ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিক্ষা

সেই তামান্না দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫০ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২২
সেই তামান্না দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা 

যশোর: জন্মগতভাবেই দুই হাত ও এক পাবিহীন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সেই তামান্না আক্তার নুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।  

শনিবার (৩০ জুলাই) দুপুর ১২টা-১টা পর্যন্ত যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমিক ভবনের কেন্দ্রীয় গ্যালারিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন।

 

তামান্না যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া আলীপুরের রওশন আলী ও খাদিজা পারভীন শিল্পী দম্পতির সন্তান।  

অদম্য ওই তরুণী শুধুমাত্র একটি পা দিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সবকটি পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে চমক দেখিয়েছিলেন। তার এই সাফল্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনা খোঁজখবর নেন।

একইসঙ্গে তারা দুই বোন তামান্নার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন। তার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থাও করেছিলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (যবিপ্রবি) স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে পরীক্ষা শুরুর দেড় ঘণ্টা আগে উপস্থিত হন তামান্না।

চলাচলের একমাত্র বাহন সেই হুইল চেয়ারেই এদিন পরীক্ষা দিতে আসেন অদম্য এই তামান্না। ভালো ফলাফলের পরেও এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পাওয়াতে এবার যবিপ্রবিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে অনেকটাই চাপে ছিলেন এই পরীক্ষার্থী। তবে পরীক্ষা দেওয়ার পরে অনেকটাই ফুরফুরে মেজাতে ছিলেন তিনি।  

পরীক্ষা শেষে  অনুভূতি জানতে চাইলে তামান্না বলেন, আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছে, আমি আশাবাদী ভালো কিছু হবে।  

বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন বিশেষ করে উপাচার্য স্যার আমাকে মানসিকভাবে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন।  

তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও কোন বিষয়ে পড়তে চান এই বিষয়ে জানতে চাইলে তামান্না বলেন, যদিও আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনেক ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমার শারীরিক অবস্থা ও সার্বিক বিষয় বিবেচনা করলে আমরা পক্ষে ওখানে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আমি যশোরে থেকে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করতে চাই। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখানে ভর্তি হতে পারি।

তামান্নার বাবা রওশন আলী জানান, ‘ছোটবেলা থেকে তামান্না খুব মেধাবী। নিজের ইচ্ছা শক্তি দিয়েই এই জায়গায় এসেছে। অনেক কষ্ট ও মেধার জোর দিয়ে সবকয়েকটি পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। তার স্বপ্ন গবেষণাধর্মী কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি নেওয়ার। স্বপ্ন পূরণে কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। দুঃভাগ্য সেখানে তার চান্স হয়নি।

শনিবার যবিপ্রবিতে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পরীক্ষা ভালো হয়েছে বলে সে জানিয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে রওশন আলী বলেন, ‘আমি একটি ননএমপিওভুক্ত দাখিল মাদরাসার শিক্ষক। টিউশনি করে সংসার চালায়। তার পক্ষে জেলার বাইরে পড়াশুনার খরচ বহন করাও সম্ভব হয়ে উঠবে না। তাছাড়া তামান্না যেখানেই পড়াশুনা করবে সেখানে তার সঙ্গে পরিবার থাকা লাগবেই। কেননা তার চলাচলে সব কাজে একজনের সহযোগিতা ছাড়া সে সম্পন্ন করতে পারে না। তাই তার ইচ্ছা বাড়ির কাছে নিজ শহরে যবিপ্রবিতে পড়াশুনা করার। এখানেই তামান্না চান্স পেলে আমার পরিবারের সবার জন্যই ভালো। আমার চাকরিটাও করা যাবে; আবার সে ভালোভাবে লেখাপড়াটাও করতে পারবে।  

যবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, সারা বাংলাদেশে আমরা খবর পেয়েছি, দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষাটি অত্যন্ত সুষ্ঠু ও নির্বেঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে।

যবিপ্রবি কেন্দ্রে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছেন, আমরা তাদের প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করেছি। শিক্ষার্থীদের দুর্দশা লাঘবে গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি একটি সফল পদ্ধতি হিসেবে প্রমাণতি হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য তিনি যবিপ্রবির সব শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তামান্নার জন্ম। তামান্নার বাবা রওশন আলী ঝিকরগাছা উপজেলার দাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার (ননএমপিও) শিক্ষক। মা খাদিজা পারভীন গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তামান্না সবার বড়। ছোট বোন মুমতাহিনা রশ্মি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ভাই মুহিবুল্লা তাজ প্রথম শ্রেণিতে। ছয় বছর বয়সে তামান্নাকে পায়ে কাঠি দিয়ে লেখানোর চেষ্টা করে তার পরিবার। সেখান থেকে তার ইচ্ছা শক্তির ওপর ভর করে বাঁকড়া আজমাইন এডাস স্কুলে ভর্তি হয়। সেখানে মাত্র দুই মাসের মাথায় ও পা দিয়ে লিখতে শুরু করেন। এরপর ছবি আঁকা শুরু করে তামান্না। তার আঁকা অনেক ছবি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়েছেন তামান্না।

গেল বছরে এইচ এসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পরে গত ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করাসহ দুটি স্বপ্নের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তামান্না।

সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি পৃথক দুটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অডিওকলে ফোন দিয়ে তামান্নাকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনা।

একইসঙ্গে দুই বোন তামান্নার স্বপ্ন পূরণে যে কোনো সহযোগিতার আশ্বাস দেন।  

একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তামান্নাকে তার স্বপ্ন পূরণে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টে আবেদন করার পরামর্শ দেন।

এরপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তামান্নাকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।

সেখানে বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেনের তত্ত্বাবাধয়নে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরবর্তীতে দেশের বাইরে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল টিমটি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২২
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।