ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

সংকটে দুর্বিষহ দুবলার চরের জেলে জীবন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৭
সংকটে দুর্বিষহ দুবলার চরের জেলে জীবন  দুবলার চরে কোনো সুযোগ-সুবিধাই নেই এসব জেলেদের জন্য। ছবি: বাংলানিউজ

দুবলার চর, সুন্দরবন থেকে ফিরে: দিলীপ মণ্ডলের বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেবদুয়ার গ্রামে। প্রতি বছরের মতো এবারও গত ২২ অক্টোবর সঙ্গীদের সঙ্গে পাড়ি জমিয়েছেন বঙ্গোপসাগরের তীরে সুন্দরবনের কোলঘেঁষা দুবলার চরে।

দুবলার চরের আলোরকোলে সাভার (নিজস্ব শুঁটকি শুকানোর পল্লী) তৈরি করেই লইট্যা, ছুরিসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ ধরতে বঙ্গোপসাগরে যাওয়া শুরু করেন তারা।

গত ৩১ অক্টোবরও সঙ্গীদের সঙ্গে সাগরে যান দিলীপ।

কিন্তু দিনটি মোটেই ভালো ছিল না তার জন্য। নৌকা থেকে সাগরে কাছি নামানোর সময় পায়ে বেধে দুর্ঘটনায় পড়েন তিনি। অন্য সঙ্গীরা অনেক কষ্টে বাঁচাতে সক্ষম হলেও দুবলার চরে ভালো কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় গত এক সপ্তাহেও সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি তিনি।

লক্ষাধিক জেলে-মাঝির কারও জীবনেই নিরাপত্তা নেই।  একজন গ্রাম্য ডাক্তারের চিকিৎসায় কোনোমতে বেঁচে আছেন দিলীপ মণ্ডল।

শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থাই নয়, দুবলার চরের শুঁটকিপল্লীর জেলেদের জন্য নেই কোনো সাইক্লোন শেল্টারও। সাগরে দস্যুদের হামলা তো আছেই।  

আলোরকোলে যাওয়া আরেক জেলে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের শ্রীমন্তকাটি গ্রামের সফিকুল ইসলাম। মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি তৈরি করতে গত ১৪ বছর ধরে দুবলার চরে যান তিনি।

বাংলানিউজকে সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সিডরের সময় এ চরেই ছিলাম আমি। মৃত্যুভয় যে কতোটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে, সিডরের সময় তা দেখেছি। সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাই আজ কথা বলছি। সাইক্লোন শেল্টার না থাকায় খোলা আকাশের নিচে থেকেই সিডর মোকাবেলা করেছেন লক্ষাধিক জেলে-মাঝি’।

তালা সদরের জেলে লিটন অধিকারী বলেন, ‘সাগরে জেলেরা একটুও নিরাপদ নয়। জীবন বাজি রেখে মাছ ধরি আমরা, আর দস্যুরা লুটে নিয়ে যায়। আমাদেরকেও তুলে নিয়ে যায়। মুক্তিপণ না দিলে কেটে সাগরেই ভাসিয়ে দেয়’।

মহাজন রঞ্জিত হালদারও মাঝে মাঝে জেলেদের সঙ্গে সাগরে যান। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ’১৫ কিলোমিটারের দুবলার চরের আলোরকোল, মেহের আলীর চর, নারকেলবাড়িয়া ও ট্যাক অফিস- এ চারটি অংশে শুঁটকিপল্লীর মালিক-শ্রমিক ও জেলে-মাঝি মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষ মাছ ধরে ও শুঁটকি করে জীবিকা অর্জন করছেন। শুধু আলোরকোলেই এবার ১ হাজার ৭০০টি শুঁটকিপল্লী হয়েছে, যার প্রতিটিতে গড়ে ১০ জন করে কর্মরত। কারও জীবনেই নিরাপত্তা নেই। বিপদে পড়লে ডাক্তার নেই, ঝড়ে আশ্রয়ের জায়গা নেই, দস্যুদের হাত থেকে মুক্তি নেই’।

‘অথচ আমরাই প্রতি বছর সরকারকে ৫০-৬০ লাখ টাকা রাজস্ব দেই। জেলে-নৌকা-জাল সবই নিয়ে এখানে আসি, যাওয়ার সময় সরকারকে রাজস্ব দিয়ে যাই। সরকার শুধু নেয়, আমাদের জন্য কিছুই করে না’।

‘চৈত্র মাস পর্যন্ত পাঁচমাসের মতো আমরা দুবলায় থাকি। সরকার সবার জন্য সব কিছু করে। এ সময়টুকু আমাদের জন্য কি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় না? ঝড়ের কবল থেকে প্রাণে বাঁচতে কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টার করা কি খুবই কঠিন?’- প্রশ্ন করেন রঞ্জিত হালদার।

বিপদে-দুর্ঘটনায় অসুস্থ-আহত হলে নেই কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থাও।  ছবি: বাংলানিউজখুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার তালা, আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ, বাগেরহাটের মংলা, শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লক্ষাধিক জেলে-মাঝিকে এভাবেই দুবলার চরে জীবিকার তাগিদে ঝুঁকিতে কাটাতে হচ্ছে প্রতিটি দিন। কিন্তু তাদের জীবন-মানের উন্নয়নে আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ এসব জেলে-মাঝিদের।  

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।