ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

কলকাতা থেকে জনি হক

এক ট্যাক্সি চালকের গল্প

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
এক ট্যাক্সি চালকের গল্প ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা থেকে: গল্পটা খেটে খাওয়া এক মানুষের বেঁচে থাকার। কেমন সেই বেঁচে থাকা? তার নাম রাজেন্দর সিং।

তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক শ্রেণীর এক প্রতিনিধি।

তার জীবনে চিকচিকে রোদ, মিষ্টি রোদ, ফুটফুটে রোদ বলতে কিছু নেই। আছে শুধু কুয়াশাচ্ছন্ন দিন। আঁধার রাত। কোনো রকমে সেই রাত পার করে আসে দিন। থাকেন পরিবার থেকে দূরে। পরিবার বলতে শুধু তার স্ত্রী। দুই পুত্র সন্তান ছিলো। দু’জনেরই মৃত্যু হয়েছে। একজন তিন বছর বয়সে, ভীষণ অসুখে। অন্যজন মাতৃগর্ভেই। সে অনেক আগের কথা। এরপর আর বাচ্চাকাচ্চা হয়নি তাদের। দুই মাস পরপর স্ত্রীকে দেখতে পাটনায় যান তিনি, নিজের বাড়িতে।
 
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন আয়োজন করেছে বাংলাদেশ বিজয় উৎসব। ১৫ ডিসেম্বর সকাল সকাল কলকাতায় এলাম। পাঁচ দিন হবে উৎসব। ভেন্যু নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়াম। প্রতিদিনই দুপুর থেকে রাত অবধি থাকতে হবে ওখানে। হোটেল থেকে স্টেডিয়ামের দূরত্ব খুব বেশি নয়, আবার খুব একটা কাছেও নয়। পথে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ঘটনা ঘটলো। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হলো। পথচলার এ গল্পগুলো নানান রঙের। কিন্তু রাজেন্দরের সঙ্গে সাক্ষাৎ সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
 
কলকাতায় যাত্রীসেবায় নিয়োজিত আছে অসংখ্য ট্যাক্সি। এর মধ্যে ওলা ট্যাক্সিতে চড়তে হলে তাদের অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয় মোবাইলে। এ ছাড়া বাকি সব ট্যাক্সিচালকই মিটারে যান না। যে পথের দূরত্ব ৩০-৪০ রুপির, সেখানে তারা চেয়ে বসে থাকেন দেড়শো রুপি। ট্যাক্সি চালকদের এমনই চাহিদা যে, সাধ্যে কুলাতে রীতিমতো গলদঘর্ম হচ্ছিলাম। দ্বিতীয় দিনের কথা। দুপুরে হোটেল দ্য গ্র্যান্ড ওবেরয়ের সামনে একই অবস্থা। কেউ যেতে চান না। চাইলেও আকাশছোঁয়া ভাড়া চেয়ে বসে থাকেন! অবশেষে রাজেন্দরকে পেলাম। তাকে বললাম, যাবেন? নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়াম শুনে ওঠার জন্য বললেন। আমি বললাম, মিটারে নেবেন তো? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ। ’ আমি তো শুনে স্তম্ভিত! ভাবলাম তার মাথা ঠিক আছে তো? দরজা খুলে উঠতে উঠতে মনে মনে বললাম, ধুর অতো চিন্তার কি আছে। পেয়েছি যখন সস্তায় যাওয়া যাবে।
 
পথে ট্রাফিক সিগন্যালে জ্যামের কারণে কিছুক্ষণ এক জায়গায় স্থির ট্যাক্সি। তখনই জানা হলো তার নাম রাজেন্দর সিং। বাড়ি পাটনার একটি গ্রামে।

ট্যাক্সি চালাচ্ছেন ১৯৮৬ সাল থেকে। তখন তার বয়স ছিলো ১৬ বছর। ৪ রুপি ছিলো মিটার ডাউন (এখন সেটা ২৫ রুপি)। লাইসেন্স করিয়েছিলেন ৪শ’ রুপিতে। অতো অল্প বয়সে লাইসেন্স পেলেন কী করে? মুখে হাসি রেখে বললেন, ‘তখনও গোঁফ তেমন একটা ওঠেনি। তাই ছবি তোলার সময় মুখে কালি মেখে গোঁফ বানিয়ে নিলাম!’

ট্যাক্সিটা রাজেন্দরের নিজের নয়। সকাল ৭টায় নিয়ে বের হন, রাত ৮টা-৯টার মধ্যে জমা দিতে হয় ৪শ’ রুপিসহ। দিন শেষে সন্তুষ্ট থাকতে হয় বাকি ৩শ’ থেকে ৪শ’ রুপি নিয়ে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে তার এক একটা দিন। ট্যাক্সির মালিকের জমা তুলতে তুলতেই কোনো কোনো দিন তিনি দেখেন ঘুমের সময় এসে গেছে!

‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কিসের- কথাটা রাজেন্দর হয়তো শুনেছেন, হয়তো বলেছেনও৷ তার মতো প্রান্তিক মানুষ দুঃখ-কষ্টকে প্রতিদিন জয় করেন, জয় করতে জানেন৷ তবুও কি তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেন, কেমন আছি। জানতে ইচ্ছে হয়- এই যে ট্যাক্সি চালান, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সন্তানের আলোও নেই ঘরে। আপনি কি সন্তুষ্ট? কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তর তার মুখে- ‘জানি না!’
 
বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফের (আলমগীর হোসেন) কাছে শিখেছি, পথে-ঘাটে যেখানে যা আলাদা মনে হবে, ছবি তুলে রাখা উচিত। এজন্য তিনি স্মার্টফোনের ওপর গুরুত্ব দেন। তার পরামর্শ মেনেই এমন একটা ফোন ব্যবহার করা। সেটা দিয়ে রাজেন্দরের ছবি তুললাম। কিছুক্ষণ পরই নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়াম এলো। মিটারে দেখলাম উঠেছে ৩৩ রুপি। তাকে ইচ্ছে করেই আরও ১৭ রুপি বেশি দিলাম। ট্যাক্সি থেকে নামতে নামতে রাজেন্দরকে চেয়ে চেয়ে দেখলাম। মানুষের হৃদয় কি ইট-বালি-পাথরের তৈরি মন্দিরের মতো? তার হৃদয়টা হয়তো তেমনই। মানুষের মাঝে, পথের মাঝে ঈশ্বরের খোঁজে বের হন অনেকে। ঈশ্বরের দেখা সত্যিই হয়তো পথেই মেলে!

প্রতিদিনের উৎসব শেষে লেখা, ভিডিও ইনবক্স করা, ই-মেইলে পাঠানো, আপলোডের পর চেক করা- সব মিলিয়ে মাঝরাতের চাঁদ ছাড়া আর কেউ থাকে না সঙ্গে! পরদিন ঘুম থেকে উঠেই আবার স্টেডিয়াম। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমার ভেতর একটা অস্থিরতা। রোজই হোটেলে ফেরার পর থেকেই অদ্ভুত এক তাড়া! কীসের যেন তাগিদ। তাই কলকাতা ছাড়ার আগের রাত জেগে লেখাটা লিখে একটা আত্মতৃপ্তি পেলাম। মনে হচ্ছে রাজেন্দরের জন্য নিজে থেকে কিছু করলাম!
 
রাজেন্দরের মতো মানুষের খোঁজ ক’জনই বা রাখে। রোজকার ক’জন যাত্রী তার দিকে একটু তাকান? ক’জনই বা তার বেঁচে থাকার সংগ্রামকে উপলব্ধির চেষ্টা করেন? রুটি রুজির আশায় বয়সে প্রবীণ হয়ে গেলেও চাকা ঘুরিয়েই যাচ্ছেন- এই তো তাদের জীবন৷ কে রাখে তার খবর! তার কথা কি কেউ খুব একটা ভাবেন?

এমন প্রান্তিক মানুষের কথা আমাদের খুব একটা শোনা বা শোনানো হয় না৷ আপনাদের শোনানোর জন্য বাংলানিউজ শুনেছে, শুনিয়েছে। আগামীতেও শুনবে এবং শোনাবে৷
 
কলকাতা সময় : ০৫১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
জেএইচ/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।