ঢাকা, শুক্রবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

দূরের স্কুল, গাছতলায় ক্লাস

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫২ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৪
দূরের স্কুল, গাছতলায় ক্লাস ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চরমোন্তাজ, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে, নৌকায় নদী পেরিয়ে অতিকষ্টে স্কুলে পৌঁছে ক্লাস করতে হয় গাছতলায়। কেউ ১০ কিলোমিটার, কেউবা পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে আসে।



নানা প্রতিকূলতায় কোনোমতে প্রাথমিকের গণ্ডি পার হওয়ার সুযোগ হলে ভরসা ইউনিয়ন সদরের একটিমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

দূর-দূরান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা এতো কষ্ট করে কোথায় এসে পড়াশোনা করছে, তা চোখে না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই। এলাকার মানুষের কাছে ‘সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ’ বলে পরিচিত এ ছাত্তার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষ সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করে গাছতলায়। টেবিল-চেয়ার-বেঞ্চের সংকট রয়েছে। শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক কম। বিজ্ঞানাগারে যন্ত্রপাতি নেই। কম্পিউটার শিক্ষার সুযোগ নেই। বিদ্যালয়টি বোর্ডের স্বীকৃতি পেলেও এখন পর্যন্ত নিম্ন মাধ্যমিক হিসেবেই রয়ে গেছে।

এই হচ্ছে, উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজের শিক্ষাচিত্র। প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা লিখে শেষ করা যাবে না। বিদ্যালয়ের ভবন নেই, শিক্ষক নেই, আসবাবপত্র নেই। এগুলো যেন এক স্বাভাবিক চিত্র!

সরেজমিনে দেখা গেছে, চরমোন্তাজ ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র স্লুইস বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে এ ছাত্তার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠের এককোণে গাছতলায় ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীরা বৃত্তাকার বসে শিক্ষকের কথা শুনছে।

গ্রুপভিত্তিক ক্লাস হলে সর্বমোট ক্লাসের সংখ্যা দাঁড়ায় নয়টি। সেখানে কক্ষ আছে মাত্র পাঁচটি। সে কারণে শিক্ষার্থীদের নিয়ে গাছতলায় ক্লাসে বসেন শিক্ষকেরা।

বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মো. ইকবাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউনিয়নের সব এলাকা থেকে ছেলেমেয়েরা এ বিদ্যালয়ে আসে। কিন্তু, বিদ্যালয়টি নানা সংকটে ডুবে আছে।

তিনি বলেন, বিজ্ঞানাগারে নেই কোনো যন্ত্রপাতি। ফলে, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনেক কিছুই অজানা থাকে। বেসরকারি সহায়তায় বিদ্যালয়টিতে চারটি কম্পিউটার এসেছিল। এর তিনটিই অচল। কোনোমতে ক্লাস চলে একটি টিনশেড ঘরে।

নানামুখী সংকটের মধ্যেও দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থী আসে এই স্কুলে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরআণ্ডা থেকে এ বিদ্যালয়ে আসতে একটি নদী পার হতে হয়। নদীসহ স্কুলের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। চর মার্গারেট থেকে আট কিলোমিটার, চর লক্ষ্মী থেকে ১০ কিলোমিটার, চর মণ্ডল থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে শিক্ষার্থীরা এ বিদ্যালয়ে আসে।

আসা-যাওয়ায় তাদের দ্বিগুণ পথ অতিক্রম করতে হয়। বর্ষা ও ঝড়ের মৌসুমে দুর্ভোগের শেষ থাকে না তাদের!

চরআণ্ডা থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েদের নয়ারচর খেয়াঘাট পার হতে হয়। একদিন সকালে এ ঘাট সরেজমিনে তাদের দুর্ভোগের চিত্র দেখতে পায় বাংলানিউজ।

খেয়া থেকে কিনারে ওঠার জন্য এপাড়-ওপাড়ে নেই কোনো ঘাট। উঠতে হয় কাদাপানি ভেঙে। যাত্রী পারাপারের জন্য আছে একটিমাত্র নৌকা। ক্লাসের সময়ে ঘাটেই বসে থাকতে হয় ছেলেমেয়েদের। আবার বর্ষায় নদী উত্তাল থাকাকালে খেয়া বন্ধ থাকায় স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।        

চরমোন্তাজ ইউনিয়নের লক্ষ্মীবেস্টিন আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর নয় বছরেও এমপিওভুক্ত হয়নি। দুর্গম এবং দারিদ্র্যপীড়িত চরাঞ্চলের বঞ্চিত ছেলে/মেয়েদের শিক্ষিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও নোরাড- এর আর্থিক সহায়তায় ফিমেল সেকেন্ডারি স্কুল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্টের আওতায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি এ কে আবু সামছুদ্দিন আবু মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রায় তিন বছর ধরে প্রকল্প থেকে আটজন শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে।

এরপর প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী ছয় বছর ধরে বিনা বেতনে পাঠদান করে আসছেন। বর্তমানে বেতন-ভাতা না পেয়ে তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।

বাংলানিউজ সরেজমিনে জানতে পারে, অধিকাংশ অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর প্রয়োজন মনে করেন না। তার ওপর প্রাথমিকে নেই লেখাপড়ার পরিবেশ। অতিকষ্টে প্রাথমিক অতিক্রম করলে সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে অভিভাবকদের বিপদের আর শেষ থাকে না।

অভিভাবকেরা জানান, মাধ্যমিক অতিক্রম করলে তো আরো বিপদ! কারণ, এই দ্বীপে কোনো কলেজ নেই। কলেজে পড়তে হলে দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় রাঙ্গাবালী কিংবা গলাচিপা উপজেলা সদর অথবা পটুয়াখালী জেলা সদরে।            

চরআণ্ডার সমুদ্র মোহনায় সাগর বাজারে আলাপ হয় বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে। কথা হয়, আট থেকে ১০ বছর বয়েসী শিশু-কিশোরদের সঙ্গে।

তারা জানালো, প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পড়তে হাঁটতে হয় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। এর ওপর দারিদ্র্য তো আছেই। সংসার চালাতে কষ্ট হওয়ায় ছেলেদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজে নেন অভিভাবকেরা।

চরআণ্ডা নামের বিচ্ছিন্ন দ্বীপটি চরমোন্তাজ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের মেম্বর মহিউদ্দিন বাচ্চু বাংলানিউজকে বলেন, এটি ইউনিয়নের একটি বিচ্ছিন্ন ওয়ার্ড। অথচ এখানে একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। সরকার সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণের যে কথা বলছে, তা এই দ্বীপের বেলায় প্রযোজ্য নয়।              

বাংলাদেশ সময়: ০২৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।