কখনো সাংবাদিক, কখনো মানবিক কর্মী, কখনো সামাজিক আন্দোলনকর্মী কখনো উপকূল বন্ধু, কখনো বা পরিবেশযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত নাম শফিকুল ইসলাম খোকন। তিনি একজন গণমাধ্যমকর্মী।
বর্তমানে শফিকুল ইসলাম খোকন উপকূলের পরিবেশ রক্ষায় এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বিরামহীন। প্রথম ‘হিউম্যান বুক’ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শফিকুল ইসলাম খোকন সামুদ্রিক প্রোটিন, জীবন-জীবিকা,পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ সমুদ্র অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে সাগরে জেলেদের প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলতে স্বেচ্ছায় সচেতন করছেন।
দীর্ঘদিন তিনি পাথরঘাটার বৃহত্তম মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের ঘাটে এবং বিভিন্ন খালে নোঙর করা সমুদ্রগামী মাছ ধরা ট্রলারের জেলেদের এমন সচেতন করছেন।
উপকূলের জেলেরা তাদের জীবন-জীবিকার জন্য গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করতে যায়। এক একটি মাছ ধরা ট্রলারে ১৫ থেকে ২০ জন জেলে থাকেন এবং তারা ১০ থেকে ১৫ দিন গভীর সমুদ্রে অবস্থান করেন।
এ সময় তাদের ব্যবহৃত কোমলপানীয়ের বোতল, কসমেটিকসের মোড়ক, নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যসহ পলিথিন ব্যাগ সাগরে ফেলছে। এ কারণে সমুদ্রের তলদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য জমে থাকায় সামুদ্রিক প্রোটিনের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যও হারাচ্ছে। দিন দিন তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। ক্ষতিকারক জেনেও মানুষের মধ্যে দিন দিন পলিথিন ও প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবহার এবং অব্যবস্থাপনার হার ক্রমেই বাড়ছে। সাগরে জেলে সম্প্রদায়ই বেশি অবস্থান করার কারণে সমুদ্রগামী জেলেদের সাগরে যত্রতত্র প্লাস্টিকের বর্জ্য যাতে না ফেলে এজন্যই এই ব্যতিক্রমই উদ্যোগ নিয়েছেন শফিকুল।
এ পর্যন্ত তিনি অন্তত ৫০টির বেশি মাছ ধরা ট্রলারের জেলেদের সাগরে প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলায় ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরেছেন এবং সমুদ্র অর্থনীতি তথা সমুদ্রে মাছসহ প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়ে তিনি হাতে কলমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। জেলেরা সাগর থেকে মাছ শিকার করে ঘাটে আসা মাত্রই ছুটে যান তিনি। জেলেরা সাগরে থাকাবস্থায় ট্রলারে বস্তা, ড্রাম বা ঝুড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মালামাল সংরক্ষণ করে কূলে এসে নির্ধারিত জায়গা ফেলতে উদ্বুদ্ধ করছেন তিনি।
শফিকুল ইসলাম খোকন পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক নাগরিক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন, পাশাপাশি স্থানীয় তরুণদের সংগঠিত করতে পরিবেশ রক্ষায় ‘পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছেন।
কথা হয় শফিকুল ইসলাম খোকনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, বাণিজ্যিক জাহাজের পাশাপাশি সমুদ্রে হাজারো মাছ ধরা ট্রলার থাকে। এসব ট্রলারের জেলেরা প্রতি ট্রিপেই কোনো না কোনোভাবে প্লাস্টিক নিয়ে যাচ্ছে যা সমুদ্রেই ফেলে দিচ্ছে। এতে করে হুমকির মুখে সমুদ্র, এ রকম চলতে থাকলে এক সময় থাকবে না আর কোনো সামুদ্রিক মাছ। অতিরিক্ত মাছ ধরা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্লাস্টিকের দূষণের কারণে বিশ্বের সাগর-মহাসাগর এখন হুমকির মুখে।
কীভাবে এই ব্যতিক্রম কাজে আসা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি সাংবাদিকতার পেশার কারণে অনেক সময় মানুষের কাছে যেতে হয় তথ্য অনুসন্ধান করতে হয়। জেলেদের কাছ থেকে দেখেছি তারা কতটা প্লাস্টিক ব্যবহার করছে সাগরে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলের পাশাপাশি সমুদ্রও ঝুঁকিতে রয়েছে। তাছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার কারণে আরও ক্ষতির সম্মুখীন সমুদ্রসহ সামুদ্রিক সম্পদ। সমুদ্রগামী জেলেদের এক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে। এ কারণেই আমি জেলেদের বেছে নিয়েছি। জেলেরা যেমন আমাদের সম্পদ, এ সম্পদকেই কাজে লাগানো যায়। তাদের সচেতন করতে পারলে হয়তো বা একদিন সমুদ্রে প্লাস্টিক ফেলা বন্ধ হবে। ইতঃপূর্বে আমি বেশ কয়েকটি ট্রলারে প্লাস্টিক রাখার জন্য নির্ধারিত জায়গা করে দিয়েছি, যাতে করে সাগরে না ফেলে কূলে এসে নির্ধারিত জায়গায় ফেলেন তারা। কতটুকু সফল হবো জানি না, তবে এগিয়ে যাচ্ছি।
জেলেদের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সাগরকে রক্ষার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করা জেলে আবদুল কাদের, বেলায়েত হোসেন, জাহাঙ্গীর মাঝিসহ একাধিক জেলেরা বলেন, সাগরে যখন মাছ ধরতে যাই, তখন আমাদের সাথে অনেক প্লাস্টিক ও পলিথিন থাকে। সেগুলো ব্যবহার শেষে সাগরেই ফেলে দিয়ে আসি। এর ক্ষতিকর বিষয় আমরা আগে জানতাম না। তবে সাংবাদিক খোকন ভাই প্রায়ই আমাদের কাছে আসেন ও সাগরে প্লাস্টিক নিয়ে যেতে নিষেধ করেন। প্রথমে আমরা তার কথাগুলো হাস্যকর হিসেবে নিতাম। পরে যখনই তার কথায় ক্ষতিকর বিষয় বুঝতে পারলাম তখন থেকেই সচেতন হলাম।
তারা আরও বলেন, সাগরমুখী জেলেরা যদি প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করে তাহলে সাগর অনেকটা ভালো থাকবে। যেহেতু আমাদের জীবিকা সাগরের ওপর নির্ভর, আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। আমরাও চেষ্টা করছি সাগরে প্লাস্টিক না নেওয়ার। খোকন ভাইয়ের দেওয়া বক্সে প্লাস্টিক রাখছি, যা কূলে এসে নির্ধারিত জায়গায় ফেলে দেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার কীর্তনীয়া বলেন, এটি অবশ্যই ব্যতিক্রম কাজ। সাগর এখন ধ্বংসের পথে। আর এ পথ থেকে রক্ষা করতে পারে জেলেরাই। খোকনের এমন কাজকে স্বাগত জানাই পাশাপাশি তার এ কাজ সমাজ এবং রাষ্ট্রও কাজে লাগাতে পারে।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, সাগরে প্রতিদিনই অসংখ্য ট্রলার মাছ শিকার করতে যায়। প্রতিটি ট্রলারেই জেলেরা প্লাস্টিক নিয়ে যায়, যা সাগরেই ফেলে দিয়ে আসে। প্লাস্টিক সাগরে ফেলার কারণে লাভ-ক্ষতি জেলেরা হিসেব করে না। তবে আমরা যতটা জানতে পেরেছি সাগরে প্লাস্টিকের কারণে সামুদ্রিক মাছসহ সাগরের অনেক ক্ষতি হয়। জেলেরা আসলে এ বিষয় সচেতন না। আমি দীর্ঘদিন দেখছি শফিকুল ইসলাম খোকন জেলেদের মাঝে এ বিষয় সচেতন করছেন। তার এমন কাজ আসলেই ব্যতিক্রম। এ কাজ যদি অব্যাহত রাখা যায় তাহলে জেলেরা সচেতন হওয়ার কারণে সাগরে আর প্লাস্টিক পণ্য নিয়ে যাবে না।
এএটি