খুলনা: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথামার্ধেই হতে যাচ্ছে— এমন খবরে চারদিকে নির্বাচনী ডামাডোল বাজছে। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে সবখানেই চলছে নির্বাচনী আলোচনা।
খুলনা-১ আসন:
বটিয়াঘাটা ও দাকোপ উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-১ আসন। এটি জাতীয় সংসদের ৯৯ নম্বর আসন। দাকোপ উপজেলায় ৯টি ও বটিয়াঘাটায় ৭টি ইউনিয়ন এবং চালনা পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ আসনটি হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত।
খুলনা জেলা নির্বাচন অফিসের চলতি বছরের মার্চ মাসের তথ্য মতে, এ আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৩ হাজার ৪৪৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫০ হাজার ৩৮৪, নারী ভোটার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬০ ও হিজড়া ভোটার ৩ জন।
নৌকার দুর্গে হানা দিতে প্রস্তুত যারা:
খুলনা-১ আসনে বিগত সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতারা জয়ী হলেও দলটি নিষিদ্ধ থাকায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের কোনো প্রার্থী থাকবে না। যে কারণে এ আসনে ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরা। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম আওয়ামী লীগের এ দুর্গটি হাতছাড়া হবে। এ আসনে অতীতে নির্বাচনে অংশ নেওয়া জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আমির এজাজ খান তৎপর রয়েছেন। আহ্বায়ক পদ হারিয়ে তিনি কিছুটা চাপে থাকলেও নির্বাচনী প্রচারে ব্যাপক সক্রিয় রয়েছেন। সাবেক ছাত্রদল নেতা জিয়াউর রহমান পাপুলও বেশ সক্রিয় প্রচারণায়। ইতিমধ্যে এ আসনে বটিয়াঘাটা উপজেলা আমির শেখ আবু ইউসুফকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। তিনিও এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী খুলনা জেলার সহ-সভাপতি মাওলানা আবু সাঈদ। জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রেসসচিব সুনীল শুভ রায়ও এ আসনে নির্বাচন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। আসনটিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি-এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজু প্রার্থী হবেন বলে শোনা গেলেও এলাকায় তার পক্ষে কোনো তৎপরতা নেই।
সম্ভাব্য প্রার্থীরা যা বলছেন:
২০০১, ২০০৮, ২০১৮ তিনবার এ আসনে ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে লড়েছেন আমির এজাজ খান। প্রায় অর্ধশত মামলার আসামি তিনি। শেখ হাসিনার পতনের পর ১টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। নির্বাচনী মাঠে সরব তিনি। দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে করছেন মোটরসাইকেল শোডাউন।
জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আমির এজাজ খান বাংলানিউজকে বলেন, আল্লাহর রহমতে আমি যদি জীবিত থাকি নির্বাচনে অংশ নেব। সব ধরনের প্রস্ততি রয়েছে আমার। হিন্দু অধ্যুষিত এ এলাকায় আমি ৩০ বছর ধরে রাজনীতি করি। এ আসনের হিন্দুরা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। জেতার ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজ বিজ্ঞান অনুচ্ছেদে অধ্যায়নরত অবস্থায় স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী ৯০- এর আন্দোলনে সম্মুখভাগে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতা জিয়াউর রহমান পাপুল। খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার বিরেটে তার জন্ম। ৯০ ঢাকসু নির্বাচনে হাজী মহসিন হলের ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।
স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মতবিনিময় ও জনসংযোগ করছেন তিনি। স্থানীয় সংখ্যালঘু ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গেও কুশল বিনিময়সহ তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন এ নেতা। দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে করছেন মোটরসাইকেল শোডাউন।
সাবেক ছাত্রদল নেতা জিয়াউর রহমান পাপুল বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচনের জন্য আমার প্রস্তুতি নেওয়া আছে। এ আসনে আমরা ভোটবিপ্লব করতে চাই। অল্প সময়ে আমরা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। বিগত দিনে প্রার্থী যারা ছিলেন, তেমন কোনো যোগ্যতা তাদের ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সাড়া ফেলেছি।
বটিয়াঘাটার রণজিতের হুলা দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট উপজেলা জামায়াতের আমির শেখ আবু ইউসুফ। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে ৬টি মামলার আসামি ছিলেন তিনি। ৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতের আমির শেখ আবু ইউসুফ বাংলানিউজকে বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগের দুর্গ খ্যাত এ আসনের মানুষ আমাদের ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে। আমরা মনে করি, জনগণ জামায়াতকে ভোট দেবে। কেননা ৫ আগস্টের পর জামায়াত কোথাও ভাংচুর, লুটপাট, চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত হয়নি। হাট বাজার গ্রাম গঞ্জে গণসংযোগ করছি, মানুষের সাড়া পাচ্ছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের খুলনা জেলার সহ-সভাপতি মাওলানা আবু সাঈদ বাংলানিউজকে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের প্রস্তুতি ভালো। এককভাবে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছি। অচিরে ব্যাপক আকারে প্রচার প্রচারণা চালাবো ইনশাল্লাহ। বিগত দিনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আমাদের ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। অনেক এলাকা আছে যেখানে ১২ আনা ভোট হাত পাখার।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রেসসচিব সুনীল শুভ রায়। তিনি এ আসনে কয়েকবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
সুনীল শুভ রায় বাংলানিউজকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা আছে। যদি নির্বাচন করার সেই রকম পরিস্থিতি হয়, অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং জনগণ চাইলে আমি প্রার্থী হতে পারি। শুধু দল বা আমার ইচ্ছায় নির্বাচন করতে চাই না। জনগণের চাওয়াটাকে প্রাধান্য দিতে চাই। আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি-এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক দলিত নেতা ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজুর বাড়ি ঢাকায় হলেও তিনি খুলনা-১ আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী। কেননা এ আসনটিকে হরিজন, দলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথমবার জাতীয় রাজনীতিতে জায়গা পেলেন দলিত জনগোষ্ঠীর এই নেতা। দলিত জনগোষ্ঠীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য ২০০৫ সাল থেকে লড়াই করছেন ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজু। তিনি তেলুগু সম্প্রদায়ের সন্তান।
ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজু বাংলানিউজকে বলেন, দল থেকে এখনও প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে দল যদি মনে করে এবং আমাকে খুলনা-১ আসনের প্রার্থী করে, তাহলে আমি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি।
খুলনা-১ আসনের বিগত নির্বাচনের ফলাফল:
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ননী গোপাল মণ্ডল এক লাখ ৪২ হাজার ৫১৮ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তার নিকটতম স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রশান্ত রায় ঈগল প্রতীকে পান পাঁচ হাজার ২৬২ ভোট।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-১ আসনের ১০৭টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের পঞ্চানন বিশ্বাস এক লাখ ৭২ হাজার ৫৯ ভোট পেয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আমীর এজাজ খান পেয়েছিলেন ২৮ হাজার ৪৩৭ ভোট।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ননী গোপাল দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চাকা মার্কায় নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে ননী গোপাল হেরে যান। পরে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পঞ্চানন ৬৬ হাজার ৯০৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ননী গোপাল মণ্ডল ৩৪ হাজার ৫২৭ ভোট পান।
এর আগে ২০০৮ -এর নির্বাচনে এই আসন থেকে ননীগোপাল মন্ডল পেয়েছিলেন এক লাখ ২০ হাজার ৮০১ ভোট। তখন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী আমীর এজাজ খানের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬৮ হাজার ৪০২।
পঞ্চানন বিশ্বাস ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। ওইবার ৭৮ হাজার ৫৫২ ভোট পেয়ে বিএনপি জোটের প্রার্থীকে পরাজিত করেন। ওই নির্বাচনে খুলনা জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি একাই জিতেছিলেন।
এর আগে ১৯৯১ সালে এই আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হারুনুর রশিদ। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রথমবার এমপি হন পঞ্চানন বিশ্বাস। তবে সেবার আ. লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন তিনি। দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন শেখ হারুনুর রশিদ।
পঞ্চানন বিশ্বাস ওই উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টেলিভিশন প্রতীকে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। পরে পঞ্চানন আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
স্বাধীনতার পর আসনটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের এম এ খায়ের, ১৯৭৯ সালে বিএনপির সৈয়দ মোজাহিদুর রহমান, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের শেখ হারুনুর রশিদ, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির শেখ আবুল হোসেন, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের শেখ হারুনুর রশিদ বিজয়ী হয়েছিলেন। এরপর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনে এমপি হয়েছিলে বিএনপির প্রফুল্ল কুমার মন্ডল। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
এমআরএম