► দুই বছরে গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১.৭০ শতাংশ।
► ২০৩০ সালের মধ্যে আমন ও আউস ধানের উৎপাদন কমতে পারে ৩ লাখ ৭৬ হাজার টন।
► উপকূলীয় জেলাগুলোর কৃষক পরিবারে ৪৪% শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
“পথের কেনারে মোর ধান ক্ষেত, সবুজ পাতার পরে,
সোনার ছড়ায় হেমন্তরাণী সোনা হাসিখানি ধরে। ”
বাংলাদেশের ধানক্ষেতের দৃশ্য নিয়ে এমন কবিতা লিখেছিলেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন। তবে আমাদের গ্রামবাংলার এমন দৃশ্য ক্রমেই ধূসর হতে শুরু করেছে। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের কষাঘাতে দেশে কৃষি উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। দিন দিন তৈরি হচ্ছে খাদ্য সংকটের ঝুঁকি, বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এই সমস্যা আরও প্রকট। লবণাক্ত জমির পরিমান বাড়ছে। ফলে ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। দুই বছরে গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১.৭০ শতাংশ।
আইইউসিএন (International Union for Conservation of Nature- IUCN) প্রকাশিত ‘Climate Change and Agriculture in Bangladesh’ (জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি) শীর্ষক গবেষণা অনুযায়ী ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত জমির পরিমাণ প্রায় ২৬% বেড়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এটি ৩৯% পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে করে প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টর জমি ফসল উৎপাদনের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। লবণাক্ততার কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে আমন ও আউস ধানের উৎপাদন ৩৭৬,০০০ টন কমে যেতে পারে বলছে গবেষণাটি। বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরা, খুলনা ও ভোলা জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন হেক্টর জমি খরা, বন্যা বা জলাবদ্ধতার কারণে আংশিক বা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বছরে গড়ে ১.১ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।
খুলনার পাইকগাছার শান্তা এলাকার কৃষক শাফায়েত হোসেন ধানের জন্য বীজ বুনেছিলেন জমিতে। কিন্তু কয়েক বছর একইভাবে চেষ্টা করার পরও তার জমিতে আসেনি সবুজ আভায় সোনালি ধান। যে কারণে পরিবার নিয়ে এখন হতদরিদ্র অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন তিনি।
‘বেশ কয়েকবছর আমাদের কয়েক বিঘা জমিতে কোনো ধান হয় না। খুবই কষ্টে আছি। বীজ বুনলেই তা পুড়ে যাচ্ছে। জমিতে অতিরিক্ত লবণ। ফসল হয় না বলে এখন কেউ আর ধান রোপনও করে না। আমাদের কপাল পোড়া’, ভারি কণ্ঠে বলছিলেন তিনি।
ফসল উৎপাদনের ওপর তাপপ্রবাহ ও খরার প্রভাব
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন হেক্টর জমি খরা, বন্যা বা জলাবদ্ধতার কারণে আংশিক বা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বছরে গড়ে ১.১ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।
এই প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় ও অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন ১৫–১৭% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি
PLOS Climate-এ প্রকাশিত ‘Climate Change Impact on Food and Health Security’ (খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব) শীর্ষক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ২০২৪ সালে প্রায় ১.৬৫ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। এদের বেশিরভাগই গ্রামীণ কৃষিপ্রধান এলাকায় বাস করে, যেখানে জলবায়ুজনিত দুর্যোগ সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে।
এই গবেষণা অনুযায়ী, শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার ২২% পর্যন্ত বাড়ার কথা বলা হয়েছিল। আর পরিসংখ্যান ব্যুরো- বিবিএসের গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বলছে , ২০২২ সালের হিসাবে দেশে গরিব মানুষ ছিল ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ, সেটি বেড়ে ২০২৪ সালের জরিপে পাওয়া গেছে ২৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২ বছরে দারিদ্র্য বেড়েছে ১ দশমিক ৭০ শতাংশ।
২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় ৯টি ইউনিয়নে মাটির লবণাক্ততা ৪ দশমিক ০ ডেসিমিটার প্রতি মিটারের বেশি হলে ধান উৎপাদন কমে যেতে পারে ১৫.৬%।
২০২৪ সালে ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিলো পাইকগাছার ওয়াপদার বেড়িবাঁধ। ‘বাঁধ ভেঙ্গে আমাদের কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০টি গ্রাম ডুবে যায়। রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গিয়ে ও পানির স্রোতের সাথে ভেসে গেছে আমাদের ঘরবাড়ি। কোনোমতে আবার বাড়ি ঘরে ফিরেছি। জমিতে চাষ করেছি আমন ধান। প্রথমবার নষ্ট হয়ে যায় বীজ। এরপর আবার চাষ করি। কিন্তু ভালো ফলন হয়নি। পরে ধার দেনা করে বাগদা চিংড়ি চাষ করে আমার স্বামী। কিন্তু সেখানেও মাছ হয়নি। যে কারণে ঠিকমতো বাজার করতি পারে না। আমাদের সন্তানদের মুখে ভালো খাবার দিতে পারি না। অনেক কষ্টে দিন চলতিছে। কি আর কবো দুঃখের কথা। পেট ভরে খেতে পারি না বলে রোগে শোকে ভুগি। ’
কথাগুলো বলছিলেন খুলনার উপকূলীয় উপজেলা পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের ঝিলবুনিয়া গ্রামের হতদরিদ্র কৃষাণী শেফালী সরদার।
হারিয়ে যাচ্ছে ধানের প্রজাতি
সয়েল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় ৯টি ইউনিয়নে মাটির লবণাক্ততা ৪ দশমিক ০ ডেসিমিটার প্রতি মিটারের বেশি হলে ধান উৎপাদন কমে যেতে পারে ১৫.৬%। এদিকে লক্ষ্মীপুর জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে ঐহিত্যবাহী ধানের প্রজাতি হারিয়ে গেছে এবং লবণাক্ততার কারণে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমেছে।
খাদ্য উৎপাদকরাই খাদ্যহীনতায়!
বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কৃষক এখন অপুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগছে।
দারিদ্র্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটে ঝিলবুনিয়া গ্রামের সুস্মিতা সরকারের। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমাদের দেখার কেউ নেই। ঠিকমতো খাবারের যোগান দিতে পারছি না পরিবারে। গ্রামে কাজ-কাম নাই। জমিতে ফসল হচ্ছে না। চারদিকে লবণ পানি। আয় রোজগার নাই।
সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্টিগ্রেটেড নিউট্রিশন SMART সার্ভে ২০২৫-এ দেখা যাচ্ছে, সিলেট বিভাগের হাওর অঞ্চলের কৃষক পরিবারগুলোর মধ্যে উচ্চমাত্রার অপুষ্টি বিরাজ করছে। বিশেষ করে ৬–৫৯ মাস বয়সী শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে অপুষ্টির হার উদ্বেগজনকভাবে বেশি।
Integrated food security phase classification (IPC) ২০২২ এর গবেষণায় উঠে আসে, দেশের প্রায় ২১% জনগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ৭% মানুষ চরম সংকটে।
এছাড়া, ২০২৪ সালের মার্চে প্রকাশিত এশিয়ান পিপলস জার্নাল অব মার্জিনালাইজেশন অ্যান্ড ইনক্লুশন (APJMI) এর তথ্যমতে, উপকূলীয় জেলাগুলোর কৃষক পরিবারে ৪৪% শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, যেখানে ৪০% শিশু বৃদ্ধি প্রতিবন্ধিতা এবং ৩২% শিশু ভুগছে চরম অপুষ্টিতে।
অন্যদিকে, ‘Frontiers in Agronomy’ জার্নালে ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় উপকূলীয় এলাকায় ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে উৎপাদনযোগ্য পুষ্টিকর ফসলের বৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে জানানো হয়। গম, ডাল ও সবজির বদলে একমাত্র বোরো ধানের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় কৃষকদের খাদ্য তালিকায় প্রয়োজনীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
২০২৩ সালের Food Security Information Network (FSIN) রিপোর্টে অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১১.৯ মিলিয়ন মানুষের খাদ্যসংকটের কথা উঠে এসছে। আর integrated food security phase classification (IPC) ২০২২ এর গবেষণায় উঠে আসে, দেশের প্রায় ২১% জনগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ৭% মানুষ চরম সংকটে।
এসব সংকট উতরাতে ইন্ডিজেনাস নলেজ (কৃষকদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান) উপেক্ষা করে প্রযুক্তিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, যা একটি ভুল পদক্ষেপ।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
জলবায়ু পরিবর্তন সবচাইতে বেশি অভিঘাত হেনেছে দেশের খাদ্য শৃঙ্খলে বলে জানান ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)- এর কেন্দ্রীয় আহ্ববায়ক কমিটির সদস্য সচিব শরীফ জামিল শরীফ জামিল। তিনি বলেন, ছয় ঋতুর দেশে এখন আমরা চার ঋতু দেখতে পাই। আর কৃষি উৎপাদনের পুরো বিষয়টিই জলবায়ু পঞ্জিকার ওপর নির্ভরশীল। এ দেশে একেক ঋতুতে একেকরকম খাদ্য ভাণ্ডার ছিল। কিন্তু এখন আর তা দেখা যাচ্ছে না। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনে বদল ঘটেছে কৃষি পঞ্জিকায়। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সাইক্লোন, খড়া, বন্যাসহ নানা প্রলয় দেশের কৃষি উৎপাদনে মারাত্মকভাবে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
এসব সংকট উতরাতে ইন্ডিজেনাস নলেজ (কৃষকদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান) উপেক্ষা করে প্রযুক্তিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, যা একটি ভুল পদক্ষেপ। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে, তাই কৃষকদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ওপর গুরুত্বারোপ করতে তিনি জোর দেন।
তিনি বলেন, আমরা এখনই খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের খাদ্য সম্ভার কমতে শুরু করেছে।
‘জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষি পঞ্জিকায় বদল এসেছে, যে কারণে খাদ্য উৎপাদনে নানামুখী সমস্যা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে উৎপাদনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অভিযোজন কৌশল গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এই অভিযোজন কৌশলের অংশ হিসেবে নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য গবেষণাভিত্তিক ক্রপ-ওয়েদার ক্যালেন্ডার (শস্য পঞ্জিকা) প্রণয়ন উৎপাদনে জলবায়ুজনিত ঝুঁকি হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন কৃষিবিদ নিয়াজ মো. ফারহাত রহমান।
পিএ/এজে