ঢাকা, বুধবার, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৮ মে ২০২৫, ০০ জিলহজ ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

দুর্নীতির মধ্যেই পুরস্কৃত সামিট অ্যাসোসিয়েটস, ফের পেল ইউরিয়া সরবরাহের দায়িত্ব

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩:৪৫, মে ২৭, ২০২৫
দুর্নীতির মধ্যেই পুরস্কৃত সামিট অ্যাসোসিয়েটস, ফের পেল ইউরিয়া সরবরাহের দায়িত্ব

ঢাকা: সরকারি আমদানিকৃত ভর্তুকির সার সঠিকভাবে সরবরাহ না করে এবং কম ওজনে সার পাঠানো সত্ত্বেও পুনরায় দরপত্র পেয়েছে এক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। গেল মৌসুমে সরবরাহ সঠিকভাবে না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় সারের কৃত্রিম সংকট দেখা দেয়।

আগামী মৌসুমগুলোতেও কৃত্রিম সংকটের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আগামী আমন মৌসুমের চাষাবাদ নির্বিঘ্নে করার জন্য ইউরিয়া সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করা হচ্ছে। তবে গেল বোরো মৌসুমে সারের সরবরাহ সঠিকভাবে না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংকট দেখা দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরিয়া সার সরবরাহ চেইন অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে বিসিআইসি, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো সারের এই ‘সফল’ সরবরাহের গল্পের পেছনে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারেই হারিয়ে যাবে দেশের কৃষি উৎপাদন ও কৃষকের স্বপ্ন।

জিটুজি (সরকার টু সরকার) ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউ এ ই) এবং কাতার থেকে আমদানিকৃত ইউরিয়া গ্রানুলার (বড় দানা) সার সরবরাহ করা হয় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) মাধ্যমে। এই সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। যেখানে সর্বনিম্ন দরদাতা সামিট অ্যাসোসিয়েটসকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) সম্প্রতি প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। সাধারণত এমন টেন্ডারে জাহাজ ভাড়া, ট্রাক ভাড়া, লাইটার ভাড়া, লজিস্টিক সাপোর্ট, অপারেশনাল খরচ ও নির্ধারিত মুনাফা যোগ করে প্রতি মেট্রিক টন ইউরিয়ার জন্য আনুমানিক ৫০ থেকে ৫২ মার্কিন ডলার পর্যন্ত খরচ ধরা হয়ে থাকে। তবে এবারের টেন্ডারে দেখা গেছে অস্বাভাবিক একটি প্রবণতা। বিসিআইসির সাধারণ বাজেট কাঠামোর তুলনায় ৬-৮ ডলার কমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। সংশ্লিষ্ট মহলে বিষয়টি আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং অনেকেই এটিকে ‘মূল্যযুদ্ধ’ বা প্রাইস ওয়ার হিসেবে দেখছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন কম দরপ্রদান যদি প্রকৃত খরচ কাঠামোর নিচে হয়, তবে তা ভবিষ্যতে পরিষেবা বা ডেলিভারিতে ঘাটতির কারণ হতে পারে।  জাহাজ পরিবহনের এক বিশ্লেষক জানান, বাজেট যদি ৫০ ডলার হয় আর কেউ ৪৪ ডলারে কাজ করতে চায়, তাহলে সেখানে হয়ত গুণমান, নিরাপত্তা কিংবা সময়সীমা বিপন্ন হতে পারে।

সাধারণত বিসিআইসি প্রতি শিপমেন্টে গড়ে প্রতি মেট্রিক টনে ৫০-৫২ মার্কিন ডলার খরচ ধরে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, কিছু শিপিং এজেন্ট ৪২-৪৪ ডলারে টেন্ডার নিচ্ছে। প্রথম দর্শনে বিষয়টি সরকারের ব্যয় সাশ্রয় মনে হলেও এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সারের চোরাচালান, যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের কৃষক সমাজ এবং মুনাফা ভোগ করছে এক শ্রেণির ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান।

বর্তমানে চারটি প্রতিষ্ঠান বিসিআইসি ইউরিয়া সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারা হলো- বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড, তাইবা সাইফুল্লাহ জিএল, সামিট অ্যাসোসিয়েটস, ইন্টারওশান। যেখানে বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড এবং তাইবা সাইফুল্লাহ জিএল তাদের বরাদ্দকৃত সার যথাসময়ে বিসিআইসি গুদামে বুঝিয়ে দিয়েছে, সেখানে সামিট অ্যাসোসিয়েটস ও ইন্টারওশান প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের বরাদ্দকৃত সার পুরোপুরি বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

সম্প্রতি সামিট অ্যাসোসিয়েটসের আমদানিকৃত ইউরিয়া সার ওজনে কম হওয়ায় ৫০০ মেট্রিক টন গাইবান্ধা সরকারি গোডাউনে আনলোড করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ।  

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় ১/২.৫০ কেজি সার কম দেওয়া হয়। যে কারণে সরকারি গোডাউনে ঢুকতে না দিয়ে বাইরে খোলা আকাশের নিচে ডাম্পিং করে রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সরকারি সার কম ওজনে গোডাউনে ঢুকার কোনো সুযোগ নেই। আমদানি প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে, ওজন সঠিকভাবে হওয়ার পর গোডাউনে ঢুকানো হবে। যদিও আমদানিকৃত ইউরিয়া সার খোলা আকাশের নিচে রাখার কোনো নিয়ম নেই।

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ) গাইবান্ধার গোডাউন ইনচার্জ হারুন অর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, আমদানিকারকরা নিজ দায়িত্বের বাইরে ডাম্পিং করে রেখেছে। তারা নিজেরা সঠিক ওজন নিশ্চিত করার পর মাল গোডাউনে ঢুকবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই।  

তিনি আরও বলেন, এক এক বস্তা এক এক রকম ওজন কম আছে। কোনো বস্তায় ৫০০ গ্রাম আবার কোনো বস্তায় এক থেকে দেড় কেজি।

লেবার সরদার ফরহাদ রহমান বলেন, ওজন কমের মালের দায়ভার আমাদের কেউ নেবে না। ওই সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজ দায়িত্বে ত্রিপল দিয়ে বাইরে রেখেছে। বস্তার যে নিট ওজন সেটি নিশ্চিত হওয়ার পর গোডাউনে ঢুকানো হবে।

তিনি আরও বলেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সামিট অ্যাসোসিয়েটসের সারের প্রতি বস্তায় এক থেকে দেড় কেজি ওজনে কম আছে।

এর আগে সামিট অ্যাসোসিয়েটসের বিরুদ্ধে টেপাখোলা বাফারে ১৫ ট্রাক ইউরিয়া চোরাচালানের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষকে দায়িত্ব দিয়ে সারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আইন অনুযায়ী, পরিবহন ঠিকাদার সরবরাহ কার্যক্রমে সাব-কন্ট্রাক্ট দেওয়ার সুযোগ নেই। তবুও সাব-কন্ট্রাক্টররা নিজ ইচ্ছেমতো সার বিক্রি করে, গুদামে পাঠায়। যখন এই চোরাচালান ধরা পড়ে, তখন দায় চাপানো হয় সাব-কন্ট্রাক্টরের ওপর এবং মামলার মাধ্যমে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়।

সামিট অ্যাসোসিয়েটসের আরেকটি কেলেঙ্কারির উদাহরণ হলো এমভি সেভেন গেস-৪ জাহাজের তলা ফেটে নদীতে সার নষ্ট হওয়ার ঘটনা। বিসিআইসির তদন্তে দেখা যায়, ৪৭ মেট্রিক টন সার কম পাওয়া গেছে। অথচ শিপিং এজেন্ট এমএম শিপিং দাবি করছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ। অথচ খোলা বাজার মূল্যে এই সারের দাম প্রায় ১৩ লাখ টাকা। এই অস্বাভাবিক ক্ষতিপূরণ দাবির পেছনে দুর্নীতির গন্ধ স্পষ্ট। সামিট অ্যাসোসিয়েটসের কাছে বর্তমানে তিন জাহাজের অনুকূলে ২০ হাজার ৩৩১.৮০ মেট্রিক টন সার পাওনা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার ফলে কৃষকের কাছে সার সঠিক সময়ে পৌঁছায় না, সারের ঘাটতি তৈরি হয়, যার ফলে খোলা বাজারে সারের দাম বেড়ে যায়। কৃষক বাধ্য হয়ে বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হন।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমদানি করা সারের সরবরাহে যদি স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করা হয় তাহলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। এই দুর্নীতির দায় শুধু কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নয়, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদেরও।  

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই দুর্নীতি বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ না নিলে রাষ্ট্র আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কৃষি খাতে এর প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

ইউরিয়া সারের সরবরাহ চেইনে এই অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে বিসিআইসি, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো সারের এই ‘সফল’ সরবরাহের গল্পের পেছনে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারেই হারিয়ে যাবে দেশের কৃষি উৎপাদন ও কৃষকের স্বপ্ন।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সাইফুল আলম বলেন, গাইবান্ধার গোডাউন থেকে ওজন কম দেওয়ার বিষয়টি জানালে তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এক ছটাক মাল কম থাকলেও গোডাউনে ঢুকানোর সুযোগ নেই। তাদের সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গোডাউন থেকে বলেছে বস্তার ওজন ঠিক করে দিলে ঢুকানো হবে।

যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গত মৌসুমে সঠিকভাবে সার সরবরাহ করতে পারেনি এ বছরও একই প্রতিষ্ঠান আন্ডার রেটে দরপত্র জমা দিয়ে অনুমোদন পেয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত মৌসুমে সঠিকভাবে সরবরাহ হয়নি বিষয়টা শতভাগ সঠিক নয়। কিছু মাল এখনও বাকি আছে। আশা করছি, কয়েকদিনের মধ্যে তা সরবরাহ নিশ্চিত হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবো। অপরাধী হলে অবশ্যই শাস্তি পাবে।

টিএ/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।