ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

গল্প

প্রীতি ও শুভেচ্ছার তৃষ্ণায় | ম্যারি ওয়েব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৭ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৬
প্রীতি ও শুভেচ্ছার তৃষ্ণায় | ম্যারি ওয়েব

[ম্যারি ওয়েব (২৫ মার্চ, ১৮৮১ - ০৮ অক্টোবর, ১৯২৭) বিংশ শতকের ইংরেজ কবি ও ঔপন্যাসিক। গল্পের নাটকীয়তার জন্য তার লেখার অন্যরকম জনপ্রিয়তা রয়েছে।

তার একাধিক লেখা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। IN AFFECTON AND ESTEEM শিরোনামের গল্পটি অনুবাদ করেছেন শাকিলা পারভীন বীথি। ]   
 

মিস মার্টেল ব্রাউনের জীবনে কখনই ভালোবাসার মোড়কে জড়ানো উপহার অথবা সুশোভিত ফুলের তোড়া পাওয়া হয়নি। পাতাল রেল স্টেশনের পথ ধরে পায়ে হেঁটে যেতে যেতে প্রতিদিন মনে মনে কতোই না কল্পনার ফানুস ওড়াতো সে। ইচ্ছে করতো, লন্ডনের বড় কোনো দোকানের দরজা মোহনীয় সেলাই দিয়ে বন্ধ করে দিতে। হায়! কতো সুখকরই না হতে পারতো তার স্মৃতির ভাঁড়ার। এমন কি হতে পারতো না? খুব দেরি করে ঘরে ফেরা কোনো এক দিনে হঠাৎ সে দেখতে পেলো একগুচ্ছ গোলাপ মিষ্টতা ছড়িয়ে তার আগমনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে তারই টেবিলে! ভালোলাগার প্রহরগুলো গভীর করে তুলতে, তাদের লোভনীয় লাল বা সাদা পাপড়িগুলো যেনো তাকে কাছে ডাকছে। নিশ্চয়ই এটি ছিলো তার জন্য আকাশকুসুম কল্পনা।
  
কেননা, তার ঘরে একটা টেবিল যে রয়েছে। আর তাতে রাখার মতো এক টুকরো পাউরুটি যে রয়েছে সেটাই কি তার জীবনের সুখের বড় কারণ হওয়া উচিত ছিলো না? তার মাথার উপর যে ছাদটি রয়েছে সেটি তাকে ভাড়া দেওয়ার জন্য বাড়িওয়ালির কাছে কৃতজ্ঞ থাকাও উচিত ছিলো।
 
কেটলি বসিয়ে চুলা ধরাতে ধরাতে নিজের মনকে প্রবোধ দিতেই যেনো সে বলে ওঠে, ‘এখন তোমার হাতে একটা পয়সা নাও থাকতে পারতো। হায়রে মার্টেল ব্রাউন! এই পাত্রে ঢালার মতো চা নাও জুটতে পারতো। সুতরাং, প্রাপ্তির খাতায় যা জমা হয়েছে তাতেই কৃতজ্ঞ থাকো’।
 
সে কৃতজ্ঞ ছিলো ঈশ্বরের প্রতি, বাড়িওয়ালির প্রতি, তার চাকরিদাতার প্রতি। যে চাকরিদাতা তাকে হাড়ভাঙা খাটাতো, বেকারির লোকটার প্রতি- যে তাকে পাউরুটি দিয়ে যেতো। আর কৃতজ্ঞ ছিলো, প্রতি রোববারে আসা দুধওয়ালার প্রতি। আর সে অবশ্যই কৃতজ্ঞ ছিলো, বাড়িওয়ালির বিড়ালটির প্রতি- যে সেই দুধের স্বাদ আস্বাদন থেকে বিরত থাকতো।
  
তবুও কল্পনার রঙধনু রঙ ছড়াতে লাগলো তার অলস আকাশে। দিনশেষে ঘরে ফেরার ক্লান্তি দূর করতে যখন সে পেতো বিছানার উষ্ণতা, তখনই মনের অলিগলি সচকিত হয়ে উঠত এক চমকপ্রদ মুহূর্তের প্রত্যাশায়। হায়! যদি কোনোদিন একরাশ ফুল পেতো সে! উপহারের মোড়ক উন্মোচনের ভাবনায় অলস সময় হতো তার স্বপ্নীল ভাবনার সফল উদযাপন।
 
বারে বারে উঁকি দিতো মনে সেই প্রত্যাশিত ক্ষণের দৃশ্যায়ন– সবুজ পাতার আলিঙ্গনে থাকা ফুল। চোখের তৃষ্ণা মেটাতে দ্রুত মোড়কটাকে খুলে ফেলা, সুরভিত পাপড়িগুলো মেলে ধরা! 
তারপর? এক সুমিষ্ট উষ্ণতায় স্বপ্ন হবে সত্যি– আহ! 
হয়তো স্বপ্নের পথ ধরে সুবাস ছড়াবে গোলাপ অথবা ভায়োলেট উপত্যকার ঢালে খেলা করা লিলি বা লাইলাক। হতে পারে, ফ্যাকাসে মুখের গোলাপি পিওনি বা ঘাসফুলের মতো ফুলগুলোও স্বর্গীয় দীপ্তি ছড়াবে তার চোখে–মুখে।  

এই ছোটো ঘরটাকেও তখন তার গ্রিনহাউস মনে হবে। কিউ শহরের সেই সুন্দর গ্রিনহাউসগুলোর একটি যেনো হয়ে উঠবে তার ঘর। সেদিন সে বাড়িওয়ালির জ্যামের বয়াম ধার করবে। সারাটা বিকেলজুড়ে ঘরটা সাজাবে সে। ঘরটি হয়ে উঠবে স্বর্গের মতো সুন্দর। রোববার সকালে একটু আয়েশ করে দেরিতে ঘুম থেকে উঠবে সে ... আহ! যেনো স্বর্গীয় সুখ।  


সাপ্তাহিক উপার্জনের অর্থ দিয়ে এক গুচ্ছ ফুল যে কিনতে সে পারবে না, এমনটি নয়। বলা যায়, প্রায়শ কিনেও ফেলে সে। কিন্তু তাতে যেনো তৃপ্ত হয় না তার মন। ঠিক যেভাবে সে চায়, ফুলের আগমন সেভাবে হয় না তার জীবনে। সে বিস্মিত হতে চায়, উপহারের মোড়কে তার ও প্রেরণকারীর নাম দেখে। তার নামের সঙ্গে জ্বলজ্বল করবে শুভেচ্ছাবাণী। সে শুনেছিলো, নামকরা অভিনেত্রী বা বিখ্যাত গায়িকাদের এভাবেই ফুল পাঠানো হয়। জন্মদিনে বা কারও চিরবিদায়ের পর এভাবেই ফুলেল শুভেচ্ছা দেওয়া হয়।  
জন্মদিন! যদি জন্মদিনে এমন পার্সেল পেতো সে! জীবনের কতো জন্মদিন পেরিয়ে গেলো তার! সবগুলোই প্রায় একই দিনলিপিতে ঠাসা। চায়ের সঙ্গে হয়তো একটা টমেটো খাওয়া, এরপর সিনেমা দেখতে যাওয়া। মনে পড়ে, একবার জন্মদিনটা বিদ্রূপাত্মক নাটকে পরিণত হয়েছিলো। তার বাড়িওয়ালি সেবার তাকে সিনেমাতে যাওয়ার জন্য একটা টিকিট উপহার দিয়েছিলো। পরে টিকিটের বিনিময়ে কিছু সেলাইয়ের কাজ করতে দিয়েছিলো তাকে।


 
আজন্ম তার হৃদয়ের নিভৃত কোণে উপহার পাওয়ার এক সুপ্ত আশা ছিলো। এমন উপহারের বাসনা ছিলো তার, যা উপযুক্ত হবে বর্ণাঢ্য প্রদর্শনীর আর হৃদয় ভরে উঠবে প্রদর্শনী থেকে উদ্ভাসিত দীপ্তিতে। কিন্তু সেই শুভক্ষণের সূচনার ইচ্ছায় বিগলিত হয়নি কোনো মন। সময়গুলো যখন তার ভুলে ভরা কর্মযোগের হিসেব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে, তেমন এক নীরস শীতের দিনে সে এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিলো। কারণ, সে বুঝেছিলো তার ব্যাকুল হৃদয়ের বাসনা পূরণ করতে কেউ আর আসবে না। বুঝেছিলো তার আর কৃতজ্ঞ হওয়ার মতো মানুষের খোঁজ পাওয়া হবে না এ জীবনে।

ঠিক করলো, নিজেই সাজাবে নিজের জন্য বর্ণাঢ্য উপহারের ডালা। সে বর্ষাকালের জন্য পয়সা না জমিয়ে, নিজের বাসনা পূরণের জন্য পয়সা জমাতে লাগলো। শুরু হলো তার স্বপ্ন পূরণের আয়োজন।

এরপর, জানালার কার্নিশে পাখিদের জন্য খাবার রাখতে রাখতে নিজেকেই বলে উঠলো, তোমার চাওয়ার আর থাকবে না কিছুই। মার্টেল ব্রাউন, এরপর যা কিছু পাবে, তাতেই তুমি কৃতজ্ঞ থাকবে।

দৈনন্দিন জীবনের ফাঁকে ফাঁকে গড়ে তোলা কৃপণতার অভ্যাসে জমতে শুরু হলো অর্থ। সংগ্রহ বাড়তেই লাগলো। এখান-সেখান থেকে একটু-আধটু জমাতে জমাতে এক শিলিং জমিয়ে ফেললো। সে সংকল্পে এতোটাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলো যে, পরবর্তী জন্মদিন আসার আগেই দুই পাউন্ড জমা হলো তার ঝুলিতে। সে জানতো, কাপড় ও খাবারের যোগান না দেওয়া খাতে পুরো দুই পাউন্ড ব্যয় সবার কাছেই অদ্ভুত ও ফালতু মনে হতে পারে। বাড়িওয়ালিকে এমন পরিকল্পনার কথা জানানো প্রায় অসম্ভব। বাড়িওয়ালি মানতেই পারবে না। কথাটা অবশ্যই তার মনে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কেউ জানতে পারবে না ফুলগুলো কোথা থেকে এলো।

আচ্ছা, প্রেরকের নামবিহীন কিছু এলে তাকে কী বলে? বেনামী। ফুলগুলো না হয় বেনামীই হোক। কভেন্ত গার্ডেনের ফুলের দোকানে খুচরায় ফুল কিনতে পাওয়া যায়। চাইলে ওরা বাসাতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। বিস্ময় জাগানিয়া কাজে বিঘ্ন যেনো অবশ্যম্ভাবী। জন্মদিন আসার আগেই তাকে ফুলের দোকানে যেতে হবে।
 
তাকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো। বাস থেকে নিবিষ্ট মনে সে দেখছিলো, সকালের লন্ডন। কভেন্ত গার্ডেনে নামলো সে এক রাজকীয় ভঙ্গিমায়। নেমেই হাঁটতে শুরু করলো। পথের দু’ধারে সবুজ শাক-সবজি, ফলের আড়ত, আলুর বস্তা। দোকানিদের এখন ব্যস্ত সময়। ভিড়ের মধ্যে তার কাঙ্ক্ষিত দোকানদারটি দেখতে পেলো মলিন চেহারার ছোটখাটো একজন নারীকে, যার চোখে-মুখে আনন্দ ও দুশ্চিন্তার যুগল সম্মেলন।
 
আমি কিছু ফুল চাই। ফুলগুলো ভালো হওয়া চাই। মোড়কে মুড়িয়ে আজ রাতেই আমার পরিচিত একজনের ঠিকানায় পাঠাতে হবে ।  
-    ভায়োলেট?
-    হ্যাঁ। ডাল ও পাতাসহ ভায়োলেট, টিউবার রোজ। খুব সতেজ হওয়া চাই। মাইমসা দিয়ে জড়ানো থাকবে ফুলগুলো। আর হ্যাঁ, কয়েক ডজন গোলাপও কিন্তু চাই।  
-    একটা কথা বলার আছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এই ফুলগুলো পেতে হলে বেশ খরচ হবে আপনার? 
-    আমি যা চাইছি তার বিপরীতে যে মূল্য দিতে হয়, দেবো। বেশ ঔদ্ধতের সঙ্গে বলে উঠলো মিস ব্রাউন।  
-    ফুলের নাম লিখে নিন, প্যাকেট করে সময়মতো ডাকযোগে পাঠাবেন। খরচ নিয়ে ভাববেন না।
 
দোকানদার তার নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করলো। মিস ব্রাউন বেদনার্ত প্রজাপতির মতো ফুল থেকে ফুলে ঘুরতে থাকলো। কখনও আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো পাপড়ি, বা চোখে অপছন্দের আবেশ মাখিয়ে নতুনের খোঁজে অন্য ফুলে ফেরাচ্ছিলো চোখ।
দোকানদার বুঝলো, বিষয়টা স্বাভাবিক কিছু নয়। করুণা হচ্ছিলো তার। অবশেষে, সব নির্দেশনা দেওয়া শেষ হলো। পাঠানোর ঠিকানা ও মূল্য দেওয়া হলো পুরো দুই পাউন্ড। মূল্য বাকি রাখেনি সে।
 
বিজয়ের আনন্দে উচ্ছ্বসিত মিস ব্রাউন প্যাকেটের উপর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় কয়েকটি শব্দ জুড়ে দিতে বললো।  
-    খুব ভালো বন্ধু, না? জিজ্ঞেস করতে ভুললো না দোকানদার।
-     হ্যাঁ, আমার একমাত্র বন্ধু। প্রত্যুত্তরে মিস ব্রাউন।
যদিও কভেন্ত গার্ডেনের পথ অদ্ভুত রকমের কর্দমাক্ত। তবুও সেই পথেই সে স্বর্গসুখ অনুভব করলো। মহাসুখে কাজ করলো সারাদিন এবং এক ঘোরলাগা স্বপ্ন নিয়ে ঘরে ফিরলো। সারারাত ঘুমের ঘোরে ছটফট করলো। ক্রিসমাস ইভের প্রতীক্ষায় বাচ্চারা যেমন করে। পরদিন খুব সকালে উঠে ডাকপিয়নের কড়া নাড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগলো।  
এই তো! ঠিক ধরেছি! কড়া নাড়ার শব্দ।  

কিন্তু বাড়িওয়ালি তো তাকে ডাকতে এলো না। নিশ্চয়ই এটা দুধওয়ালা ছিলো। আবার অপেক্ষা। আবার কেউ কড়া নাড়ছে। এবারও কোনো পদশব্দ এগিয়ে এলো না তার ঘরের দিকে। সে ভাবলো, রুটিওয়ালা নিশ্চয়ই। কোথায় সেই ডাকপিয়ন? এতো দেরি করছে কেন? চেনা কেউ হলে নিশ্চয়ই এতো সময় নিতো না। আবার অপেক্ষা। ঘণ্টাখানেক ধরে কিছুই হলো না। শেষ কড়া নাড়ার অনেক পর সে অবশেষে নিচে নামলো।  
-    ডাকপিয়ন! 
-    কেন, সে তো ঘণ্টাখানেক আগেই চলে গেছে। বাড়িওয়ালির উত্তর।
-    পার্সেল? 
-    না, সেটা তোমার জন্য ছিলো না। মিস ব্রাউনের জন্য ফুলের তোড়া এসেছিলো। খুব দামী ফুলের। আমি জানতাম, ওটা তোমার হতেই পারে না। তাই আলভিরা ব্রাউনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আলভিরা অভিনেত্রী। এখানেই ভাড়া থাকতো। সে সবসময়ই অজস্র ফুল উপহার পেতো। আমি জানতাম, ওটা তারই ছিলো।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৬ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৬
এসএমএন/এসএনএস

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ