ঢাকা: সদ্য সমাপ্ত দশম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকে প্রার্থীদের জয়ের হার আগের তুলনায় ১০ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে শক্তিশালী হয়েছে নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিরাও।
২০১৬ সালের নবম ইউপি নির্বাচন ও ২০২১-২০২২ সালের দশম ইউপি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ইউপির সংখ্যা চার হাজার ৫৭৪টি। এগুলোর মধ্যে ৪ হাজার ১৩৭টি ইউপিতে ভোটগ্রহণের জন্য তফসিল দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নানা কারণে বেশকিছু ইউপি ভোট স্থগিত থাকায় ভোটগ্রহণ হয়েছে চার হাজার ৫৮টি ইউতে। অর্থাৎ আইনি জটিলতা ও অন্যান্য কারণে স্থগিত ৫১৬টি ইউপিতে ভোট হবে পরবর্তীতে। ২০২১ সালের ২১ জুন থেকে ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট ধাপের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করে ইসি।
ইসির উপ-সচিব মো. মিজানুর রহমানের তৈরি করা নির্বাচনী প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ আওয়ামী দুই হাজার ১৯৭টি ইউপিতে জয় লাভ করেছে। অর্থাৎ নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ৫৪ দশমিক ১৪ শতাংশ ইউপিতে।
আগেরবার ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত চার হাজার ৮৭টি ইউপির মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা দুই হাজার ৬৪৫টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছিলেন, যা সব ইউপির ৬৪ দশমিক ৭২ শতাংশ।
এ হিসেবে গতবারের চেয়ে ১০ শতাংশ কম ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা।
এদিকে এবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও বিএনপির অঘোষিত (দলটি নির্বাচন বর্জন করলেও অনেক নেতাকর্মীই অংশ নিয়েছিলেন) প্রার্থীরা মিলে অর্থাৎ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছে এক হাজার ৭৯১টি ইউপিতে, যা মোট ইউপির ৪৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
আগেরবার বিএনপি ও স্বতন্ত্র (৩৬৭ ও ৮৭৪) প্রার্থীরা জয় পেয়েছিলেন এক হাজার ২৪১টি ইউপিতে, যা মোট ইউপির ৩০ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
গত দু’বারের তুলনায় করলে দেখা যায়, প্রান্তিক এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল মনোনীত প্রার্থীদের বিরোধী শক্তিগুলো ১৪ শতাংশের মতো বেশি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদ বাগিয়ে নিয়েছে।
জাতীয় পার্টি গতবার ৫৫টি ইউপিতে জয় পেলেও এবার পেয়েছে ৪৪টি ইউপিতে। এছাড়া অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে এবার বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি, জাতীয় পার্টি (জেপি) সাতটি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আটটি, খেলাফত মজলিস একটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ দুটি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ তিনটি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি দুটি ও জাকের পার্টি একটি ইউপিতে জয় পেয়েছে, যা মোট ইউপির দশমিক ৬৪ শতাংশ।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থী:
দশম ইউপি নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ৩৬৭ জন প্রার্থী। এদের মধ্যে রয়েছে স্বতন্ত্র থেকে সাতজন। আর ৩৬৭ জনই নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। অন্যদিকে ২০১৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ২০৭ জন। এদের মধ্যে দুজন স্বতন্ত্র থেকে, আর বাকি ২০৫ জনই নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। এবারের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যাগত দিক থেকে অতীতের সব ইউপি নির্বাচনের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
২১টি দল:
২০১৬ সালে ১৭টি দল ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও এবার দিয়েছিল ২১টি রাজনৈতিক দল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় পার্টি-জেপি, জাকের পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির অর্জন থাকলেও ১১টি দল কোনো অবস্থান করতে পারেনি। এগুলো হলো- জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাতীয় গণতান্ত্রিক দল, এলডিপি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
ভোটের হার:
আট ধাপে এবার ভোট পড়েছে ৭২ দশমিক ২০ শতাংশ। এরমধ্যে প্রথম ধাপে ৬৭ দশমিক ০৪ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে ৭৩ দশমিক ৬১ শতাংশ, তৃতীয় ধাপে ৭৪ দশমিক ২১ শতাংশ, চতুর্থ ধাপে ৭২ দশমিক ৪১ শতাংশ, পঞ্চম ধাপে ৭৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ষষ্ঠ ধাপে ৬৯ দশমিক ০৭ শতাংশ, সপ্তম ধাপে ৭৩ দশমিক ০৪ শতাংশ ও অষ্টম ধাপে ৭১ দশমিক ০২ শতাংশ ভোট পড়েছে।
কোন ধাপে কত ইউপির নির্বাচন:
প্রথম ধাপের প্রথম অংশে ২০৪টি ইউপিতে ২০২১ সালের ২১ জুন ভোট হয়, দ্বিতীয় অংশে ১৬০টি ইউপিতে ২০ সেপ্টেম্বর; দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৩ ইউপিতে ১১ নভেম্বর; তৃতীয় ধাপে ৯৯২টি ইউপিতে ২৮ নভেম্বর; চতুর্থ ধাপে ৮১৯টি ইউপিতে ২৬ ডিসেম্বর; পঞ্চম ধাপে ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি ৬৯২টি ইউপিতে; ষষ্ঠ ধাপে ৩১ জানুয়ারি ২১৬টি ইউপিতে, সপ্তম ধাপে ১৩২টি ইউপিতে ৭ ফেব্রুয়ারি এবং অষ্টম ধাপে নয়টি ইউপিতে ১০ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
ইভিএম:
২০১৬ সালে প্রথমবার দলীয়ভাবে ও স্থানীয়ভাবে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় কোনো ইউপিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ব্যবহার করা হয়নি। তবে এবারের নির্বাচনে ৩৮৯টি ইউপিতে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে ষষ্ঠ ধাপে ২১৬টি ইউপির সবগুলোতে ভোট হয় ইভিএমে। যন্ত্রে ভোট নেওয়ার ইতিহাসে এতো বড় পরিসরে আর ভোট করেনি ইসি। শুধু তাই নয়, যেখানে ইভিএমে ভোট পড়ার হার ৬০ শতাংশই ছুঁতে চায় না, সেখানে এ ধাপে ভোটও পড়ে অতীতে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে, ৬৯ দশমিক ০৭ শতাংশ।
নারী চেয়ারম্যান:
২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে ১৬ জনের মতো নারী প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয় লাভ করেন। এদিক থেকেও অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৩০ জনের মতো নারী এবার বিভিন্ন ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছেন। এদের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গে একজনও এ আসনটি অলংকৃত করেছেন।
নির্বাচনী সহিংসতা:
কেএম নূরুল হুদা কমিশনের নেতৃত্বাধীন বড় পরিসরে শেষ এ নির্বাচনটি সবচেয়ে বেশি তাদের সমালোচনার মুখে ফেলে। কেননা, তারা নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হন। নির্বাচনে ১২৭ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানী হয়। আহত হন কয়েক হাজার মানুষ। ইউপি নির্বাচনের ইতিহাসে এটিও একটি রেকর্ড।
বাংলাদেশ সময়: ২০১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২২
ইইউডি/আরআইএস