ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ব্যাংকিং

‘অনিয়ম-স্বজনপ্রীতিতে ডুবছে ব্যাংকিংখাত’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
‘অনিয়ম-স্বজনপ্রীতিতে ডুবছে ব্যাংকিংখাত’ ছবি: দিপু মালাকার- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন বলেছেন, ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করা হচ্ছে। ব্যাংক কর্মকতাদের মধ্যে একটি প্রচলিত নিয়ম হয়েছে, যাদের আছে তাদের ঋণ দাও, যাদের নেই তাদের দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

প্রকৃত ঋণগ্রহীতাদের সাতঘাট দেখানো হয়। সৃজনশীল, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও মহিলাদের জন্য কোনো উদ্যোগ নেই।

 

বৃহস্পতিবার (২১ এপ্রিল) জাতীয় প্রেসক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক’র (সুজন) উদ্যোগে ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তৃতাকালে এসব কথা বলেন তিনি।

সালেহ উদ্দিন বলেন, ব্যাংকারদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। ছোট উদ্যোক্তাদের যথা সময়ে ঋণ দিতে হবে। এসব দায়িত্ব পালন করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় এমন হচ্ছে।

অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে ব্যাংকগুলোকে একেবারে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। আবার বেশি নিয়ন্ত্রণও করা যাবে না। একটা ব্যালেন্স রাখতে হবে। আমাদের যে নীতিগুলো আছে সেগুলো আর্ন্তজাতিক মানের। এগুলো পরিপালনের ব্যাপারে আন্তরিক না হলে এর দায়-দায়িত্ব ব্যাংকগুলো ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর বর্তায়। এগুলো না পালন করলে যতো কথাই বলি, কোনো কাজই হবে না। সব কিছুর জন্য দক্ষ ও সৎ মানুষের দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গর্ভনর বলেন, আইটি সিকিউরিটির কথা বলা হচ্ছে। আইটির ভালো মেশিন, ভালো সফটওয়্যার এগুলো চালাবে কারা? মানুষ। এই মানুষগুলো যদি যথাযথ হয়, তাহলে কাজ হবে। আর ওই মানুষগুলোকে যদি আপনারা ঠিক না করেন তাহলে অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে না। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হচ্ছে বিচারহীনতা। ধরা পড়লে বিচার হয় না, দীর্ঘসূত্রিতা হয়। অতিদ্রুত দৃশ্যমান শাস্তি হলে অনিয়ম ও দুর্নীতি কমে যাবে। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে।

বেসিক ব্যাংকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভালো লোকদের হয়রানি করা হচ্ছে। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।  

সালেহ উদ্দিন বলেন, আর্থিকখাতে যদি রাজনীতি ঢুকে যায় তাহলে এটাকে রক্ষা করা খুবই কঠিন। কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে। সেটাকে আপনি অফিসে, বোর্ড রুমে নিয়ে আসবেন, এটা হতে পারে না। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা না থাকলে ভালো রিক্রুট হবে না, যথাযথভাবে প্রমোশন হবে না, অনিয়মও যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি স্বচ্ছ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, শুধু অটোনমি করলে হবে না। তার প্রয়োগ করতে হবে। আরও শক্ত অবস্থানে নিতে হবে। আসল কাজ কোর ব্যাংকিং থেকে দূরে সরে গেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা যে কম তা নয়, ক্ষমতা যতোটুকু আছে তার কতোটুকু প্রয়োগ করছে তা বিবেচ্য বিষয়। ক্ষমতার প্রয়োগের জন্য যথাযথ ও যোগ্য লোক নিয়োগ করতে হবে।

তিনি ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অডিট নিয়মিত করা, ব্যাংকগুলো যাতে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সেদিকে নজর রাখা, সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কাকে ঋণ প্রদান করা হবে সেটি বিবেচনায় আনা, ঋণ আবেদনকারীর তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ চুরির ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি। অন্যান্য দেশেও এ রকম ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। আর্থিকখাতের দুর্নীতি রোধে যাদের দায়িত্ব রয়েছে তাদের অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।

ব্যাংকিং খাতের এ হতাশাজনক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নতুন গর্ভনর যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফিনএক্সেল’র চেয়ারম্যান ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমদ। তিনি বলেন, গত দেড় দশকে ব্যাংকিং খাতে নয়টি বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে। গত সাত বছরে ঘটা ছয়টি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি চুরি বা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বড় এসব আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ। কিন্তু একটি কেলেঙ্কারিরও বিচার হয়নি। উল্লেখযোগ্য কারো শাস্তি হয়নি এখনও।

এ সময় তিনি ব্যাংকিং খাতে ঘটে যাওয়া নয়টি বড় কেলেঙ্কারির বিস্তারিত বিবরণ ও ছোট-খাট আরও কিছু অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ বড় সমস্যা। নিরাপত্তাহীনতা ও বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ না থাকায় সুইস ব্যাংকে বেড়েছে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থ।

এ সময় তিনি রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের অনুমোদন ও পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার সমালোচনা করেন।  

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, শুধু আর্থিকখাত নয়, সব খাতেই বিচারহীনতা বিরাজ করছে। অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি দেখা দিয়েছে। তবে আশার কথা, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির বিষয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তারা যথাসময়ে তাদের প্রতিবেদন পেশ করেছে।

ইআরজি’র নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির বলেন, আর্থিকখাতের যে পরিবর্তনগুলো সারা বিশ্বব্যাপী ঘটছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতের পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। আমাদের সেই দক্ষ জনবল নেই যারা প্রযুক্তির ওপর প্রভাব রাখে। প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণে যে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন তা করা হচ্ছে না।

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের আর্থিক খাতে বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে, আর এ অবস্থা চলতে থাকলে রিজার্ভের টাকা চুরি, বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক ও পুঁজি বাজার কেলেঙ্কারির মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।

সভাপতির বক্তব্যে সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ব্যাংকিং খাতে অত্যন্ত বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। এ খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। কী কারণে আজ এ অবস্থা তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। দলীয়করণ ও রাজনীতি ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

তিনি অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব ও নজরদারি আছে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬/আপডেট: ২১১১ ঘণ্টা
এসই/জেডএস/কেআরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।