ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

চিংড়ি ঘেরেই সর্বনাশ!

মাহবুবুর রহমান মুন্না ও সরদার ইনজামামুল হক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৪
চিংড়ি ঘেরেই সর্বনাশ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল থেকে:

ঘেরে ঘেরে ঘেরাও হইলো চারিদিক,
ঘেরের ঘোড়া চলছে ছুটে দিগ্বিদি্ক?
অল্প পুঁজি বেশি লাভ, চতুরপাশে চিংড়ির চাষ.
(ওরে) জল্পনা কল্পনা কতো করছে বৈজ্ঞানিক?
হারে হারে হাড়িয়া, নিচ্ছে সবই কাড়িয়া.
(ওরে) রেজিস্ট্রি করিয়া মনের চৌহদ্দী নাই ঠিক?
এতো দিলাম বেড়িবাঁধ, তবুতো মেটেনি সাধ.
(ওহো) শরীর চালায় যারা যারা জীবনের সবদিক?
বাগদা নিলো ফলাইয়া, জমিন গেছে তলাইয়া.
(ওরে) জীবনডা জ্বালাইয়ে খাইলো যতো ঘের মালিক?
পানিতে নেই গুণ বেগুণ বাতাস গেলো পূবের কোণ
ডাউলে চাউলে হয় খেচোড়ী তল্লাটে নাই ভিড়?- কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

অনেক আগেই মংলার সন্তান কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চিংড়ি ঘেরের উপর তিক্ত হয়ে কবিতায় এভাবেই প্রতিবাদ করেছিলেন। কবি শৈশব ও যৌবনের উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন মংলার মিঠেখালি গ্রামে।

দেখেছেন খুলনা ও বাগেরহাট জেলার চিংড়ি চাষের ভয়াবহ চিত্র। দেখেছেন কিভাবে ক্ষেতের জমি পরিণত হয় চিংড়ি ঘেরে। চিংড়ি চাষের উদ্যোক্তারা মানুষের ওপর কি পরিমাণ অত্যাচার অনিয়ম আর জবরদস্তি করেছে। কিভাবে এই নতুন পণ্যের চাষের ধাক্কায় পাল্টে গেছে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা জনপদের চালচিত্র।

সেই চিংড়ি ঘের বহুমাত্রিক সর্বনাশা হয়ে আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেল মংলা-ঘষিয়াখালী গ্রাস করেছে। ঘের মালিকরা এই নৌ চ্যানেল সংলগ্ন খালে বাঁধ দিয়ে নাব্যতা সঙ্কটে ফেলেছে নদীকে। ফলে মৃত্যু ঘটেছে এই নৌ রুটের। মংলা ও রামপালের চিংড়ি ঘের বিরোধী কয়েকজন বাংলানিউজকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে মংলা-রামপাল এলাকায় চিংড়ি ঘেরের বিস্তার-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতেই মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ চ্যানেল থেকে আশপাশের অসংখ্য সংযোগ খাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পোল্ডার নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটার গতি হারিয়ে দ্রুত বালু জমে ভরাট হয়ে গেছে পশুর চ্যানেল থেকে বলেশ্বর নদের মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত বা সংযোগকারী মংলা নদী জুড়ে থাকা প্রায় ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মংলা-বেতবুনিয়া-ঘষিয়াখালী নৌ চ্যানেলটি।

তারা জানান, শুধু সংযোগ খাল বন্ধ করেই চিংড়ি ঘেরের মালিকরা ক্ষান্ত হননি। জোর করে তারা সাধারণ কৃষকের ফসলি জমি দখল করেছে। যে জমি দিতে অস্বীকার করেছে তাদের ওপর বেপরোয়া নির্যাতন চালিয়েছে। ঘের নিয়ে এ এলাকায় খুন-রাহাজানি, লুণ্ঠনের মতো ঘটনা আগেও ঘটেছে, এখনও ঘটছে। নৌ চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এক দিকে ভারতের সাথে নৌ-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে অন্যদিকে বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এই বেকার-কর্মহীন যুবকের দলই পতঙ্গের মত ছুটে গিয়ে সন্ত্রাসীদের দলে নাম লেখায়।

রামপালের রোমজায়পুর এলাকার সত্তর বছর বয়সী আব্দুস সালাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাগে এলাকায় বাগদা ঘেরের কারণে সব সর্বনাশ হইছে। আশির দশক থেকে এ সর্বনাশ শুরু হইছে। নদী মরছে। আমাগো মারছে। এই রুট বন্ধ থাকায় সুন্দরবনে জাহাজ ডুবয়া বনডারও সর্বনাশ করছে।

রামপালের সোনাতুনিরয়া এলাকার বাসিন্দা গিলতলা কলেজের ছাত্র নাজমুল সরদার বলেন,  রামপাল উপজেলার প্রভাবশালী মহল নদীর শাখা খালগুলো দখল করে দীর্ঘদিন ধরে চিংড়ি চাষ করে আসছে। ফলে এই নদীর প্রবাহিত পানি ওই শাখা খালগুলোতে প্রবেশ করতে পারে না। যার কারণে নদী মরে গেছে। এসব খাল দখলমুক্ত করতে না পারলে সরকারের নেয়া চলমান খনন কোন কাজে আসবে না বলে মনে করেন তিনি।

মংলা বন্দরের একটি সূত্রে জানা যায়, আগে ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দুই অর্থ বছরে প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে এই চ্যানেলের রামপাল উপজেলার পেড়িখালী অংশে খনন কাজ চালিয়ে এক পর্যায়ে তা পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিলো বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডাব্লিউটিএ। বর্তমানে ৫টি ড্রেজার দিয়ে ধীর গতিতে চলছে খনন কাজ। ভরাট হওয়া কুমারখালী নদী এখন মানুষ পায়ে হেঁটে পার হচ্ছেন।

কুমারখালী এলাকার স্কুল শিক্ষক মো. আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, নদী ভরাটের কারণে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলটি বন্ধ থাকায় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলসহ ভারতের সাথে নৌ-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শ্যালা নদী হয়ে বিকল্প পথে নৌযান চলাচল করায় সুন্দরবনের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। তাছাড়া ৮৭ কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ অতিক্রম করায় ব্যবসায়ীদের পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। তাই পরিকল্পিতভাবে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নদীটি খনন করার দাবি জানান তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রামপাল-মংলা চিংড়ি ঘের বিরোধী আন্দোলনের এক নেতা বলেন, এখনও এই দুই উপজেলায় যারা চিংড়ি ঘের করছেন তারা নামে-বেনামে অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের পোষে। যাদের প্রধান কাজ চাঁদাবাজি করা, চিংড়ি বিরোধীদের শায়েস্তা করা, প্রয়োজনে গুম-খুন-ধর্ষণ করা। এসব অপরাধে এদের বিরুদ্ধে থানায় ডজন ডজন মামলা থাকলেও পুলিশ ওদের ধরছে না।

মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বিকল্প হিসেবে শ্যালা নদীর রুট দিয়ে ২০১১ সালের মে থেকে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ও পণ্যবাহী কার্গো চলাচল শুরু হয়। গত ৯ ডিসেম্বর ফার্নেস তেলবাহী ট্যাঙ্কারডুবির পর এ রুটে ভারী নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ৬০ কিলোমিটার এ রুটে প্রতিদিন দেড় শ’ থেকে দুই শ’ ভারী নৌযান চলাচল করত।

সুন্দরবনের শ্যালা নদীর রুট দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় মংলা সমুদ্রবন্দরের পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ আটকা পড়েছে। একই সঙ্গে সার, জ্বালানি তেল, লবণ ও সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে বেশ কিছু লাইটারেজ জাহাজ বন্দর ত্যাগ করতে পারছে না। এ ছাড়া মংলা, খুলনা ও আশপাশের এলাকায় আটকা পড়েছে শতাধিক লাইটারেজ জাহাজ।       

পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে বাগেরহাট-৩ আসনের (মংলা-রামপাল এলাকা) সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, এই এলাকায় চিংড়ি চাষ শুরুর সময় থেকে আমি এর বিরোধিতা করে আসছি। সে সময় স্থানীয় প্রশাসনকে সঙ্গে পাইনি। তখন ব্যবস্থা নেওয়া গেলে আজ এ অবস্থা তৈরি হতো না।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর গত ২৩ ডিসেম্বর থেকে মংলা বন্দরের আন্তর্জাতিক নৌরুট মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল সংলগ্ন ২৩টি খালের অবৈধ বাঁধ ও পলি অপসারণ কাজ শুরু হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বৈধ-অবৈধ নানা কায়দায় মাছের ঘের করে এ এলাকার নদীগুলোতে এমন বিপর্যয় ডেকে আনা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে এখন গোটা এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ-জীববৈচিত্র্যের ওপর। আমরা এখন যেকোনো মূল্যে এখানকার নদীগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে চাই।

** নৌকায় ধানের চাষ!
** নদীর বুকে ইউপি কমপ্লেক্স!

বাংলাদেশ সময়: ০৬০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।