ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

পাহাড়ের বুনো কবুতর

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৬
পাহাড়ের বুনো কবুতর ছবি: আবু বকর সিদ্দিক / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): কয়েক বছর আগের কথা। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতর বনের নির্জন লতাগুল্মের সরুপথ ধরে এগোচ্ছি।

দূরে দেখা গেলো সেই সরু পথের সামান্য খোলা জায়গার মাটিতে চরে বেড়াচ্ছে পাঁচ-ছয়টি পাখি। সবগুলোই সবুজ! কী যে অপূর্ব ছিলো সেই দৃশ্যটি! 

যেখানেই দেখা, সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে যেতে হলো। অগ্রসর হলেই ওরা উড়ে যেতে পারে– এই ভয়ে। শরীরজুড়ে তাদের সবুজ লেগে থাকায় তারা বনের লতাপাতার সঙ্গে বেশ মানিয়ে নিজেকে প্রকৃতিগতভাবেই আড়াল করে রাখে। গাছের সবুজপাতাময় ডালে বসলে তাদের খুঁজে বের করা এতো সহজসাধ্য নয়। ডালে বসে না ডাকলে তাদের শনাক্ত করা কঠিন।

সবুজময় এ পাখিটির নাম ঠোঁটমোটা-হরিয়াল। ইংরেজি নাম Thick-billed Green Pigeon আর বৈজ্ঞানিক নাম Treron curvirostra। দেহের আকার ২৭ সেন্টিমিটার। ঠোঁট-মোটা হরিয়াল অন্য হরিয়ালের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বোর্নিয়, সুমাত্রা পর্যন্ত এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের তথ্য মতে, ঠোঁটমোটা-হরিয়াল আমাদের দেশের বিরল আবাসিক পাখি।
সাধারণত বড় ঝাঁকে এদের দেখা যায় না। ৮টা থেকে ১০ অথবা ১২টি পাখির ঝাঁক বেশি দেখা মেলে। প্রায় অন্য সব ঘুঘু আর বন্য কবুতরদের মতো এদেরও ঝগড়া করার বাতিক আছে। বিশেষ করে দু’টি ভিন্ন ঝাঁকের ছেলে পাখি একই ফলের থোকায় মুখোমুখি হলে লড়াইয়ের বিকল্প কমই দেখা যায়। তবে মুখোমুখি লড়াইয়ে সজোরে ডানা ঝাপটানো আর রাগী-শব্দের প্রয়োগ করাটাই বেশি হয়ে থাকে শারীরিক লড়াইয়ের তুলনায়। তবে ঠোঁকর দিয়ে প্রতিপক্ষের পালক তুলে ফেলার মাধ্যমে লাড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে বেশিরভাগ সময়।

পাখি আলোকচিত্রী আবু বকর সিদ্দিক বাংলানিউজকে বলেন, চোখের চারপাশে উজ্জ্বল ফিরোজা রঙের বাহার এদের খুব সহজেই অন্য হরিয়ালদের থেকে আলাদা করতে সাহায্য করে। পাহাড়ের পাদদেশে চিরসবুজ বনে এদের বেশি দেখা যায়। তবে পত্রঝরা বন এমনকি প্যারাবনেও এদের দেখা মেলে। মেয়ে পাখিটি সম্পূর্ণ সবুজ হলেও ছেলে পাখির ডানার উপর আর লেজের নিচ মেরুন রঙের হয়। বিভিন্ন ধরনের ফল বিশেষ করে ডুমুর এদের খাদ্য তালিকায় প্রাধান্য পেলেও বীজ বা শস্য খেতেও দেখা যায় এদের।

প্রজনন সম্পর্কে তিনি বলেন, অন্য পাখিদের তুলনায় এরা সাধারণত একটু আগেভাগে প্রজনন করে। মার্চের শেষ থেকে মে-জুন পর্যন্ত প্রজনন করতে দেখা গেলেও মূলত এপ্রিলে বেশি দেখা যায়। অনেক বন্য পাখিদের তুলনায় এরা খুব দ্রুত বাসা বানাতে পারে। ছেলে পাখিটি বাসা বানানো ও ডিমে তা দেওয়ায় মেয়ে পাখিটিকে সমানভাবে সাহায্য করে।

আবু বকর সিদ্দিক বাংলানিউজকে ছবি তোলার মুহূর্ত সম্পর্কে বলেন, চলতি বছরের মে মাসে মুনতাসির আকাশ ও আমি সাতছড়িতে পাখির ছবি তুলতে এসে জানতে পারি সাইক্লোন রোয়ানু ধেয়ে আসছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেইওয়াচ টাওয়ারেই বেশি সময় দেওয়ার। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই হঠাৎ দু’টি ঠোঁট-মোটা হরিয়াল উড়ে এসে সামান্য দূরের গাছটিতে বসে। বৃষ্টির বাড়া-কমায় তেমন একটা অন্য পাখিদের না দেখা যাওয়ায় এবং সারারাত র্নিঘুম থাকায় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি সেখানে। ঘণ্টা দুয়েক ঘুমানোর পরে উঠে দেখি পাখি ওই পাখিগুলো তখনও রয়েছে।

পরেরদিন সাইক্লোনটি বাংলাদেশের উপর দিয়ে পার হওয়ায় আবহাওয়া আরও খারাপ হয়। ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি ধারার মধ্যে ওয়াচ টাওয়ারে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে পাখির ছবি তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। তখনই ৭টা ঠোঁট-মোটা হরিয়াল একটি মরা গাছের মগডালে এসে বসে। কিছু ছেলেপাখি মাথা উপর-নিচ করে মেয়েপাখিকে পটানোর চেষ্টা করছিল। এমন দৃশ্য বুনো পরিবেশে  নিঃসন্দেহে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখবে সারাজীবন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৬
বিবিবি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।