধু ওই স্কাউনড্রেল প্রশান্তকে অ্যাভয়েড করতে গিয়ে..! ওকে, নো প্রবলেম। আপ টু ইউ। অজান্তে যদি কোনো ক্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকে আমায় ক্ষমা করবেন। এ বিষয়ে কক্ষনো আর কিছু বলবো না। চলুন, অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

কিছুক্ষণ থেমে অলকা বলল, আমায় কিছুক্ষণ একটু একলা থাকতে দিন সুপ্রিয় বাবু! আপনি চলে যান প্লিজ!
 
একজন দায়িত্বশীল মাস্টার সুলভ কণ্ঠেই সুপ্রিয় বলল, হুঁম, আপনাকে তো একলা ছেড়ে যেতে পারি না মিস গাঙ্গুলি। রোজ গার্ডেন থেকে হোটেল স্নোফক্সের এই পথটা কম নয়। অন্তত হোটেল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা আমার। সঙ্গে এনেছি, সঙ্গেই নিয়ে যাবো। আপনার বান্ধবীরাও হয়তো এতক্ষণ আপনাকে খুঁজজে।

মাথাটা নিচু করে অলকা বলল, না, ওরা কেউ আমায় খুঁজবে না। ওরা সবাই জানে আপনি আমার সঙ্গে আছেন।
- কি করে জানলো?
- প্রশান্তর সাথে জিন্স পড়া একটি যুবতী মেয়ে ছিল, দেখেছিলেন? ওই হলো মিলি, আমার মামাতো বোন। আজ এসবের জন্য ওইই একমাত্র দায়ী। ওকে দেখেইতো আর কন্ট্রোল করতে পারলাম না। দেখেন গিয়ে, এতক্ষণে ওওই আমার বান্ধবীদের কান ভারী করতে বসে গিয়েছে। না জানি আরো কত কিইনা বলছে।

-অ্যাঁ, বলেন কী! বিস্ময়ে হাঁ করে চেয়ে থাকে সুপ্রিয়। - সব জেনে শুনে শেষ পর্যন্ত আপনারই মামার মেয়ে..!
- মাঝেমধ্যে ওদের দেখা সাক্ষাৎ হতো, কথাবার্তা বলতো, হাসিঠাট্টা করতো জানি। কিন্তু তলে তলে এতখানি গড়াবে তা কখনো ভাবিনি। ও যে কী করে শয়তানটার ফাঁদে পড়লো, ভাবতেই পারছি না। মরুক ওরা। যা খুশি করুক। ওদের মুখই আর দেখতে চাই না। বুঝতে পারছি, আপনি অযথা আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন। কেন যে আপনার সাথে দেখা হলো! নইলে এসব কিছুই ঘটতো না।
- আপনি কেন নিজেকে দোষারোপ করছেন মিস গাঙ্গুলি। হয়তো এর চেয়ে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারতো। থ্যাঙ্কস গড, আমরা সবাই সুস্থ আছি, ভালো আছি। আমরা সশরীরেই কলকাতায় ফিরে যাবো। দ্যাটস ইট! কিন্তু কী জানেন, আপনার কাছ থেকে যা আমি পেলাম সেটাই জীবনে আমার একটা বিরাট অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। যা শুধু চিরদিন গেঁথে থাকবে আমার অম্লান স্মৃতির গ্রন্থিতে। এক অদৃশ্য অনূভূতিতে।
- আশ্চর্য, কিন্তু আমি তো আপনাকে কিছুই দিইনি সুপ্রিয় বাবু।
- মনে পড়ে, যেদিন আপনাকে আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলাম!

কিছুক্ষণ চিন্ত‍া করে অলকা বলল, কই, মনে পড়ছে না তো! কি বলেছিলেন?
- থাক। সে কথা জেনে আজ আর কোনো ফল হবে না। শুধুমাত্র মনের কষ্টটাই আপনার বাড়বে।

চুপ করে শুনলো অলকা। মুখে কিছু বলল না। চোখের পাতাদুটো নত করে শিথিল ভঙ্গিতে হোটেল স্নোফক্সে ঢুকে গেল। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সুপ্রিয়ও ওর পিছে পিছে ঢুকে পড়লো।

চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৬
এমজেএফ/

** অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-১)
** অনুভূতি | যুথিকা বড়ূয়া (পর্ব-২)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ