ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

‘পাতি সরালি’ পরিযায়ী নয়, দেশি পাখি

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৯
‘পাতি সরালি’ পরিযায়ী নয়, দেশি পাখি

মৌলভীবাজার: শীত মৌসুম এলেই আমাদের হাওর-বিল-জলাশয়ে দেখা যায় পাতি সরালি হাঁস (Lesser Whistling Duck)। পানিতে একত্রে বসে থাকা কিংবা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ানো অনেকেই মনে করেন এরা বুঝি পরিযায়ী পাখি। অর্থাৎ, পৃথিবীর অন্য শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে আমাদের দেশে কিছুদিনের জন্য এসেছে।

আসলে তা একেবারেই নয়। ৪২ সেন্টিমিটারের বাদামি দেহের এই পাখিটি আকারে আমাদের গৃহপালিত হাঁসের মতোই অনেকটা।

পাতি সরালি হাঁস আমাদের দেশেরই পাখি। গ্রীষ্মে ছোট ছোট জলাশয়ে বাস করে এবং শীত এলেই হাওর-বাওর, নদী-বিলে অস্থায়ীভাবে থাকে। শীত ছাড়া অন্য মৌসুমে ওরা ঝাঁক থেকে বের হয়ে নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে একক বা জোড়া হয়ে বিভিন্ন ছোট-বড় জলাশয়, ডোবা, বিল, হাওরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়।  

তাই একত্রিতভাবে না থাকার কারণে তাদের সংখ্যাটা ব্যাপকভাবে চোখে পড়ে না। কিন্তু শীত মৌসুমে এলেই ওরা সবাই একটি জলাশয়ে বাঁচার তাগিদে এসে আশ্রয় নেয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ আমাদের দেশে বসবাস করা এই পাখিটাকে ‘পরিযায়ী পাখি’ বলে ভুল করে আসছে।   

আকাশে ডানা মেলেছে এক জোড়া পাতি-সরালি।  ছবি: ইনাম আল হকবাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক অনেকের ভুল চেনা এই পাতি সরালি সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নির্বাচিত হয়েছে যে- পাতি সরালি আসলে কখনই পরিযায়ী পাখি নয়। সারাদেশের লোক এই পাখিটাকে ভুলভাবে পরিযায়ী পাখি হিসেবেই জানে। সবার চোখে যেটা পরিযায়ী পাখি; সবার আগে যাকে পরিযায়ী পাখি হিসেবে বলে এবং জাহাঙ্গীরনগরে পরিযায়ী পাখি এসেছে এসব কথা বলে যে পাখি দেখে সেটা হলো পাতি সরালি।

তিনি বলেন, এই পাখিটা সারাবছরই আমাদের দেশে থাকে। তবে সারাবছর এক জায়গায় থাকে না। গ্রীষ্মে বিল-ডোবাসমৃদ্ধ বিভিন্ন ধানক্ষেতে ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু শীতের সময় তো সেই বিল-ডোবা শুকিয়ে যায়; ধানক্ষেত্রে তো আর পানি থাকে না; তাই তার পানিযুক্ত বড় বড় হাওর বিলে চলে আসে।

গ্রীষ্মে তাদের অবস্থানের কথা উল্লেখ করে এ গবেষক বলেন, ওরা আসলে দিনে গাছে গাছে লুকিয়ে থাকে। আর রাতে চারদিক নির্জন হলে ধানক্ষেতে নামে। ধানক্ষেতে নেমে শ্যাওলা, গুগলি (ছোট ছোট শামুক) প্রভৃতি যেগুলো ওরা খেতে পারে। এখনকার ইরি ধানে পানি থাকে আর পানি থাকলেই গুগলি অর্থাৎ ছোট ছোট শামুক থাকে। ওইসব ওরা খেলে তাতে আমাদেরই বেশি। কারণ ধানক্ষেত থেকে গুগলি সরে গেলো। সহস্র ছোট ছোট শামুক পরিষ্কার হয়ে গেলো।  

‘শীতকালে যেহেতু ওই ধানক্ষেতযুক্ত ছোট ছোট বিলগুলো শুকনো যেখানে ওরা রাতে থাকতে পারতো; যেখান থেকে ওরা চলে আসে বড় বড় বিল, জলাশয়ে। এখন তো আর বড় পুকুর বা দিঘিও নেই; এগুলো ছাড়া তো ওরা নিরাপদবোধ করে না। শহরে যেসব জায়গায় বড় পুকুর রয়ে গেছে যেখানে চলে আসে। সেজন্য শহরের লোকেরা মনে করে যে পাতি সরালি পরিযায়ী পাখি। ’

পাখি গবেষক ইনাম আক্ষেপ করে বলেন, এই পাখিটাও কিন্তু আমাদের দেশ থেকে কম যাচ্ছে। এর বড় কারণ হলো আমাদের দেশে বড় গাছ নেই। কারণ, পাতি সরালি গাছের কোটরে বাসা করে। একটা বড় হাঁস, ওরা বাসা নির্বাচন করে ডিম দিতে গেলে ওতো বড় কোটর লাগবে; বড় কোটর গাছে হতে হলে অনেক বড় গাছ অর্থাৎ শতবছর বা তারও বেশি পুরানো গাছ লাগবে। এগুলো তো বাংলাদেশে নেই। এখন এই দেশে প্রায় বড় গাছ নেই বললেই বলে। যার কোটরে সরালির মতো বড় একটা হাঁস ঢুকে ডিম দিতে পারে।  

‘সুতরাং, সরালি এখন কি করে- ওরা সাধারণত ডাব গাছে অনেক সময় বাসা করে। অথবা মাটিতেও বাসা করে। কিন্তু এসব বাসা প্রায়ই টেকে না। কারণ এই বাসায় ডিম দিয়ে ছানা করতে ওদের প্রায় এক মাস সময় লেগে যায়। এই একমাসের মধ্যে মানুষ ডাব গাছে উঠলেই তো সব শেষ। ’

পাতি সরালির ছানা সম্পর্কে তিনি আরো তথ্য যোগ করে বলেন, ওদের কিন্তু ডাব গাছে বাসা করলেই হলো না- সেখান থেকে ছানাগুলো মাটিতে পড়ে হেঁটে হেঁটে পানিতে যাওয়া চাই। কারণ, এই হাঁসের বাচ্চা নিজে খায় কিন্তু। অন্য পাখির মতো মা তার মুখে তুলে খাবার দেয় না। সুতরাং, ওকে প্রথম দিনই কোনো পানিতে যেতেই হবে– যেখানে ওর খাবার আছে। তার মানে শুধু গাছে বাসা করলেই হলো না, বাসার পাশে কোথায় নিরাপদ পানি লাগবে। যেখানে ছানাগুলো খাবারও পাবে আবার নিরাপত্তাও পাবে। মানুষ ধরে নিয়ে যাবে কিংবা চিলে ধরে নিতে পারে এমন বিপদযুক্ত জায়গা হলে আবার হবে না। এমন জায়গার এত অভাব যে তাদের প্রজননে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এটা অত্যন্ত বেদনার দিক।

কাঁদাপানিতে যুগল পাতি-সরালি।  ছবি: ইনাম আল হককৃত্রিম কাঠের বাক্সের প্রসঙ্গ টেনে ইনাম আল হক বলেন, কোটরে বাসা করে এমন আরেকটা হাঁস অর্থাৎ বালি হাঁস (Cotton Pygmy-goose) গাছের কোটরে বাসা করে বলে তাদের প্রজননের জন্য আমরা কাঠের বাক্স বানিয়ে কৃত্রিম বাসা তৈরি করে দিয়েছিলাম হাকালুকি হাওরে এবং বাইক্কা বিলে। তবে হাকালুকি হাওরের তা কাজ হয়নি। আমার অনুমান, কারণ ওই বাক্সগুলো খোলা জায়গায় দিয়েছিলাম। কিন্তু বাইক্কা বিলে গাছের ফাঁকে ফাঁকে অর্থাৎ হিজল-করচ বনের মাঝে স্থাপিত কৃত্রিম কাঠের বাক্সগুলোতে দারুণ সফলতা এসেছে। প্রতিবছর ব্যাপকভাবে বালিহাঁস সেখানে ডিম পেড়ে ছানা তুলছে এবং ছানাগুলো অনায়াসে জলাভূমিতে টিকে থাকতে পারছে।

‘এই কৃত্রিম কাঠের বাক্সটার মাপ আমরা নিয়েছিলাম ‘আমেরিকান ওডডাক’ এর বাসা থেকে। যেটার সঙ্গে আকারে-প্রকারে মিল আছে আমাদের বালি হাঁসের সঙ্গে। কৃত্রিম কাঠের বাক্সটার উদ্যোগ আমাদের ছিল অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। এই বাক্সগুলো বাইক্কা বিলে দেওয়া হয়েছিল- যেখানে বালিহাঁসও আছে এবং সরালি হাঁসও আসে। বাঁলিহাস তাতে বাসা তৈরি করে ডিম দিয়ে ছানা ফোটালেও একটি সরালি হাঁসও কিন্তু তাতে আজও বাসা করেনি। তার অর্থ আমার কাছে অজানা। তবে অনুমান- ও যে ধরনের গর্তে বাসা করে সেটা এই বাক্স নয়। তার মানে সরালি হাঁসের জন্য উপযোগী করে আমরা যদি কিছু কাঠের কৃত্রিম বাক্স বানাতে পারি তবে হয়তো কাজ হবে। ’

আমরা যেভাবে কাঠের বাক্সে বালিহাঁসের কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে তাকে আমাদের প্রকৃতিতে টিকিয়ে রাখতে পেরেছি; সেভাবে আমরা যদি সরালির জন্য নতুন মাপের কৃত্রিম কাঠের বাক্স তৈরি করে বাইক্কা বিলে স্থাপন করতে পারি তবে হয়তো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সরালি হাঁসকে প্রকৃতিতে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। জানান প্রখ্যাত পাখিবিদ ইনাম আল হক।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৯
বিবিবি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।