ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

হাতে টানা রিকশার ১৩০ বছরের ঐতিহ্য অস্তাচলে

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০২০
হাতে টানা রিকশার ১৩০ বছরের ঐতিহ্য অস্তাচলে কলকাতার ঐতিহ্য হাতে টানা রিকশা

কলকাতা: গঙ্গার গা ঘেষে জন্ম নেওয়া ৩০০ বছরের পুরনো শহর কলকাতার অনেক কিছুই বদলে গেছে। বদলে গেছে শাসন থেকে প্রশাসন।

তবে আধুনিক কলকাতায় নতুনত্বের ছোঁয়া লাগলেও এখনও বদলায়নি শহরের ঐতিহ্য।

কাউকে যদি একফ্রেমে কলকাতার ছবি আঁকতে বলা হয়, তবে সেই ফ্রেমে যা আসবে তারমধ্যে অন্যতম হাতে টানা কাঠের রিকশা। ফলে আজও সেই ঐতিহ্যের অংশ হয়ে শহরের বুকে এখনও চলমান হাতে টানা রিকশাগুলো।

ঘণ্টির ঠুং ঠুং শব্দে একটা মানুষ টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরেকটা মানুষকে। পুরনো কলকাতাসহ এ ধরনের রিকশা বেশি দেখা যায় উত্তর ও মধ্য কলকাতার অলিগলি থেকে রাজপথে। এছাড়া দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের দিকে এখনও দেখা যায় হাতে টানা রিকশার চল।

ইতিহাস অনুযায়ী, ষোড়শ শতকের শেষের দিকে জাপানের বিভিন্ন শহরে দেখা যেত এই হাতে টানা কাঠের রিকশা। ১৮৯০ সালে জাপান থেকে জাহাজে করে কলকাতায় প্রথম আসে টানা রিকশা। সেই থেকে মিশে গেছে কলকাতার ঐতিহ্যর সঙ্গে। দেখতে দেখতে পার করে ফেলছে ১৩০ বছরের বেশি সময়। তবে কলকাতায় হাতে টানা রিকশার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা বাড়ে উনিশ শতকের গোড়ায়। বলা হয়, ১৯ শতকে ব্রিটিশদের সাথে সমানতালে কলকাতাকে শাসন করছে এই হাতে টানা কাঠের রিকশা।

যুগ যুগ ধরে শাসনের বেড়িতে একজন চালক চালিয়ে নিচ্ছে অন্য একজন মানুষকে। রিকশার চাকা গড়াতে প্রথমদিকে শক্তির প্রয়োজন হলেও এরপর লাগে ব্যালেন্স। চাকার সাথে গতির মিল থাকতে হবে পায়ের। হাতল থাকতে হবে কোমর বরাবর। এর বেশি ওপর-নিচ হলে সওয়ারি যাবে পড়ে।

এই ধরনের রিকশার চাকা তৈরী হয় কাঠ আর লোহা দিয়ে। চাকাদুটো আকারে অনেকটাই বড় এবং পুরু। পা দানি হয় সম্পূর্ণ লোহার। আবার বসার জায়গাটা বানানো হয় কাঠ ও গদি দিয়ে। সওয়ারিকে রোদ-বৃষ্টি থেকে রুখতে থাকে ত্রিপলের ন্যায় মোটা কাপড়। এই ছাউনি থাকে ভাজ করা। সওয়ারির প্রয়োজনে সেটি খুলে দেন চালক। সেই অবস্থায় রিকশা টানতে বাড়তি বল লাগে চালকের।

বর্তমানে কাঠের রিকশাগুলোর অস্তিত্ব অস্তাচলে। দিন ফুরিয়ে এসেছে কলকাতার এই ঐতিহ্যের। পুরনো পেশায় মোটেও ইচ্ছা নেই নতুন প্রজন্মের। হাজারো রিকশাচালক একসময় কলকাতায় এসেছিলেন রোজগারের আশায়। এরা এসেছিলেন বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মত রাজ্যগুলো থেকে। বংশানুক্রমিকভাবে পেশার টানে তারা হাতেটানা রিকশাচালক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন পরিবার-পরিজন ছেড়ে।

১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘ক্যালকাটা হ্যাকনি ক্যারেজ অ্যাক্ট’ নামে আইন চালু করলে কলকাতার পরিবহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ী, গরুর গাড়ী, পালকি, টানা রিকশার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে লাইসেন্স প্রথা চালু হয়। তখন থেকেই কলকাতায় লাইসেন্সধারী হাতে টানা রিকশার চল শুরু। তবে এই লাইসেন্সের চল ১৪ বছর আগে বাতিল হয়ে গেছে কলকাতায়। পুরনোদের লাইসেন্সও নবায়ন করা হয় না। কলকাতা পুলিশের দাবি, শহরে এখন এক জনেরও হাতে টানা রিকশার লাইসেন্স নেই। কিন্তু তারপরেও শহরের বেশ কিছু অঞ্চলে দিব্যি চলছে টানা রিকশা।

কলকাতা করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় চার হাজারের বেশি এমন টানা রিকশা চলছে কলকাতার পথে। আইনে নিষিদ্ধ হলেও মানবিকতার খাতিরে পুরনো রিকশাওয়ালাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। ১৪ বছর আগে যখন এই সংক্রান্ত আইন বাতিল হয়, তখন তৎকালীন সরকার হাতে টানা রিকশাচালকদের আলাদা পেশার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাদের জন্য পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তারা সেই প্যাকেজ বা অন্য পেশায় যাওয়া নিয়ে একমত হতে পারেননি। তাই হাতে টানা রিকশা শহর থেকে তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা কোনদিনই বাস্তবায়িত হয়নি।

কলকাতা পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যে রিকশাওয়ালা রয়েছেন, অধিকাংশেরই বয়স ষাটের অধিক। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আসছে না। ফলে কালের নিয়মে হাতে টানা রিকশা কমে আসছে কলকাতায়। সেজন্যই আইনত নিষিদ্ধ হলেও সরকার জোর করে তা বন্ধ করতে চাইছে না।

হয়ত আর কয়েকটা বছর। একজন আরেক জনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে; এমন দৃশ্য খুব অল্প সময়ই দেখবে শহর কলকাতা। তারপর কালের চাকায় বিলীন হবে টানা রিকশার চাকা। তখন আর কানে বাজবে না ঠুং ঠুং শব্দ। যেমনটা কলকাতা থেকে কয়েক দশক আগে হারিয়ে গেছে ‘হুমনা হুমনা’ শব্দে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়া কাঠের পালকি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০২০
ভিএস/এমকেআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।