ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ মে ২০২৪, ০৫ জিলকদ ১৪৪৫

ক্রিকেট

দুই ভাই, বাবার মৃত্যু, রোনালদো প্রেম—রবিউলের ক্রিকেট জীবন

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩
দুই ভাই, বাবার মৃত্যু, রোনালদো প্রেম—রবিউলের ক্রিকেট জীবন

চট্টগ্রাম থেকে : দু হাত বুকে জমাট বাঁধে কখনো, কখনো তিনি ছড়িয়ে দেন দু পাশে। উদযাপনটা আপনার ভীষণ পরিচিত, অনেক বেশি চেনা।

ওল্ড ট্রাফোর্ডে, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়, তুরিনে বহুবার আপনি এমন কিছু করতে দেখেছেন একজনকে। ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো দু হাত মেলে ‘সিউউউ’ করেছেন অবিশ্বাস্য সব অর্জনের পরে।  

পৃথিবীজুড়ে চর্চিত হয়েছে তার কঠোর পরিশ্রম, হাল না ছাড়া আর স্বপ্নের গল্প। কোথাও কোথাও হৃদয়েও গেঁথে গেছে কারো কারো। যাদের বুকে, স্বপ্নে, মন ও মননে জমেছেন রোনালদো, রবিউল হক তাদেরই একজন। আপনি হয়তো দেখেছেন তাকেও, বিপিএলে; উইকেট নেওয়ার পর রোনালদোর সেলিব্রেশনে।

অথচ রবিউলের জীবনে আঁধার নেমে এসেছিল কখনো। বাবার মৃত্যুর তারিখ তিনি বলতে পারেন এক নিমিষে, ভাইদের সেক্রিফাইস তার মুখে আসে; ছলছল চোখ যেন বাঁধ মানতে চায় না এরপর। রবিউল কাঁদেন না। গল্প বলতে বলতে হঠাৎ তিনি বলেন, ‘আমি আবেগী হয়ে যাচ্ছি...’

জীবনের প্রথম সংবাদ সম্মেলন জানান মাঝে। একটু আগে রংপুর রাইডার্সকে জিতিয়ে এসেছেন চার উইকেট নিয়ে। রঙিন দুনিয়া রবিউল দেখছেন এখন। অথচ এক বছর আগেও তার দুনিয়ায় জমেছিল অভিমান। বাকি দুই ভাইকে দেখে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। বাবা বাধ সাঁধেন তাতে, ‘একজনকে নিয়ে ঝুঁকি নিতে পারি। সবাইকে না...’ বলেন এমন।

সেই বাবা মারা গিয়েছিলেন ২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। অনেকদিন ক্যারিয়ারে গতিপথ খুঁজে না পেয়ে কখনো কি হাল ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন? জানতে চাইতেই রবিউল বর্ণনা করেন দুঃখের ওই সময়, ‘বাবা আমার ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক টেন্সড ছিলেন। প্রায় দেড় বছর ইনজুরিতে ছিলাম। উনি হয়তোবা অনেক টেনশন করতেন...আমার কী হবে ক্যারিয়ারে এমন ভাবতেন। আমি কখনও ভাবতাম না। ’

বাবার দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গিয়েছে ঠিকই, তিনি দেখে যেতে পারেননি। রবিউল হক বাবার মৃত্যুর এক দিন পরই দল পান ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। এবার বিপিএলে হলেন ম্যাচসেরা। রবিউল আফসোস করেন টিভিতে ছেলের খেলা দেখার পর বাবা এনামুল হক সরকারের খুশির কথা ভেবে, ‘সবসময় ব্যাক অব দ্য মাইন্ডে কাজ করে হয়তো আজকে বাবা বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন এরকম লাইভ ম্যাচে দেখলে। ’ 

রবিউলের জীবনজুড়ে মেনে চলেন দুই পথ- পরিশ্রম করেন, চাওয়া-পাওয়ার বাকিটুকু সৃষ্টিকর্তার কাছেই ছেড়ে দেন। ভালো-খারাপটুকু হাত পেতে নিতে দ্বিধা করেন না এতটুকু। স্বপ্ন দেখেন, বেঁচে থাকেন, গল্প তৈরি করতে চান রোনালদোকে দেখে। ২০০৬-০৭ মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের লাল জার্সিতে দেখে প্রেমে পড়া তার। পরে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর হৃদয়ে জায়গা দেওয়া। জার্সির নম্বরটাও তার সঙ্গে মিলিয়ে রাখা।

ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো রবিউলকে বিস্মিত করে যান এখনও, ‘খুব খারাপ পরিস্থিতিতেও দলকে যেকোনো ভাবে কামব্যাক করাতে পারেন, বড় মঞ্চেও। এরকম একটা বিশ্ব মহাতারকার কাছ থেকে কিছুটা হলেও যদি আমি নিজের ভেতর নিতে পারি... কঠোর পরিশ্রম, শক্ত মানসিকতা, যাই বলেন। আমার জন্য এসব অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার হবে। ’

‘রিয়াল মাদ্রিদে সুপার সিজন কাটানোর পরে এত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, এত ট্রফি... জুভেন্টাসে যাওয়ার পর... এখনও তার শক্ত মানসিকতার পরিচয় যেভাবে দিয়ে যাচ্ছেন এটা অনেক বড় কিছু। রোনালদোর এসব অনুসরণ করা হয়। নিজেকেও পাম্প আপ করি, একটা মানুষ কঠোর পরিশ্রম দিয়ে এত কিছু করতে পারলে আমিও মানুষ...অনেক কিছু করতে পারব। ’

রবিউলকে সংবাদ সম্মেলনে আসতে আসতে থামতে হয়েছে কয়েকবার। ছবি তুলেছেন কেউ কেউ, ফ্রেমবন্দি হওয়ার আবদার গিয়েছে পরেও। রবিউল এসবে অভ্যস্ত নন একদমই। কঠিন সময় পাড় করেও লম্বা সময় আসেননি প্রাদপদীপের আলোয়।

২০১৮ সালে খেলেছেন যুব বিশ্বকাপে। এরপর দুবার দল পেয়েছেন বিপিএলেও, আলাদা করে চেনাতে পারেননি নিজেকে। এবার এনসিএলে ১৭ উইকেট নিয়েছিলেন ৪ ম্যাচেই, ছিল ফাইফারও। অথচ প্রিমিয়ার লিগে দল না থাকার শঙ্কায়ও থেকেছেন একটা সময়। তখন তাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন একজন- ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো।

রবিউল তাই প্রতিবার উইকেট উদযাপনে ফিরিয়ে আনেন তাকে, ‘আমার উদযাপন নিয়ে সবাই অনেক উৎসুক। উদযাপনের পেছনে যে আইনকনিক মানুষটা (ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো) আছেন আমার জন্য তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আসল কথা হচ্ছে প্রত্যেকটা খেলোয়াড় কাউকে না কাউকে অনুসরণ করে, আমিও একজনকে অনুসরণ করি। রোনালদোর ওয়ার্ক ইথিকস, কঠোর পরিশ্রম, শক্ত মানসিকতা সবকিছুই। ’

রবিউল হক অনেক কথাই বলেন। কেমন উইকেটে খেলেছেন, দলের নামী তারকাদের থেকে কেমন শিখছেন, কোথায় দেখতে চান নিজেকে; এসবও। রবিউল বলেন দুই ভাইয়ের কথা। কাঁদতে কাঁদতেও চোখের জল আটকান হয়তো শুধুই আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে। বলেন দুই ভাইয়ের সেক্রিফাইসের কথা।  

রবিউল স্মরণ করেন বিশেষ কাউকেও, ‘একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি আমার একাডেমির কোচ নাদিম সাজ্জাদ ভাই। যখন আমি অনূর্ধ্ব-১৮ খেলি, তখন আমার কিছুই ছিল না। উনি এতটা সাহায্য করেছে যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। উনাকে কখনো কিছু দিয়ে ধন্যবাদ জানাতে পারিনি। নাদিম ভাই, আমি আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। ’

‘শুভকামনা রবিউল’ শুনতে শুনতে সংবাদ সম্মেলন কক্ষ ছেড়ে যান রবিউল। কার্পেটে ধাক্কা খাওয়ার পর বলে যান ‘সমস্যা নেই...’। যারা শেকড় ভুলে না সাফল্যের চূড়াতে উঠে, টিকে থাকার লড়াই করতে পারে, কাঁদতে জানে; ঝামেলা থাকে না এসব মানুষের। রবিউল তো তাদেরই একজন। তার সিঁড়ি বেড়ে উপরে উঠা অপেক্ষার গল্প মধুরই শোনায়।

বাংলাদেশ সময় : ০২৪৬ ঘণ্টা, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩
এমএইচবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।