ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

বাংলানিউজকে জকি আহাদ

'খচ্চরের পিঠে চড়ে পথ পেরিয়েছিলাম, বাকি পথ হেঁটে'

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
'খচ্চরের পিঠে চড়ে পথ পেরিয়েছিলাম, বাকি পথ হেঁটে' ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: প্রায় মিনিট গুনে পা ফেলা! একদিকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান, অন্যদিকে কলকাতা বইমেলার প্রস্তুতি।

তাই যে সাক্ষাৎকার একঘণ্টায় শেষ হয়ে যাবার কথা, সেটা শেষ হতে হতে রাত প্রায় ৮টা বেজে গেল।



চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক দীর্ঘ সাক্ষা‍ৎকার দিলেন কলকাতার বাংলাদেশ উপ হাই কমিশনার জকি আহাদ।

সম্প্রতি কলকাতায় তার দায়িত্বের একবছর পূর্ণ হয়েছে।   সেই অভিজ্ঞতা, ছিটমহল বিনিময়, বাংলাদেশ-ভারত-ভুটান-নেপালের (বিবিআইএন) চুক্তি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে শুরু করে আগামী বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিভিন্ন ইস্যু, তার পরিবারের পাকিস্তান থেকে ঢাকায় ফেরার ঘটনাবহুল ২৫দিন, পিতার কাছে শোনা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিসহ নানা বিষয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বললেন তিনি।

একই সঙ্গে এখানে দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশের কোনো সংবাদমাধ্যমকে প্রথমবারের মতো খোলামেলা কথা বলেছেন জকি আহাদ।

বাংলানিউজ: বিজয় দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি কোন পর্যায়ে?

জকি আহাদ: অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। অনুষ্ঠানের সব কিছুই বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আনা হচ্ছে। এরমধ্যে কলকাতার উডল্যান্ড  হাসপাতাল উৎসব প্রাঙ্গণে একটি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করছে। এরইমধ্যে তা মেলায় পরিণত হতে চলেছে।

বাংলানিউজ: এবারই প্রথমবারের মতো ৫ দিনের বিজয় উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। এর কোনো বিশেষত্ব আছে কী? 

জকি আহাদ: আমার মনে হয় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর ভারতের মধ্যে মূলত পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সব থেকে ভালো। অনেকেই বলেছেন উৎসব এতো ছোট করে পালন করা হয় কেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির হস্তক্ষেপের কারণে এবার বড় হচ্ছে উৎসব। এই উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত।

সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি। তারা যেন উৎসবে এসে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, খাওয়া-দাওয়া সব কিছুর বিষয়ে জানেন। প্রতিবারই নারীরা বেশি আসেন। শাড়ি আর বাংলাদেশের খাওয়া-দাওয়ার আকর্ষণ তো আছেই।

বাংলানিউজ: কলকাতায় এক বছর পার হল, কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?

জকি আহাদ: এক কথায় বলতে গেলে অসাধারণ। সব বলে শেষ করা যাবে না। কলকাতায় এসে প্রথমেই মনে হয়েছিল আমি যেন ঢাকায় আছি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আন্তরিকতা দেখে মনেই হয়নি আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।

বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে আমাকে আপন করে নিয়েছেন, সেটা অতুলনীয়। মুখ্যমন্ত্রী একদিন বললেন, জকি তুমি আমার ছোট ভাইয়ের থেকেও বেশি।
 
বাংলানিউজ: আপনার কার্যকালে তো সাফল্যের একাধিক নজির ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। ছিটমহল হস্তান্তর, বিবিআইএন চুক্তি,  কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস। নতুন বছরে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কী ‘সারপ্রাইজ’ আছে?

জকি আহাদ:  চমক বলে কিছু নেই! প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা থাকে। সব কিছুই একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হয়। বেশ কয়েকটি বিষয় এই প্রক্রিয়ার মধ্যে বয়েছে।

বাংলানিউজ: সে সম্পর্কে পাঠকদের যদি কিছু বলেন?

জকি আহাদ: ঠিক আছে, তোমার কথায় না হয় ‘সারপ্রাইজ’-ই থাকলো সেটা। তবে আগামীতে বিদ্যুৎ আর আর টেলিকম নিয়ে বেশ কিছু কাজ হতে চলেছে।

বাংলানিউজ: এবার আসি তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তির প্রসঙ্গে, সরাসরি জানতে চাইছি এ বিষয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

জকি আহাদ: নদীর উপরের অংশ ভারতে। এখানে ভারতের বড় ভূমিকা আছে। দুই দেশের আলোচনা চলেছে। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। এ প্রসঙ্গে দিদির (পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী) বড় ভূমিকা আছে। দিদি কিন্তু কখনই বলেননি পানি দেবো না। বর্তমানে দুই বাংলার সম্পর্ক আরও উন্নত হয়েছে।

‘কেন, মনে নেই? বাংলাদেশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে (শেখ হাসিনা) দিদি (মুখ্যমন্ত্রী) মজা করে বলেছিলেন- বেশি করে পদ্মার ইলিশ পাঠাতে। প্রত্যুত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পানি এলেতো বেশি মাছ হবে। অ‍াসলে দুই বাংলার সম্পর্ক অনেক মধুর। ’

বাংলানিউজ: এক বছরে উপ হাই কমিশনের কাজে কোনো পরিবর্তন এনেছেন কী?

জকি আহাদ: এটা পুরোটাই একটা ‘টিম ওয়ার্ক’।   বাংলাদেশের বাইরে কলকাতাই প্রথম কূটনৈতিক ভবন। এই বাড়িটি একটি হেরিটেজ। গোটা বাড়িটি রঙ করা হয়েছে। আমি ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। জানলাগুলোতে আগের মতোই খড়খড়ি লাগানো হয়েছে। ৬৪ বছরেও বাড়িটিতে কোনো লোগো ছিল না। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক শাপলার লোগো লাগানো হয়েছে।

শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু নামে রাস্তার ফলকটি আরও পরিষ্কার ও সংস্কার করা হয়েছে। বাইরে ভিসা প্রার্থীদের বসার জায়গা করা হয়েছে। রিসিপশনে বাংলাদেশের আবহাওয়া, প্রকৃতির কথা বিবেচনা করে শীতলপাটিসহ আরও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।

বাংলানিউজ: বিজয় দিবস সম্পর্কে আপনার ছোটবেলার কোনো  অভিজ্ঞতা; যা আপনাকে আজও নাড়া দেয়?

জকি আহাদ: প্রশ্নটা শুনেই চোখে পানি এসে যায়। ডিসেম্বর মাসটা আমাদের কাছে গৌরবের মাস। তাই ১৬ ডিসেম্বর শুধু একটা দিন নয়, একটা মাহেন্দ্রক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধে ভারত শেষ ১০-১২ দিন প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিয়েছিল, এটা কোনোভাবে ভোলার নয়।

আজ আমি নিজেকে অসহায় মনে করি, কারণ তখন ১০-১২ বছর বয়স। না হলে যুদ্ধে যোগ দিতাম। আমার আব্বা পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। ১ মে পাকিস্তান থেকে আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসি।

বাংলানিউজ: সেই চলে আসার কোনো স্মৃতি মনে পড়ে কী?

জকি আহাদ: পাকিস্তানে কিছুই বোঝার উপায় ছিল না, বাংলাদেশে কী ঘটছে। ভরসা শুধু রেডিওতে। আমারা খুব আস্তে আস্তে আকাশবাণী চালিয়ে যুদ্ধের খবর শুনতাম। যাতে পাশের কেউ শুনে না ফেলে।   ১ মে আমরা পাকিস্তান ছাড়ি। রীতিমতো পালিয়ে আসা।

তারপর আফগানিস্তানে প্রবেশ করি। কিছুটা জায়গা খচ্চরের পিঠে চড়ে আমরা পথ পেরিয়েছিলাম।   বাকি পথ হেঁটে পার হতে হয়েছিল।

অবশেষে আমরা পৌঁছেছিলাম আরিয়ানা আফগান এয়ার বেসে। এরপর সেখান থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে কলকাতা।

কলকাতায় পার্ক হোটেলে ছিলাম কয়েকদিন। পাকিস্তান ছাড়ার ২৫ দিনের মাথায় ১৯৭৩ সালের ২৫মে নেমেছিলাম ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে।

আব্বা ভেবেছিলেন সরকারি কাজে আর নেই। কিন্তু তাকে ডেকে নিয়ে এডিসি করে দেওয়া হয়। তারপর ডিএম।

বাংলানিউজ: আপনি নিশ্চয় আপনার বাবার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার কথা শুনেছেন। সেটা যদি  বলেন?

জকি আহাদ: মনে আছে বঙ্গবন্ধু আব্বার হাত ধরে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন-‘এটা আমার বাচ্চা ডিসি’। তিনি যতটা পারতেন আগলে রাখতেন।

বাংলানিউজ: আগামী দিনের লক্ষ্য কী?

জকি আহাদ: সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত রূপকল্প ‘ভিশন-২০২১’ বাস্তবায়নে কাজ করতে চাই। আর ২০৪১-এ উন্নত দেশের নাগরিক হবো-ই। আর বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও খুবই আশাবাদী।

বাংলানিউজ: শেষ প্রশ্নটা একটু ‘হাইপোথেটিক্যাল’। কলকাতা আর ঢাকা এই দুই শহরের মধ্যে যদি কিছু অদলবদল করার সুযোগ হয় তাহলে কী করবেন?

জকি আহাদ: এই সুযোগ এলে ঢাকার কিছু স্থাপত্য কলকাতায় আর কলকাতার কিছু স্থাপত্য ঢাকায় অদলবদল করবো। কারণ কলকাতায় অনেক ইংরেজ স্থাপত্য আছে। আর ঢাকা ছিল মুঘলদের রাজধানী। এই অদলবদল করলে কলকাতার মানুষ আর ঢাকার মানুষ ইতিহাসের দুই ভাগের স্থাপত্যগুলো নিজেদের শহরেই দেখতে পাবেন।

বাংলানিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

জকি আহাদ: বাংলানিউজকেও ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
ভিএস/এমএ

** সব হুমকি উড়িয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় ভারত
** পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় ছিল রাজধানী স্থানান্তরের খবর
**‘শুধু বুঝতে পেরেছিলাম, বড়ো কিছু ঘটতে চলছে’
** শিশুটি দৌড়াচ্ছিল আর বলছিল-‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’
** সেই গানের ইতিহাস: শোনো, একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের...
**  ‘সেদিন ছিল আমাদেরও বিজয়ের দিন’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad