ঢাকা, রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ১২ মে ২০২৪, ০৩ জিলকদ ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

গরুর মাংসের দাম নিয়ে ‘নাটক’

ইফফাত শরীফ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০২৩
গরুর মাংসের দাম নিয়ে ‘নাটক’

ঢাকা: গরুর মাংসের দাম নিয়ে যেন এক ধরনের ‘নাটক’ চলছে। বাড়তি দাম থেকে কমে কিছুদিন বিক্রি হলো।

এরপর ব্যবসায়ীরা এক মাসের জন্য দাম বেঁধে দিলেন। বেঁধে দেওয়া দাম মাঝখানের কমে যাওয়া দাম থেকে বেশি।

রাজধানীর বাজারগুলোতে কোথাও কোথাও ৫৯৫ থেকে ৬১০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছিল। আবার কোথাও ৭০০- ৭৫০ টাকাও বিক্রি হচ্ছিল। এতে ক্রেতারা হচ্ছিলেন বিভ্রান্ত।

আর তাই গরুর মাংসের দাম সমন্বয়ে করতে গেল রোববার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে মতবিনিময় সভায় বসে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সেই সভায় মাংস ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় হট্টগোল করেন। সেদিন দাম সমন্বয় করা যায়নি।

সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বুধবার বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি, বিডিএফএসহ সব পক্ষ গরুর মাংসের দাম ঠিক করবে। এবং তা রোববারের মধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তরে প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও (বিটিটিসি) গরুর মাংসের বাজার যাচাই করবে।

এর মধ্যেই বুধবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাদেক অ্যাগ্রোর কার্যালয়ে মাংস উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) ও মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভায় গরুর মাংস ৬৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।  

বৃহস্পতিবার থেকে বেঁধে দেওয়া দামে গরুর মাংস বিক্রির কথা বলা হয়। তবে এ সিদ্ধান্ত শুধু নির্বাচনের আগের এক মাসের জন্য। নির্বাচনের পর ব্যবসায়ীরা আবার দাম সমন্বয় করবেন বলে জানা গেছে।  

এরইমধ্যে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় নতুন বেঁধে দামে মাংস বিক্রি শুরু করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মাংসের দোকানগুলো ঘুরে নতুন বেঁধে দেওয়া দামে ব্যবসায়ীদের মাংস বিক্রি করতে দেখা গেছে।  

দাম বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা বেঁধে দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ক্রেতারা বলছেন, যে ব্যবসায়ীরা ৬০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছিলেন, এখন তারা আর সেই দামে বিক্রি করবেন না। ফলে কম দামে মাংস কেনা থেকে বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ।  

প্রতি কেজি গরুর মাংসে ৭৫০ গ্রাম মাংস, ২০০ গ্রাম হাড় ও ৫০ গ্রাম চর্বিসহ যে পদ্ধতিতে গরুর মাংস ৬৫০ টাকায় বিক্রির কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা, তা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন ক্রেতারা।  

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও রেলগেট, শাহজাহানপুর, মেরাদিয়া হাঁট, রামপুরা বাজার, মালিবাগ বাজার, বাসাবো বউ বাজার, মুগদা-মান্ডা ও গোড়ান বাজারসহ বেশ কিছু বাজার ঘুরে অধিকাংশ দোকানে ৬৫০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি হতে দেখা গেছে।  

তবে এসব এলাকায় কেউ কেউ এখনো ৫৯৫ টাকা গরুর মাংস বিক্রি করছেন। যদিও এ সংখ্যা খুবই সামান্য। এ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাড়তি দামে বিক্রি করলে তাদের বেচাকেনা কম হয়। এ কারণে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তারা এখনো নেননি। আরও কিছুদিন ক্রেতাদের কেনার ধরন বুঝে তারপর নির্ধারিত দামে বিক্রি করবেন।  

৫৯৫ টাকা দরে গরুর মাংস বিক্রি করলে কখনো কখনো প্রতি গরুতে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা লোকসান হয় বলে জানান খিলগাঁও এলাকার হালাল মিটের দোকানি। এরপরও দোকানটিতে এখনো গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫৯৫ টাকায়।  

হালাল মিটের কষাই মো. আরিফ মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে গরুর মাংসের দাম বাড়ানোর কথা থাকলেও মহাজন দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেননি। তাই আজও ৫৯৫ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি করছি। যদি মহাজন বলেন, নতুন দাম ৬৫০ টাকা কেজি বিক্রি করতে, তাহলে সেই দামেই বিক্রি করব। ৫৯৫ টাকায় যে মাংস বিক্রি করা হয়, তাতে মাংস, চর্বি ও হাড় একসঙ্গে মেশানো থাকে।  

তিনি বলেন, গরুর মাংসের দাম যখন ৮০০ টাকা ছিল, তখন বিক্রি কমে গিয়েছিল। তখন দিনে দুই থেকে তিনটি গরু বিক্রি করা কঠিন ছিল। ফলে দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দিতে মালিকের কষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু প্রতি গরুতে নির্দিষ্ট পরিমাণে লাভ থাকত। যদিও এ লাভে খরচ উঠত না।  

আরিফ বলেন, দাম কমার পর বিক্রি বেড়ে যায় অনেক। দিনে ১০ থেকে ১৫টিরও বেশি গরু বিক্রি হতো। ক্রেতারা কিনতেন বেশি। তবে ৫৯৫ টাকায় মাংস বিক্রি করলে সব গরুতে আগের মতো লাভ পাওয়া যায় না। যাদের বিক্রি কম বা যাদের ক্রেতা কম, তারা লাভ করতে পারে না।  
 
ভোর সকালে শাহজানপুর উত্তরা ব্যাংকের গলির সামনে একটি দোকান থেকে পারিবারিক অনুষ্ঠানের জন্য ৯০ কেজি মাংস কিনতে আসেন মান্ডার বাসিন্দা সেলিম গাজী। তিনি প্রতি কেজি মাংস ৫৯৫ টাকা দরে কেনেন। দোকানটিতে এখনো ৬৫০ টাকা কেজি অর্থাৎ নতুন দামে মাংস বিক্রি শুরু করেনি।  

পারিবারিক অনুষ্ঠানের জন্য ৯০ কেজি বা দুই মণ ওজনের ছোট গরু না কিনে কেন দোকান থেকে মাংস কিনছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ক্রেতা সেলিম গাজী বাংলানিউজকে বলেন, মাংসের দাম মূলত ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকার মতো বিক্রি হলে সাধারণ মানুষের জন্য ভালো হতো। বড় ভাই নিয়ে এসেছেন বিধায় এখান থেকে মাংস কিনছি। কিন্তু যে দামে ৯০ কেজি মাংস আমরা কিনেছি, তা দিয়ে একটি ছোট গরু অবশ্য কেনা যেত। তবে সেখানে আবার কাটার এক ধরনের ঝামেলা থেকে যেত। এখন দাম বেশি নিলেও সেই কাটার ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না। এখন শুধু কষ্ট এতটুকু যে, মাংস কিনে শাহজানপুর থেকে মান্ডা পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যেতে হবে।  

যেহেতু এক কেজি মাংসে কী কী থাকবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে বিক্রেতারা মনে করছেন, নতুন দামে ক্রেতারা ভালো মানের মাংস পাবেন। তবে এ পদ্ধতিতে হাড়, চর্বি ও মাংস কিনে আলাদা করে বিক্রি করে ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেওয়া বাস্তবসম্মত হবে না বলে মনে করছে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষই।  

মালিবাগ আবুল হোটেলের পাশে মোড়ে মাংস কিনতে আসা সোলাইমান হোসেন সবুজ নামে এক ক্রেতা বাংলানিউজকে বলেন, ৬৫০ টাকা বেঁধে দেওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা আর কম দামে বিক্রি করবেন না। ক্রেতারা মাংস কেনা থেকে বঞ্চিত হবেন।  

তিনি বলেন, এ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে ক্রেতাদের বোকা বানানোর জন্য। ব্যবসায়ীরা ঠিকই ক্রেতাদের ওপর প্রতি কেজি মাংসে ২০০ গ্রামের বেশি হাড় চাপিয়ে দেবেন।  তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো দাম বাড়ানো। মাংসের বাজারে সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে কম দামে সাধারণ মানুষের পক্ষে গরুর মাংস কেনা সম্ভব নয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০  ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০২৩
ইএসএস/আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।