ঢাকা, শুক্রবার, ৭ ভাদ্র ১৪৩২, ২২ আগস্ট ২০২৫, ২৭ সফর ১৪৪৭

অর্থনীতি-ব্যবসা

স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য জ্বালানিতে গুরুত্ব দিতে হবে

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:০৩, আগস্ট ২০, ২০২৫
স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য জ্বালানিতে গুরুত্ব দিতে হবে

ঢাকা: দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। আর একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা অপরিহার্য।

জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়- যা দেশের রপ্তানি আয়, কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এজন্য দেশের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গুরুত্ব দিতে হবে। আর এ খাতে বিনিয়োগ করলে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলেন, বিদেশি উদ্যোক্তারা জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না পেলে এদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয় না। ফলে এফডিআই কমে যায়, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ অবস্থায় জ্বালানি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথটি দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাড়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা থেকে দেশকে সুরক্ষিত রাখে বলে মনে করেন তারা।

সম্প্রতি জ্বালানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যাংক সুদ ও  মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি  মাহবুবুর রহমান, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকখাত মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ' র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু ও আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহ-সভাপতি প্রার্থী  ব্যবসায়ী নেতা ও ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম।

দেশের শীর্ষ এ তিন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাই মনে করেন, জ্বালানি নিরাপত্তায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি হলো এমন একটি অবস্থা-যখন কোনো দেশ তার প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে এবং বিদেশি উৎস যেমন- আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো জ্বালানি সংকটের ঝুঁকি কমানো এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি উৎসের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

এজন্য দেশের নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, তেল বা অন্যান্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান এবং উত্তোলন বৃদ্ধি করার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে তারা মনে করেন।  

এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার বিশেষ করে সৌরশক্তি, জলবিদ্যুৎ বা বায়ুশক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। এগুলো পরিবেশবান্ধব, অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী এবং দেশের নিজস্ব সম্পদ। এ খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ালে আমদানিকৃত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর চাপ কমে আসবে বলেও মনে করেন তারা।

এ প্রসঙ্গে আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, যেকোনো উৎপাদনমুখী শিল্পের জন্য গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট একটি গুরুতর সমস্যা এবং এর সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনি গ্যাস-বিদ্যুৎতের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। অবিলম্বে এর সমাধাম না হলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।  এজন্য সরকারের নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, এসব দিক বিবেচনায় এলডিসি উত্তরণের সময়সীমা ছয় বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করা হচ্ছে। অবকাঠামো খাত উন্নয়নে আমাদের আরও প্রস্তুতি দরকার।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, আগামী একবছরের মধ্যে যদি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ করা যায় তবে আমেরিকার বাজারে আমরা একক আধিপত্য ধরে রাখতে পারবো।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আগামী ৭- ৮ বছরের মধ্যে আমাদের নিজস্ব গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে যাবে। বছরে ৮-৯ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে এলএনজি আমদানিতে। অথচ আমাদের প্রস্তুতি কোথায়? তিনি বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট তৈরি পোশাকখাতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে গ্যাস নির্ভর শিল্পে। দেশে বর্তমান দুটো ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল চালু আছে। এই অবকাঠামো উন্নয়নে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।

সাকিফ শামীম বলেন, জ্বালানির দাম বাড়লে বা আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ কমে গেলে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে এবং পন্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা অপরিহার্য। এজন্য, আমাদের নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবষ্কারের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে অপশোর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো অথবা বৈদেশিক বিনিয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর জোর দিতে হবে। গ্যাসের ঘাটতি দীর্ঘদিনের। জ্বালানি সংকটে ধুঁকছে ৩৩ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ডলার সংকটের কারণে আমদানির জন্য নিয়মিত ডলার পাওয়া কষ্টসাধ্য হচ্ছে।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে এ অবস্থার উন্নতি সাধন হয়েছে। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক। গ্যাসভিত্তিক ৬৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পালাক্রমে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বাকি ৮ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মধ্যে গড়ে উৎপাদিত হচ্ছে ৬ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। দিনে এখন ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে সব মিলিয়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট।

দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন ও বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দেশে গ্যাসের সরবরাহ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, বেশি দাম দিয়েও এখন গ্যাসের অভাবে অনেক কারখানা চালানো কষ্টসাধ্য হচ্ছে। এর মধ্যে এলএনজি সরবরাহ কমে গেছে। আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। নানা সংকটে এ দুটি টার্মিনালও সব সময় সক্রিয় থাকে না।

সাকিফ শামীম বলেন, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পরিবর্তে খোলা বাজার বা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হচ্ছে। স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম অনেক বেশি থাকে, যা সামগ্রিক আমদানি ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়।

এ অবস্থায় এলএনজি আমদানির জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্থায়ী ও বৃহৎ অবকাঠামো তৈরি করা হলে তা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে খরচ কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে যা এলএনজি আমদানির ব্যয় কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। ভাসমান টার্মিনালের পরিবর্তে স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল বা ল্যান্ড-বেজড টার্মিনাল নির্মাণ করা হলে দীর্ঘমেয়াদে আমদানি খরচ কমে আসবে। এ ধরনের টার্মিনালের ধারণক্ষমতা অনেক বেশি থাকে এবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়া পাইপলাইন নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ করতে হবে। পর্যাপ্ত অবকাঠামো থাকলে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানি করতে পারবে।

সাকিফ শামীম বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় গত বছর ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর বাইরে ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ৬৫টি। মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৬ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এর মধ্যে ২৫ থেকে ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানির অভাবে নিয়মিত উৎপাদন করতে পারছে না। দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে আমদানির দিকে ঝোঁকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, জ্বালানি সংকট উত্তরণে বাপেক্সের মাধ্যমে দেশে নতুন করে গ্যাস কূপ খনন এবং বিদ্যমান কূপগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। মিয়ানমার ও ভারত এরই মধ্যে সমুদ্রে গ্যাস পেয়ে তা উত্তোলন করা শুরু করে দিয়েছে। এছাড়া গভীর সমুদ্রে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে চুক্তি করা প্রয়োজন। গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

জিসিজি/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।