ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

কেরানীগঞ্জে সরকারি জায়গায় সিসা কারখানা, হুমকিতে পরিবেশ

শামসুল ইসলাম সনেট, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২২
কেরানীগঞ্জে সরকারি জায়গায় সিসা কারখানা, হুমকিতে পরিবেশ

কেরানীগঞ্জ: রাজধানী ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল থানার অন্যতম সুন্দর ও ঐতিহ্যবাহী ইউনিয়ন কলাতিয়া। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত ইউনিয়নের তালেপুর, নতুনচর খাড়াকান্দি, ছাতিরচর, ছোট বেলনা, জৈনপুরসহ এখানকার গ্রামগুলো বেশ গোছানো।

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মৃত প্রায় ধলেশ্বরীর শাখা নদীর বিশালতা জানান দেয় এখানেও এক সময় ঢেউয়ের গর্জন ছিল।  

সকাল-সন্ধ্যা কিংবা দুপুর, একটু প্রশান্তির জন্য স্বচ্ছ বাতাসে গা ভাসাতে গ্রামবাসীর প্রথম পছন্দ এই মরা নদীর পাড়। তবে ছবির মত সুন্দর এই পরিবেশ আজ হুমকির মুখে।  

উপজেলার ছোট বেলনা গ্রামের নদী ঘেঁষা সরকারি খাস জমি দখল করে জনবসতির মাঝেই গড়ে তোলা হয়েছে সিসা কারখানা। যেখানে ২৪ ঘণ্টা চলে সিসা গলানো। সূর্যাস্তের পর থেকে শুরু হয়ে রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে কাজের বিস্তার, ব্যাটারি পুড়িয়ে বানানো সিসার অ্যাসিডের প্রকট গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশের পরিবেশ। কারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আর এতে হুমকিতে পরেছে গ্রামের পরিবেশ।  

একইভাবে শাক্তা ইউনিয়নের আব্দুস সালাম চেয়ারম্যান সড়কের পাশে আধুনিক পদ্ধতিতে কোটি টাকা ব্যয়ে বানানো হয়েছে একাধিক সিসা কারখানা। এখানেও চলে ২৪ ঘণ্টা সিসা গলানো।  

সাগর বেটারির কর্মচারী জিয়া জানান, এখানে সিসা গলানো হলেও এতে কারো কোনো সমস্যা বা অভিযোগ নেই। তাছাড়া আমাদের পরিবেশের ছাড়পত্রও আছে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ব্যাটারির বর্জ্য পুড়িয়ে সিসা তৈরি করলে তা আশপাশে বসবাস করা মানুষের শরীরে পয়জনিং সৃষ্টি করে। ফলে মানুষের মানসিক বিকৃতি, রক্তশূন্যতা ও মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করে, মানুষের শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যানসারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আর কোনো পশু কারখানার আশপাশের ঘাস খেলে অসুস্থ কিংবা মারাও যেতে পারে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে- কারখানার চারপাশে গ্রাম, অদূরে তালেপুর উচ্চ বিদ্যালয়, তালেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন ও খাড়াকান্দী বাজার, মাদরাসাসহ একাধিক বড় মাদরাসা। আর এর পাশেই কারখানার শ্রমিকরা কেউ পুরোনো ব্যাটারির পাত বের করছেন। কেউ ব্যাটারিতে থাকা অ্যাসিড সংরক্ষণ করছেন।  

কারখানা শ্রমিক সোহেল মিয়া বাংলানিউজকে জানান, চুল্লির মধ্যে কাঠ ও কয়লায় অ্যাসিড মিশ্রিত ব্যাটারির বর্জ্য বা প্লেট সাজানো হয়। এরপর আগুন ধরিয়ে দিলে তা গলতে থাকে। একই সঙ্গে বৈদ্যুতিক পাখা থেকে বাতাস দেওয়া হয়। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সিসা তৈরি হয়। এক রাত কাজের জন্য তাদের দেওয়া হয় ৫ থেকে ৭শ টাকা।

ছোট বেলনা গ্রামের আমেলা বেগম বলেন, খাস জায়গা ও নদী দখল করে অবৈধ সিসা কারখানা বানিয়ে ভাড়া দিয়ে এলাকাটা ধ্বংস করে দিচ্ছে স্থানীয় রুপাই, কোরবান, আতস, রহিমরা। এই কারখানার ধোঁয়া ও গন্ধের কারণে ঘরের দুয়ারে বসতে পারি না, ঘরের মেঝে মুছে রাখতে পারি না, গাছে কোনো ফল আসছে না, বাচ্চারা বিভিন্ন রোগে ভুগছে। আমরা এখানে এই কারখানা চাই না।

স্থানীয় একই গ্রামের বাসিন্দা ভাষানী জানান, এতো সুন্দর পরিবেশের মাঝে গড়ে ওঠা কারখানাটিতে সারা দিন রাত চলে সিসা গলানো। তবে রাত হলে এর মাত্রা বেড়ে যায়। ব্যাটারি পোড়ানোর গন্ধে এলাকায় থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। কারখানার মালিক কামাল প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকাবাসী বহু চেষ্টা করেও এটি বন্ধ করতে পারছে না। এ কারণে আমাদের গাছ-গাছালিতে ফল হয় না, অনেক গাছ মারা যাচ্ছে, ঘরের চালার টিন নষ্ট হচ্ছে। আমরা দ্রুই এই কারখানা অপসারণ চাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী জানান, এই নদীতে আমরা গোসল করতাম, এখানকার পানি নিয়ে রান্না-বান্না করতাম। কিন্তু সিসা কারখানা শুরু হওয়ার পর আর পানি ব্যবহার করা যায় না। কারখানায় সারাক্ষণ লোকজন থাকায় গোসলও করা যায় না।

স্থানীয় চুন্নু মিস্ত্রী, মোফাজ্জর, তোতা মিয়া, রহমত আলী, বুদ্দু মিয়া, ফারুক, রোমানসহ অসংখ্য মানুষের একটাই চাওয়া দ্রুত এই ক্ষতিকর কারখানার বন্ধ করতে হবে।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে কয়েকটি কারখানা ভেঙে দিয়েছি এবং অনেককে সাজাও দিয়েছি। শ্রমিক নয় আমরা চাচ্ছি মূল হোতারা সাজা পাক। এই কারখানাগুলোও আমাদের দৃষ্টিতে আছে। খুব শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।