ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

হারিয়ে যাচ্ছে কংসের ‘মহাশোল’

মাহবুব আলম, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৪
হারিয়ে যাচ্ছে কংসের ‘মহাশোল’

ঢাকা: ভাটি বাংলার কংস ও সোমেশ্বরী নদের মিঠাপানির মাছ মহাশোল। স্বাদু পানির এ সুস্বাদু মাছটি এখন আর আগের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে না জেলের জালে।



নেত্রকোনা জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, বিলুপ্তপ্রায় মহাশোলের ইংরেজি নাম ‘Mahseer’ । পাহাড়ি খরস্রোতা স্বচ্ছ পানির নদীতে এর আবাস। নদীর পাথর-নুড়ির ফাঁকে ফাঁকে ‘পেরিফাইটন’ নামের এক রকমের শ্যাওলা জন্মে। এগুলোই মহাশোলের প্রধান খাবার।

মহাশোল সর্বোচ্চ ১৫ মিটার গভীর পানিতে চলাচল করতে পারে। পানির উষ্ণতা ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি  সেলসিয়াস পর্যন্ত এদের জীবন ধারণের পক্ষে সহায়ক। এ মাছ দেখতে অনেকটা মৃগেল মাছের মতো।

তবে এর আঁশগুলো আরও বড়। পরিণত মাছের আঁশ শক্ত, উজ্জ্বল সোনালি রঙের ও দীপ্তিমান। পাখনা ও লেজ রক্তিম বর্ণের। এছাড়া নাকের সামনে ছোট্ট দুটি গোঁফের মতো রয়েছে। সব মিলিয়ে দেখতে খুব সুন্দর।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রনজিৎ কুমার পাল বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের মিঠাপানির মাছের মধ্যে মহাশোল স্বাদেও সেরা। মহাশোলের দুটি প্রজাতি। একটির বৈজ্ঞানিক নাম Tortor, অন্যটি Torputitora। বাংলাদেশে দুই প্রজাতির মহাশোলই পাওয়া যেতো।

‘তবে নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টার কংস নদ ও দুর্গাপুরে পাহাড়ি সোমেশ্বরী নদ মহাশোলের মূল আবাস। তবে বর্তমানে এই নদের উৎসমুখ প্রায় বন্ধ। শুকনো মৌসুমে নদী দু’টি প্রায় শুকিয়ে যায়। – যোগ করেন তিনি।

রণজিৎ পাল জানান, বসবাস ও বংশবৃদ্ধির জায়গা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এর পরিচিতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। একপর্যায়ে এসব এলাকায় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে প্রজাতিটি।

সোমেশ্বরী ও কংস ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে দু’একবার টাঙ্গুয়ার হাওর এবং চট্টগ্রামের সাঙ্গু নদেও মহাশোল পাওয়া গেছে বলে জানান এই জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।    

সুনামগঞ্জের স্কুল শিক্ষক মোহাম্মদ কাঞ্চন বাংলানিউজকে জানান, টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ধরা মহাশোলের পোনা সুনামগঞ্জ ও আশপাশের বাজারে জেলেদের কাছে বিক্রি করতে দেখা যায় মাঝে মধ্যে। তবে অনেক দাম হাঁকেন তারা।

সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, মহাশোল মাছটি অনেক বড় হয়। তবে মাঝে মধ্যে সুনামগঞ্জ বাজারে যেসব পোনা দেখা যায় সেগুলো প্রায় ৭-৮ ইঞ্চি লম্বা। এসব পাওয়া খুবই দুষ্কর।

কংস তীরের বাসিন্দা ও সৌখিন মাছ শিকারি চরপাড়া গ্রামের আশি ঊর্ধ্ব আব্দুল কাদির বাংলানিউজকে বলেন, এ মাছ মূল পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে। সেই হিসেবে কংস ও সোমেশ্বরীতেই বেশি দেখা যেত। এখন তো এটি চোখেও দেখি না।

স্থানীয়রা জানান, এ মাছটি মাঝে মধ্যে বারহাট্টা, কলমাকান্দা, মধ্যনগর, মোহনগঞ্জ, ধর্মপাশা ও নেত্রকোনার মেছুয়া বাজারে পাওয়া যায়। তবে তা খুবই কম।

কংস নদের তীরের রায়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলী আকবর তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, এটি বিলুপ্তপ্রায় বলে শুনেছি। যেহেতু এলাকায় এখনো কালে-ভদ্রে পাওয়া যায় তখন পোনা ধরা বন্ধ করে এর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি টাঙ্গুয়ার হাওর ও নেত্রকোনার ভাটি এলাকায় মহাশোলসহ বিভিন্ন মাছের পোনা মাছ শিকার করা হয়, এও বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

মহাশোল মাছ নিয়ে এখনো বিস্তৃত কোনো তার জানা নেই উল্লেখ করে রণজিৎ কুমার পাল জানান, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে জীবজগতের স্বাভাবিক আচরণগত বৈশিষ্ট্যেও পরিবর্তন ঘটেছে। মাছের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

যেমন ইলিশ মাছের বিচরণক্ষেত্র ও স্বাদের অনেকটা পরিবর্তন ঘটেছে। মহাশোলের  ক্ষেত্রেও এমন পরিবর্তন ঘটতে পারে।
 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মহাশোলের বংশ রক্ষার জন্য ময়মনসিংহে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্র কাজ করছে। সেখানে সফলভাবে এর পোনা উৎপাদন করা হয়েছে এবং যথেষ্ট মজুদও রয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে সেখানকার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, এখানে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত অত্যন্ত সুস্বাদু, দুর্লভ ও বিপন্ন প্রায় মহাশোলের পোনা পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, তবে মহাশোলের চাষ বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি। পুকুরে মাছটির বৃদ্ধি খুবই ধীর। দুই বছরে দেড় থেকে দুই কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। এ কারণে মৎস্যচাষিরা বাণিজ্যিকভাবে মহাশোল চাষে উৎসাহিত হন নি।

তবে বিলুপ্ত প্রায় সুস্বাদু মাছ চাষে কেউ আগ্রহী হলে ময়মনসিংহের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।