ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ট্রেন দুর্ঘটনার ৬ কারণ, শাস্তি গোপনে

সৈয়দ বাইজিদ ইমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২১
ট্রেন দুর্ঘটনার ৬ কারণ, শাস্তি গোপনে ফাইল ছবি।

চট্টগ্রাম: রাস্তার ধুলো আর যানজট মাড়িয়ে অনেকেই গাড়িতে ভ্রমণ করতে চান না। সেসব মানুষদের কাছে ট্রেন স্বাচ্ছন্দ্যের বাহন।

কিন্তু এটি এখন আতঙ্কের বাহনে পরিণত হচ্ছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য ৬টি কারণ চিহ্নিত করেছে৷

তবে যথাযথ পর্যবেক্ষণ আর তদারকি না থাকাকেই বিশেষ কারণ বলে দাবি করছেন রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, ট্রেন দুর্ঘটনার পর একাধিক তদন্ত কমিটি করার কথা শোনা যায়, কিন্তু তদন্তের প্রতিবেদন এবং এর প্রেক্ষিতে দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- তা অনেকটাই গোপন থাকে।

তদন্ত কমিটিগুলো এমনভাবে গঠন করা হয়, যাতে এই কমিটিতে যারা থাকে তারা তদন্তে একেবারে নিচের পর্যায়ের ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারে। ফলে উপরের পর্যায়ে যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা নিয়োগ বা প্রশিক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন তারা সবসময় শাস্তির বাইরে রয়ে যান।

অসচেতনতা ও অবহেলা

ট্রেনের যত দুর্ঘটনা ঘটছে তার জন্য পথচারীদের অসচেতনতাকেই দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অধিকাংশই ঘটেছে রেল লাইন পারাপারের সময় অসচেতনতার কারণে। অবহেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে লোকের মৃত্যুও বাড়ছে। ট্রেন আসার সময়েই রেল লাইন পারাপার হতে চায় মানুষ। সামান্য অবহেলার কারণে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে হয়। ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে, মোবাইলে কথা বলা অবস্থায় এবং বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়েও প্রাণ দিতে হচ্ছে।

ঝুঁকিপূর্ণ রেল লাইন ও সেতু

লেভেল ক্রসিং, ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন ও সেতু ট্রেন দুর্ঘটনার একটি কারণ। প্রতিদিন তিনবার করে পুরো রেললাইন, সিগন্যাল ও সেতু পরিদর্শনের কথা থাকলেও অনেক সময় বছরে একবারও পরিদর্শনে যাওয়া হয় না। দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুত হয়ে ও লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। সারা দেশে আছে ৩ হাজার ৬টি রেল সেতু, যার ৯০ শতাংশ তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখা হয়েছে সেতুগুলো। এগুলোর ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিভিন্ন রুটের ট্রেন।

রেললাইনে পাথর না থাকা, সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটি, লাইন ক্ষয়, স্লিপার নষ্ট, লাইন ও স্লিপার সংযোগস্থলে লোহার হুক না থাকার কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা। লাইনে নির্ধারিত দূরত্বের মধ্যে (প্রায় ৪০-৫০ ফুট) পয়েন্ট রয়েছে। এসব পয়েন্টের মধ্যে দুইপাশে ৮টি করে মোট ১৬টি নাট-বল্টুসহ ১৬টি হুক, ক্লিপ থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশ পয়েন্টের মধ্যে ১৬টির স্থলে রয়েছে ৫-৭টি ।

ব্রিটিশ আমলের রেল সেতু, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন কোচ, জরাজীর্ণ রেললাইন ও লোকবলের ঘাটতি নিয়ে কথা হয়েছে সংসদে। দেশের প্রায় ৩ হাজার ৩৩২ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সময় খোলা থাকে ফিশপ্লেট, ক্লিপ, হুক, নাট-বল্টুসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ। এমনকি রেললাইন মজবুত ও স্থিতিশীল রাখতে স্থাপিত স্লিপারগুলোর অবস্থাও নাজুক। আবার এসব স্লিপারকে যথাস্থানে রাখতে যে পরিমাণ পাথর থাকা প্রয়োজন অধিকাংশ স্থানে তা নেই। কোনও কোনও স্থানে পাথরশূন্য অবস্থায় আছে স্লিপারগুলো।  

প্রতিদিন রেল লাইন, সিগন্যাল ও ব্রিজ পরিদর্শন করা ছাড়াও ট্রেন ছাড়ার পূর্বে ইঞ্জিন ও প্রতিটি বগির বিশেষ বিশেষ যন্ত্রাংশ এবং চাকা চেক করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। অথচ প্রতি বছরই বিভিন্ন রুটে নামছে নতুন নতুন আন্তঃনগর ট্রেন।  

লোকবল সংকট 

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে লোকবল সংকট দীর্ঘদিনের। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শূন্য রয়েছে ৭ হাজার ৯৯ জনের পদ। ২৪৫ জন সহকারী স্টেশন মাস্টার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল রেলওয়ে। কিন্তু তাদের চাকরিও নানান কারণে অনিশ্চিত। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদ রয়েছে ১১টি। কিন্তু সেখানে আছেন মাত্র ৫ জন। এছাড়াও বিভিন্ন দফতরে লোকবল সংকট থাকায় সঠিক কাজ যথাসময়ে হচ্ছে না বলে অভিযোগ কর্মকর্তাদের।

মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন কোচ

মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনের কারণেও দুর্ঘটনায় পড়ছে ট্রেন। দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেন থেকে ১০টি নিম্নমানের ইঞ্জিন এনে সমালোচনার মুখে পড়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সেই সমালোচনার তোয়াক্কা না করেই গত ২১ নভেম্বর আরও ১০টি ইঞ্জিন একই কোম্পানি থেকে আমদানি করে রেলওয়ে। সেই নতুন ইঞ্জিনগুলো বহরে যুক্ত হতে না হতেই ৩টি অকেজো হয়ে গেছে।

তদারকির অভাব 

ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে কোনও তদারকি নেই রেলওয়ের রেললাইনে পাথর দেওয়ার পর সেগুলো আর তদারকি হয়না। লম্বা ধাতব রেললাইন খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে ঝড়-বৃষ্টি গরম-ঠাণ্ডা সহ্য করে। রেললাইন গরমে বেড়ে যাওয়া এবং ঠাণ্ডায় আয়তনে কমে যাওয়া থেকে রক্ষা করে পাথর। বিশাল মাপের ট্রেন রেললাইন দিয়ে যাওয়ার সময়ে মাটিতে কম্পন শুরু হয়। কম্পনে রেললাইনকে এক জায়গায় রাখতে এই পাথর ব্যবহার করা হয়। পাথর থাকার ফলে রেললাইনে আগাছা জন্মাতে পারে না। আগাছা জন্ম নিলে ট্রেন চালাতে অসুবিধা হয়। অথচ তদারকির অভাবে বেশিরভাগ পাথর চুরি হয়ে যায়। আবার এখন যেসব পাথর দেওয়া হয়, তা নিম্নমানের। এতে নড়বড়ে হয়ে যায় রেললাইন।  

এছাড়া রেললাইনের ক্লিপ-হুক, নাটবল্টু চুরি, স্লিপার পচে যাওয়া, স্লিপারের হুক উঠে আসা, লাইনের নিচের মাটি ও পাথর সরে যাওয়ার ফলে ট্রেনের লাইনচ্যুতিও নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলপথের ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হচ্ছে। রেলপথে প্রতি ১০০ গজে পাহারা থাকার কথা থাকলেও অনেক স্থানেই তা নেই। সন্ধ্যার পর অনেক এলাকা নেশাখোর, বখাটে ও চোরদের আড্ডাস্থল হয়ে পড়ে। এরাই রাতে রেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ চুরি করে বিক্রি করছে। রেললাইনের পাশে বস্তি, কাঁচাবাজার বসানোর ফলেও ঘটছে দুর্ঘটনা।

লাফালাফি-বগিতে ওঠার চেষ্টা

ট্রেনের ছাদে উঠে কিংবা এক বগি থেকে অন্য বগিতে লাফিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় নিচে পড়ে কাটা পড়ে মারা যায় অনেক পথশিশু ও ভবঘুরেদের। ৩০ অক্টোবর নগরের কদমতলী রেলগেট এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেনে কাটা পড়ে মনুজা বেগম (৭০) নামে এক ভিক্ষুকের মৃত্যু হয়। ৯ অক্টোবর জোরারগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাতনামা (২২) এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৫ অক্টোবর হাটহাজারীর মীরেরহাট ইউনিয়নের আলমপুর এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় আব্দুস সোবহান (৭৫) নামে এক বৃদ্ধ মারা যান। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এসে সীতাকুণ্ড রেলস্টেশনে ট্রেনে কাটা পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আরও দুজন আহত হয়। ৯ সেপ্টেম্বর সকালে সীতাকুণ্ড রেলস্টেশনে ট্রেনের ধাক্কায় তিনি মারা যান। গত ৩১ অক্টোবর লাফাতে গিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শাটল ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে বালুছড়া এলাকায় ১০ বছরের এক পথশিশু মারা যায়।  

চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন কারণে ট্রেনে দুর্ঘটনা বাড়ছে। অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে বেশি ঘটছে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মানুষ সচেতন হলে এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু অনেকাংশেই কমে যাবে। আমরা বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, প্রতি মাসেই রেললাইন এলাকা থেকে উদ্ধার হচ্ছে মরদেহ। কখনও ট্রেনে কাটা পড়ে মরছে মানুষ, কখনও ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে মৃত্যু হচ্ছে। আবার কখনও মৃত্যুর কারণ থাকে অজ্ঞাত। রেললাইনের পাশে পড়ে থাকে মৃতদেহ। রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) হিসেবে, বছরে তিন শতাধিক মরদেহ উদ্ধার হয় রেললাইন থেকে, যার বেশিরভাগই দুর্ঘটনা বলে প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২১
বিই/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।