ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

১৮০ রুবলের দেনা মাথায় নিয়ে শুরু মস্কোয় পথচলা!

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২৩
১৮০ রুবলের দেনা মাথায় নিয়ে শুরু মস্কোয় পথচলা!

মস্কো (রাশিয়া) থেকে: দোমোদেদোভো এয়ারপোর্ট থেকে গন্তব্য মস্কো শহরের দিকে। চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যের সাক্ষী এই শহর।

প্রতিদিন এখানে ভিড় করেন লাখো পর্যটক। সেই তালিকায় আজ যোগ হচ্ছে আরও কয়েকটি নাম। বাঙালি নামের মানুষগুলোকে স্বাগত জানাতে যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে শহরের শীতলতম হাওয়া আর পাতাঝরা গাছেরা।

এয়ারপোর্টে দানিয়েল আমাদের চারজনের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করলেন। ঝটপট উঠেই রওনা হলাম আমরা। মূল শহর থেকে এয়ারপোর্টের দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ যাত্রায় একদিকে চোখে পড়বে অভিজাত দেশটির সম্পদভাণ্ডার, আর একদিকে অনাড়ম্বর জীবনবোধ। দুই ইতিহাসকেই চোখে ধারণ করতে করতেই এগোতে থাকি আমরা। মাঝে দানিয়েল তার মোবাইল থেকে আমাদের ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করে দেওয়ায় বাকিরা কথা বলে নিলেন পরিবারের সঙ্গে। আর আমি তখনো গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তা আর তার পাশের স্থাপত্যগুলো দেখতে দেখতে মস্কোর ভাবনায় বিভোর।

মস্কো শহরের বয়স প্রায় ৯০০ বছর, তৈরি হয়েছিল ১১৪৭ সালে। তবে তার চেয়েও যেটা বড় কথা, তা হলো সহস্রাব্দ-প্রাচীন ইতিহাস প্রায় জ্যান্ত অবস্থাতেই রয়েছে সেখানে। মস্কো তথা গোটা রাশিয়ার ওপর দিয়েই কম ঝড়ঝাপটা যায়নি গত হাজার বছরে। এককালে ইউরোপীয় রাজাদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি, তার পরে মোঙ্গল আক্রমণ, জার আমলে অসংখ্য বিদ্রোহ, সর্বোপরি সোভিয়েত ইউনিয়নের পত্তন ও পতন—এসবের ভেতরেও হাজার বছরের পুরনো বাড়িগুলো আজও দেখলে ঠিক যেন হাজার বছরের পুরনো বলেই মনে হয়। আর এমন ঝকঝকে করে রাখা, যেন মনে হয় সদ্য ঝাড়পোঁছ, রংচং হলো!



ছিমছাম রাস্তায় একের পর এক ভোঁ-ভোঁ করে ছুটে চলেছে অসংখ্য গাড়ি; যদিও সেরকম জ্যাম নেই, সিগন্যালেই যতটা সময় যায়। রাস্তায় চলা গাড়িগুলোর অধিকাংশই প্রাইভেট কার। যদিও প্রায় সব গাড়িতেই কিছু ময়লা জমা, দেখে মনে হয় অনেকদিন গাড়িগুলো ধোয়া হয়নি, তবুও তাদের গতি দুর্দান্ত। চোখে পড়লো নীল রঙের কিছু পাবলিক বাসও। সবকিছু মিলিয়ে শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধুনিকতার একটি জীবন্ত প্রদর্শনী যেন এই সড়কগুলো। তার সাথে দু’ধারে হাঁটার জন্য সুন্দর ফুটপাত, বসার বেঞ্চ, সারি সারি গাছ আর সুন্দর আবহাওয়া মিলিয়ে একটি আকর্ষক এবং প্রাণবন্ত পরিবেশ তৈরি করে; যা পর্যটকদের এবং স্থানীয়দের জন্যও বেশ উপভোগ্য।

সব মিলিয়ে বলা যায়, দোমোদেদোভো এয়ারপোর্ট থেকে মস্কো শহরের দিকে যাওয়ার পথে যাত্রীরা শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতির একটি দুর্দান্ত দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। দৃশ্যটি শহরের আধুনিক এবং ঐতিহাসিক স্থাপত্যের একটি মিশ্রণ, যা এটিকে একটি অনন্য এবং আকর্ষক গন্তব্য করে তুলেছে। এই সড়কে দৈনন্দিন জীবন ছুটে যায় দুর্বার গতিতে, তবে পায়ে হেঁটে চলা জনমানবের দেখা মেলে খুব কমই। আর সবথেকে বড় যে বিষয়টি আলাদা করে নজর কাড়ে, তা হলো সড়কে অসংখ্য গাড়ি থাকলেও গাড়ির হর্ণের আওয়াজ নেই একটুও। আরও সহজ করে বললে, ফোর্টি টু কিলোমিটার উইদাউট এনি হর্ণ! বিষয়টি একদিকে যেমন আশ্চর্য করে, তেমনি ভালোলাগাও তৈরি হয়।



ইতোমধ্যেই শীতল হাওয়ায় ঝাপসা হয়ে উঠেছে গাড়ির জানালার গ্লাস। জিনিয়া আপু তাতে খুব ভালোবেসেই আঙুলের রেখায় আঁকলেন ভালোবাসায় ভরপুর একটি অসাধারণ হৃদয়ের চিহ্ন। তারপর নিজের নামের সাথে একটা যোগ চিহ্ন দিয়ে লিখলেন নিজের প্রিয় মানুষটির নাম। রাশিয়ার শীতল হাওয়াকে সাক্ষী মেনে তার কপালে তিলক আঁকলেন বাংলা বর্ণমালার। যে বর্ণমালা ভালোবেসে শহীদ সালাম-রফিক-জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে। যে বর্ণের মালা গেঁথে ১০১টি চিরকুট লিখে ভালোবাসার অনুভূতি জানিয়েছিলাম প্রিয়তমা ইভাকে; যার নামে শুরু হয়েছে উইকিপিডিয়ার ৩৩ হাজার আর্টিকেল আর গ্রীসের অনিন্দ্য সুন্দর এক গ্রাম!

রাশিয়ার সাথে বাংলা ও বাঙালির এইসব মেলবন্ধন করতে করতে আর অবাক বিস্ময়ে গাড়ির জানালা দিয়ে শহর দেখতে দেখতেই আমরা পৌঁছালাম হোটেলে। হোটেল ম্যাক্সিমা। ইতোমধ্যেই সেখানে এসে পৌঁছেছে নিউ জেনারেশন প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া অন্যান্য দেশের যুব প্রতিনিধিরা। দানিয়েল আমাদের দুজনকে (আমি এবং শফিক ভাই) নামিয়ে দিলেন এখানেই। বাকি দুজনের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে অন্য হোটেলে। এ খবর জানার পর মনটা একটু বিষাদেই ভরে উঠলো; কিন্তু কী আর করা। অগত্যা তাদের বিদায় জানিয়ে আমরা ঢুকলাম হোটেলে।



রিসিপশনে আমাদের স্বাগত জানালো মিষ্টি হাসির ভিক্তোরিয়া। সাদা ড্রেসের উপর লাল কোর্টে ওই হাসিমুখ সত্যিই মানানসই। চেক ইনের যাবতীয় কাজ শেষ করে যখন রুমে যাবার জন্য প্রস্তুত, স্থানীয় সময় তখন প্রায় সাড়ে ৯টা। অন্য সবাই হোটেলের লবিতে অপেক্ষমান। চিনি না কাউকেই। তাদের মধ্য থেকেই একজন এসে বলল—‘আপনারা ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে নিন। দুপুরে আপনাদের জন্য গাড়ি পাঠানো হবে। এরপর লাঞ্চ টাইমেই যোগ দিতে পারবেন সবার সঙ্গে। ’ কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম। আমরাও সেরকমই করলাম। দুজনের জন্য দুটো আলাদা রুম। ছিমছাম, পরিপাটি। রুমের জানালার গ্লাসের পর্দা সরিয়েই মুগ্ধ হলাম আরেকবার। আট তলায় আমার রুমটা থেকে দেখা যায় যেন পুরো মস্কো শহরটা। যতদূর চোখ যায় ছিমছাম রাস্তাঘাট। নজরে পড়লো রাস্তার পাশেই একদল পায়রা। একটি মেয়ে তাদের খাবার দিচ্ছে। পায়রাগুলো একবার এদিক ওদিকে ওড়াউড়ি করে, তারপর আবার এসে বসে খুটে খুটে খাবার খায়। নতুন এই শহরে আমার মতো আগন্তুককে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এ ভীষণ সুন্দর দৃশ্য।

কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম নাশতার জন্য। শফিক ভাই ততক্ষণে পৌঁছে নাশতা শুরু করেছেন। নিচে যেতেই দেখলাম কী এক বিষয় নিয়ে যেন শফিক ভাইয়ের কথা চলছে রেস্টুরেন্টের এক কর্মীর সঙ্গে। কথা হতেই জানলাম, নাশতায় সব দিয়েছে, কিন্তু পানি দেয়নি। পর্যাপ্ত জুস আর চায়ের ব্যবস্থা থাকায় নাশতার আইটেমে আপাতত পানি নেই। যা ছিল, আমরা শেষ মুহূর্তে যাওয়ায় তাও শেষ হয়েছে। তো পানি যখন নেওয়া হয়েছে, তখন আলাদা করে হাফ লিটার পানির বিল হয়েছে ১৮০ রুবল। পকেটে ডলার আছে পর্যাপ্ত, তবে তা এখনো এক্সচেঞ্জ করা হয়নি কারোরই। তাই বিল মেটাতে বেশ একটু ঝামেলাই পোহাতে হচ্ছে। ঝামেলা বলতে, রেস্টুরেন্টের কর্মীরা ইংরেজি না বোঝায় আর আমাদের রুশ না বোঝার ঝামেলা। শেষমেষ বিল অ্যাড করতে বলা হলো হোটেলে। রিসিপশনের ভিক্তোরিয়াকে কোনোমতে বোঝালাম, মানি এক্সচেঞ্জ করে আমরা রাতে বিল পে করব। অগত্যা ছাড়া! তারপর এই ১৮০ রুবলের দেনা মাথায় নিয়েই শুরু হলো আমাদের মস্কোয় পথচলা!

আরও পড়ুন:
উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো এক ঝাপটা শীতল হাওয়া
সাদা রাতের শহরে

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২৩
এইচএমএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।