ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

ক্রিকেট

‘স্পিনারদের বলব— তোমরা হাল ছেড়ো না’

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪
‘স্পিনারদের বলব— তোমরা হাল ছেড়ো না’

চট্টগ্রাম থেকে: রংপুর রাইডার্সের অনুশীলনের শুরুর সময় তখনও। সতীর্থরা ব্যস্ত ফুটবল খেলায়।

ইমরান তাহির তখন সবার চেয়ে আলাদা। মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে স্থানীয় স্পিনারদের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার এই লেগ স্পিনারের টি-টোয়েন্টি উইকেট সংখ্যা ৫০০ ছুঁইছুঁই। খেলে বেড়াচ্ছেন বড় বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে।

এবারের বিপিএলে রংপুরের হয়ে খেলতে আসা তাহির চট্টগ্রামে মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলানিউজের। লম্বা আলাপে জানিয়েছেন- নিজের উদযাপনের পেছনের গল্প, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা, প্রায় ৪৫ বছর বয়সেও পেশাদার ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়ার রসদ। দিয়েছেন স্পিনারদের হাল না ছাড়ার মন্ত্রও...

বাংলানিউজ: বিপিএলে আগেও খেলেছেন। এবার রংপুর রাইডার্সের হয়ে খেলছেন। কেমন দেখছেন সবকিছু?

তাহির : যখনই আপনি বাংলাদেশে আসেন। ক্রিকেটের জন্য অনেক আবেগ দেখতে পাবেন এখানে। মানুষ আসবে, সমর্থন দেবে; যেটা দেখা দারুণ ব্যাপার। আমি খুবই রোমাঞ্চিত। আমাকে বিপিএল খেলতে আসার সুযোগ করে দেওয়ায় রংপুর রাইডার্সকে ধন্যবাদ।

প্রথম ম্যাচ থেকেই আমি অনেক উপভোগ করছি। বুঝতে পারছি কেন আমরা সবার উপরে আছি। এটা খুব পেশাদার সেট-আপ। সব খেলোয়াড়, ম্যানেজমেন্ট- তারা খুব রিল্যাক্স ও খেলার ব্যাপারে পেশাদার। যেটা দেখা খুব দারুণ ব্যাপার। বিদেশি ক্রিকেটার হিসেবে আমাদেরও এটা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে দেয় ।

বাংলানিউজ : আপনার জন্য বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসাও নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে? 

তাহির : দেখুন, আমি প্রথম ম্যাচেই দেখেছি আমাদের অনেক সমর্থন ছিল। খেলোয়াড় হিসেবে এটা আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে। আপনাকে অতিরিক্ত বল দেবে। আমার মনে হয়, এটা আমাদের ভালো করতে সাহায্য করে।

বিশেষত আমাকে, কারণ আমি যে ধরনের খেলোয়াড়, মাঠে থাকলে মানুষের কাছ থেকে চালিকাশক্তি পাই; এজন্য আমি তাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। শুরুটা ভালোই হয়েছে আমার। প্রথম ম্যাচ জিতেছি। আশা করি আগামীকালও জিততে পারবো।

বাংলানিউজ : একটু আগে দেখলাম আপনি স্থানীয় ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলছেন, কী কথা হলো?

তাহির : দেখুন, অভিজ্ঞতা ভালো (রংপুরের ক্রিকেটারদের সঙ্গে)। ভালো স্থানীয় ক্রিকেটারদের দলে থাকাটা সবসময়ই দারুণ ব্যাপার। সাকিব আল হাসান বিশ্বমানের অলরাউন্ডার, সে আমাদের দলে আছে। আমি নিশ্চিত সে তার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছে। বিদেশি ক্রিকেটার হিসেবে আমাদের দায়িত্বও একই।

এখানে আসা, তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে নিজের জানা ব্যাপারটা ভাগাভাগি করে নেওয়া। তারা তাদের খেলায় উন্নতি করতে চাইবে। আমাদের জন্যও এখানে শেখার আছে। কন্ডিশন কেমন বাংলাদেশে, কীভাবে নিজেদের খেলায় উন্নতি করতে পারি। কীভাবে আরও ভালো পারফর্ম করতে পারি।

আমার মনে হয় এখানে সবকিছুর মিশ্রনই আছে। এখন অবধি ড্রেসিংরুমে খুব ভালো লাগছে। যদিও কেবল তিনদিন ধরে আছি। তবুও বুঝতে পারছি এই টুর্নামেন্ট ভালোই কাটবে।

বাংলানিউজ : সাকিবের কথা বললেন, তার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলেছেন। এখন সতীর্থ। তার প্রভাব কেমন দেখছেন বাকিদের ওপর?

তাহির : এটা নিয়ে আসলে বেশি কথা বলার দরকারই নেই। ওর পুরো ‍দুনিয়াজুড়েই প্রভাব আছে। সে বিশ্বমানের অলরাউন্ডার। অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে ও পুরো দুনিয়াতে খেলছে; তার যে অভিজ্ঞতা, যে ধরনের পারফরম্যান্স করে পুরো দুনিয়ায়; শুধু বাংলাদেশে না।

সে অনেক বড় নাম আমাদের দলে থাকায়। আমাদের একটু ভাগ্যবানও মনে হয়। আমি তার সঙ্গে গায়ানা ওয়ারিয়র্সেও খেলেছি। আমি জানি ও সবসময়ই সাহায্য করার জন্য তৈরি থাকে। সবসময়ই আপনার এমন কাউকে দলে দরকার হয়; আমি নিশ্চিত তরুণরা ও আমরাও রোমাঞ্চিত তাকে পেয়ে।

বাংলানিউজ : আপনার দলের অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান কেমন?

তাহির : আগে তাকে টিভিতে দেখেছি, এবার প্রথমবার তার সঙ্গে খেলছি; দারুণ খেলোয়াড়। খুব ভালো ছেলে, খুব ঠান্ডা মানুষ। প্রথম ম্যাচে তার সঙ্গে অভিজ্ঞতা খুব ভালো। আমি আশা করি, সে যেভাবে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেটা চালিয়ে যাবে।

বাংলানিউজ : আপনি তো মাত্রই এসএ টি-টোয়েন্টি খেলে এলেন। বিপিএলের সঙ্গে তফাৎটা কেমন?

তাহির : দেখুন, এটা বলা কঠিন। সব ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট সিপিএল, বিপিএল, আইপিএল, পিএসএল, সব আলাদা। এখানে এসেই দেখলাম সব দল প্রায় দুইশ রান করেছে। এটার মানে হচ্ছে খেলার মান অনেক বেশি। যদি সেটা না হতো, তাহলে এত বিদেশি ক্রিকেটার আসতো না।

বাংলানিউজ : আপনার উদযাপনটা নিয়ে একটু বলবেন? কেন এভাবে পুরো মাঠ দৌড়ে বেড়ান...

তাহির : দেখুন, আমার মনে হয় এটা আমার এমনিতেই আসে। কোনো উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আসি না। হ্যাঁ, এখন একটু রোনালদোর উদযাপন করছি। কারণ আমার ছেলে চায় যেন এমন করি। এটা ছাড়া আমার যে উদযাপন, সেটা খেলার প্রতি সম্মান, আবেগের জন্য হয়ে যায়। আমি সবসময় এটার জন্য অপেক্ষা করি, যতবার সুযোগ পাই; চেষ্টা করি যত বেশি সম্ভব উপভোগ করতে।

বাংলানিউজ : রোনালদোর উদযাপন করেন; তার এনার্জি নিয়ে অনেক কথা হয়। আপনার ব্যাপারেও একটা প্রশ্ন খুব কমন। বয়স প্রায় ৪৫ বছর হয়ে গেছে। এখনও এত এনার্জি কোথায় পান?

তাহির : রোনালদো বিশ্বমানের অ্যাথলেট, তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেবেনই। সব তরুণরাই অনুপ্রেরণা খুঁজবে এই বয়সে সে যেভাবে খেলছে; এবং যা করছে, অসাধারণ। আমার নিজস্ব লক্ষ্য ছিল ছোটবেলায়, অন্য সব ছেলেদের মতোই।

আমরা কোথায় যেতাম, দলের হয়ে বল করতে চাইতাম। লক্ষ্যটা সবসময়ই ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার। আমার সুযোগ হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলার; যেটা আমার স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ছিল ‍পুরো দুনিয়াজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট খেলে নিজের নাম করা।

বয়সের ব্যাপারে যদি বলেন, আমি এটার দিকে তাকাই-ই না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি দলের প্রয়োজন মেটাতে পারছি, ঘুরে বেড়াতে পারছি; এটাই আসল ব্যাপার। আধুনিক যুগের ক্রিকেটে ৪৪, ৪০, ৩৮ এ খেলতে পারবেন। কিন্তু যদি আপনি ভালোভাবে মুভ না করতে পারেন, আমার মনে হয় না মানুষ আপনাকে হিসাব নেবে না, এমনকি আপনি ভালো ব্যাটার বা বোলার হলেও।

আমার কাজের প্রতি সম্মান আছে। কেন আমি এখনও খেলছি? এটা আসলে আড়ালেই থাকে। কেউই জানে না কীভাবে আমি এখনও খেলছি, দৌড়ে বেড়াচ্ছি। কারণ আমি যখন জিমে বা দৌড়াতে যাই; কেউ দেখে না। এসব পরিশ্রম যখন মাঠে এসে ফল দেয়; সেটা আপনাকে আনন্দ ও অনুপ্রেরণা দেয়।

বাংলানিউজ : বাংলাদেশ তো হন্যে হয়ে লেগ স্পিনার খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। আপনার কোনো পরামর্শ আছে?

তাহির : দেখুন, লেগ স্পিনার হিসেবে বলতে চাই। যদি কোনো তরুণ লেগ স্পিনার আমার কথা শুনে থাকে- আধুনিক যুগের ক্রিকেটে স্পিন করা সহজ না। যখন ব্যাটার পুরো মাঠজুড়ে শট খেলে। একটা জিনিস তোমাদের মাথায় রাখতে হবে, কখনও হাল ছাড়া যাবে না। লড়াই করতে হবে পরিস্থিতির সঙ্গে। নিজের উন্নতি করতে হবে।

কারণ যদি তোমার শুধু এক দুইটা লেগ স্পিন বা ভ্যারিয়েশন থাকে। আমার মনে হয় না তুমি মানিয়ে নিতে পারবে। ক্রিকেট গত ১০ বছরে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। যদি ক্রিকেটে টিকে থাকতে হয়, তাহলে আমাদের নিজেদের স্কিল উন্নতি করতে হবে।

আমি এখানে আছি, কোনো তরুণ এলে আমি তাকে সাহায্য করতে ও অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে তৈরি আছি। আমার জন্য, লেগ স্পিনার হিসেবে; যদি আপনি স্পিনার হন, পরামর্শ হচ্ছে- হাল ছাড়া যাবে না। কারণ কোনো ম্যাচে হয়তো অনেক রান দিয়ে দিতে পারেন, তখন মনে হবে হয়তো আমাকে দিয়ে হবে না বা এমন কিছু। কারণ আমি এসবের ভেতর দিয়ে সবসময় গিয়েছি। কিন্তু স্পিনার হিসেবে হাল ছাড়া যাবে না।

বাংলানিউজ : আপনি তো আব্দুল কাদিরের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন?

তাহির : দেখুন, উনি আমার আদর্শ। এমন একজন- যার মতো হতে চাইতাম। যদিও কখনো তার কাছাকাছি যেতে পারিনি। উনি ছিলেন কিংবদন্তি। আমার কাছে যথেষ্ট শব্দ নেই তাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর। সবসময়ই তার জন্য দোয়া করি।

বাংলানিউজ : ছোটবেলায় কি পাকিস্তানের হয়েই খেলতে চাইতেন?

তাহির: আপনার যদি বাংলাদেশে জন্ম হয়, তাহলে এখানকার হয়েই খেলতে চাইবেন। তাই না? আমারও ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। আমি পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছি, এ দলের হয়েও। তবে যেমন বলেছি, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যে সুযোগ পেয়েছি তার জন্য কৃতজ্ঞ।

বাংলানিউজ : পাকিস্তান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা। এতগুলো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলছেন। অনুপ্রেরণাটা কী?

তাহির : আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলাটাই প্রেরণা ছিল, প্রেরণা ছিল ভালো করার, প্রেরণা ছিল নিজেকে নতুন কোনো সুযোগ করে দেওয়ার। যদি আমি সেটা না করি, তাহলে অন্য কেউ করবে। আমি চাই না অন্য কেউ করুক।

কারণ ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল যদি একবার সুযোগ পেয়ে যাই, আমাকে টিকে থাকতে হবে। যদি টিকে থাকতে হয়, তাহলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আপনাকে প্রতিদিন নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে হবে, কোথা থেকে এসেছেন সেসব মনে করতে হবে।

কোন কঠিন জিনিসগুলো পাড়ি দিয়ে এসেছেন। এখন হয়তো জিনিসগুলো সহজ হয়ে গেছে, কিন্তু আপনিও সহজ হলে হবে না। আপনাকে যতটা সম্ভব কঠোর থাকতে হবে। যত বেশি সম্ভব পারফর্ম করতে হবে। আমার মনে হয় এটাই আমার অনুপ্রেরণা।

বাংলাদেশ সময় : ১৫২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪
এমএইচবি/এএইচএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।