ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

উদ্বাস্তু মানুষ, বাঁচার লড়াইয়ে পরাজিত!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫১ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৪
উদ্বাস্তু মানুষ, বাঁচার লড়াইয়ে পরাজিত! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টফোর.কম

চাল রায়েন্দা, শরণখোলা, বাগেরহাট থেকে : কেউ বাঁধের বাইরে ছোট্ট ঘরে বসবাস করছেন, কারও ঠাঁই হয়েছে বাঁধের ওপর। আবার কেউ সামান্য পরিমাণ জমি কিনে বাঁধের ভেতরের অংশে বানিয়েছেন ঘর।

পরিবার পরিজনসহ এভাবেই বছরের পর বছর বসবাস করছেন সব হারানো নিঃস্ব মানুষেরা। জোয়ারের পানিতে কখনো এদের ঘর ডুবে যায়, আবার কখনো সামান্য ঝড়েই মাটির সঙ্গে মিশে যায় ছোট্ট বসতি।

উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের শরণখোলার মানুষদের জীবন এভাবেই বদলে যায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। দুর্যোগের পর সাহায্য-সহযোগিতা মিললেও এদের অবস্থা বদলায় না। কোথাও যাওয়ার সুযোগ না থাকায় এলাকাতেই তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে চলে। এখানে সেখানে ঘর বাঁধে অস্থায়ীভাবে। উদ্বাস্তুদের ঠাঁই মিলছে না কোথাও। প্রতি বছরই এইসব উদ্বাস্তু মানুষদের লাইন হচ্ছে দীর্ঘ।

সাউথখালী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে চাল রায়েন্দা গ্রাম। এখানে বলেশ্বর নদীর তীরে বসবাস করে বেশ কয়েকটি উদ্বাস্তু পরিবার। এদের থাকার কোনো জায়গা নেই। নেই রোজগারের উপায়। অধিকাংশ পরিবার চলে চিংড়ির পোনা ধরে। নাগরিক অধিকারের সামান্যতম এদের ভাগ্যে জোটে না।

সরেজমিন ঘুরে চোখে পড়ে চাল রায়েন্দায় বাঁধের বাইরে ছোট্ট ছোট্ট ঘর। ঘরগুলো একদিকে বাতাসের ঝাপটার মুখে, অন্যদিকে নদী তীরে ভাঙনের কিনারে। কেউ কেউ বাতাসের ঝাপটা থেকে বাঁচতে গাছপালার আবডালে ঘর বানিয়েছেন। ঠিক ঘর তো এগুলোকে বলা যায় না, বলতে হয় ঝুপড়ি। নারী-পুরুষ ও শিশুরা এখানেই থাকছে কোনোনমতে। নদী-ভাঙন তাড়িয়ে ফিরছে, প্রতি বছর একটু একটু করে পিছনে নিচ্ছে ঘর। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরে এরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ সাহায্য হিসেবে ঘর পেলেও অনেকেই পায়নি। এলাকাটি যেখানে ঝুঁকির মুখে, মাথা গোঁজার একটা নিরাপদ স্থান যেখানে নেই, সেখানে ঘরের সহায়তা দিয়েই বা এই উদ্বাস্তু মানুষেরা কী করবেন!

চাল রায়েন্দা বলেশ্বর নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে আলাপ হলো অনেকজনের সঙ্গে। হাকিমুন, স্বামী-আর্শাদ আলী হাওলাদার, দুলাল হাওলাদার, পিতা-তোতাম্বর হাওলাদার, পিয়ারা বেগম, স্বামী-সিদ্দিকুর রহমান, হাফিজা বেগম, স্বামী- জাকির হাওলাদার, নূর ইসলাম, বাবা-আকবর আলী হাওলাদার, রেক্সোনা বেগম, স্বামী-সাফায়াত আলী, সেতারা বেগম, স্বামী-মৃত আলী আকব্বর। এলাকায় ঢুকতেই এমন আরও অনেক মানুষ নিজেদের কষ্টের কথা জানাতে ছুটে আসেন।
x
দুর্বিষহ উদ্বাস্তু জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে এরা জানালেন নানামুখী সংকটের কথা। তিনবেলা ঠিকভাবে খাবার জোটানো সম্ভব হয়না বলে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না এরা। ১৩-১৪ বছরের বেশ কয়েকজন কিশোর ছবি তুলতে ভিড় করলো ক্যামেরার সামনে। এরা কেউ কখনোই বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার হয়নি। যখন যে কাজ পাওয়া যাচ্ছে, সে কাজই করছে পরিবারকে সহায়তার জন্য।

ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া সম্পর্কে হাফিজা বেগম বলেন, তিনবেলা ভাত জোটানোই কঠিন। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ কীভাবে চালাবো। লেখাপড়ার গুরুত্ব তো বুঝি, কিন্তু লেখাপড়া চালিয়ে নেব কীভাবে?

আরেকজন দুলাল হাওলাদার বলেন, সরকার অনেক সুবিধার কথা বলে। আমরা তো সুবিধাই পাই না। অসুখ হলে ডাক্তার পাই না, ওষুধ পাই না। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারি না। আমরা যে কোথায় বসবাস করি, সেটা কী রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানেন?

চাল রায়েন্দা বাঁধের বাইরে থাকা এই বাসিন্দারা জানালেন, এক সময় এদের জমিজমা ছিল। কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। নদীভাঙনসহ নানামুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের সে অবস্থা কেড়ে নিয়েছে। বলেশ্বর নদীতে এদের বহু জমি ভেঙে গেছে। সিডর-আইলা-মহাসেনে ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। এক সময়ের জমির মালিক এই মানুষগুলো মজুরে পরিণত হয়েছে। এলাকায় ছোট ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগও নেই। তাই অনেকে অনেকেই কাজের জন্য ছোটেন বাইরে।

স্থানীয় জেলে কমিউনিটির নেতৃন্থানীয় ব্যক্তি মো. সোলায়মান হাওলাদার বলেন, নানামুখী দুর্যোগ উপেক্ষা করে এরা চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। থাকার জায়গার সংকট থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই এরা সংকটের মুখোমুখি। কাজ না থাকায় তিনবেলা ঠিকমত খেতেও পারছে না। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি সরকারের নজর দেওয়া উচিত।

এলাকার ইউপি সদস্য শাহজাহান বাদল জোমাদ্দার বলেন, বিপন্ন এ মানুষদের সংকটের শেষ নেই। প্রতিটি দুর্যোগ এদের জীবনের সংকট আরও বাড়িয়ে দেয়। এদের যথাযথ সাহায্য সহযোগিতা আমরা করতে পারছি না। এসব মানুষদের প্রতি রাষ্ট্রের সুনজর প্রয়োজন।

চাল রায়েন্দা গ্রামের পথ ধরে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে ভাঙন রোধ আর মানুষের নিরাপত্তায় তৈরি হচ্ছে নতুন বাঁধ। সেই বাঁধের বাইরেই থেকে গেল ভিটেহারা অনেক মানুষ। এরা কী সারাজীবন বৃত্তের বাইরেই থাকবে? খাদের কিনারেই পড়ে থাকবে? বার বার এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খায় এলাকার মানুষের মনে।    

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]

বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।