ঢাকা, রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস

মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪

আলম শাইন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০২৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪

সমুদ্র শান্ত। ফণা তোলা কেউটের মতো ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করলেও এখন আর সমুদ্রের তর্জন গর্জন নেই।

ঢেউয়ের গতিও হ্রাস পেয়েছে। ছোট ঢেউয়ের ধাক্কায় তিয়াস ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। এদিকে হাঙর দুটিও স্থির নেই। তিয়াসকে টার্গেট করে তেড়ে যাচ্ছে ক্ষিপ্র গতিতে। কিন্তু নির্দিষ্ট স্থানের কাছাকাছি যেতেই হাঙরের নাক থেকে শিকারের গন্ধ হারিয়ে গেল মুহূর্তেই। হাঙরগুলো বিভ্রান্তিতে পড়ল। শিকার হারিয়ে টর্নেডোর মতো চক্রাকারে ঘুরতে লাগল এবার। জল তোলপাড় করে শিকার খুঁজছে। সে এক ভয়ানক তাণ্ডব! যে তাণ্ডবের বিন্দু-বিসর্গও টের পাচ্ছে না তিয়াস অচেতন থাকায়। অচেতন অবস্থায়ই সে সমুদ্রে ভাসছে আর ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে।

তিয়াসের গায়ে পরা আছে গোলাপি-সাদা রঙের লাইফ জ্যাকেট। জলের তালে তালে দুলতে থাকায় টকটকে গোলাপি রঙটা দূর থেকে নজর কাড়ল বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের। কোস্ট গার্ডের জাহাজ তখন বঙ্গোপসাগরে টহল দিচ্ছিল। উদ্ধারকর্মীরা জাহাজের ছাদে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে সমুদ্রে পর্যবেক্ষণ করছেন। সুনামির পর সমুদ্র স্বাভাবিক হতেই উদ্ধারকর্মীরা নেমে পড়লেন অভিযানে। বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন বিপদগ্রস্তদের। এই পর্যন্ত ২৫-৩০ জনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেনও তারা। দূর থেকে তিয়াসকে ভাসতে দেখে উদ্ধারকর্মী রাহাত কবির জাহাজ থেকে দ্রুত স্পিডবোটে নামলেন। বোটে নেমে চালকের উদ্দেশে বললেন, ‘দ্রুত পশ্চিম দিকে যাও। একজন বিপদগ্রস্ত মানুষ দেখা যাচ্ছে ওইদিকে। ’
‘কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল চালক।
‘ওই-যে, পশ্চিমে তাকিয়ে দেখো। ’
‘দেখেছি। কিন্তু ওইদিকে তো যাওয়া যাবে না, শার্ক জোন। ছোট বোট নিয়ে ওদিকে গেলে বিপদে পড়ব আমরা। ’
‘কে বলল শার্ক জোন; ওখানে তো কেবল দুই-একটা শার্ক। দেখো, শার্কগুলো লোকটাকে টার্গেট করেছে। কীভাবে চিতার মতো তেড়ে যাচ্ছে, দেখো। ওরা কাছাকাছি চলে গেলে আমাদের আর করার কিছু থাকবে না। এক কামড়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আলগা করে ফেলবে চোখের পলকেই। জানি, লোকটাকে উদ্ধার করা আমাদের জন্য রিস্ক হবে। তথাপিও প্রাণপণ চেষ্টা করব তাকে উদ্ধার করতে। যাতে নিজেদের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয় আমাদের। আমরা জেনে শুনেই তো মানবসেবায় নিয়োজিত হয়েছি, সুতরাং আর কথা নয়; হিম্মত রেখে বোটের স্পিড বাড়িয়ে দাও। সতর্ক হয়ে পাশকেটে এগিয়ে যাও। বাকিটা উপরওয়ালার কাছে ছেড়ে দাও। দ্রুত করো, না হলে লোকটাকে বাঁচানো যাবে না আর। ওই দেখো, সাগরের জল তোলপাড় করছে কেমন করে। ’

চালক বোটের স্পিড বাড়িয়ে দিলো। তিয়াসকে লক্ষ্য করে দ্রুত এগুতে লাগল। ততক্ষণে তিয়াস শার্ক জোন থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। উদ্ধারকর্মীরা সতর্ক হয়ে ওর দিকে এগোচ্ছেন। বোট পশ্চিমে মোড় নিতেই তারাও লক্ষ্য করলেন হাঙরগুলো দাঁত কেলিয়ে চক্রাকারে ঘুরছে। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় উদ্ধারকর্মীরা বুঝতে পেরেছেন এ মুহূর্তে তিয়াস মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। সময়ের সামান্য হেরফের হলে দুর্ঘটনা ঘটে যাবে সেকেন্ডের মধ্যেই। হাঙরগুলো দিক পরিবর্তন করতে পারে যেকোন সময়। তাই সবাই খেয়াল রাখছেন হাঙরের গতিবিধির ওপর। অভিজ্ঞ বোট চালকও সমুদ্রবিদ্যায় সামান্য জ্ঞান রাখে। তাই দেরি না করে বোটের সবোর্চ্চ গতি বাড়িয়ে দিলো সে। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা তিয়াসের কাছে পৌঁছে গেলেন। কাছে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন সবাই। কিন্তু তিয়াসের অচেতন দেহ ভাসতে দেখে তাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল মুহূর্তেই। তবে অচেতন হলেও তারা নিশ্চিত নন তিয়াস বেঁচে আছে কি না। তাই দেরি না করে রাহাত কবির তিয়াসের নাকে হাত রাখলেন। তিনি টের পেলেন লোকটার শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে। তার মানে লোকটা বেঁচে আছে; অচেতন। রাহাত কবির তার সহকর্মী হায়দার মাহমুদের উদ্দেশে বললেন, ‘লোকটা বেঁচে আছে এখনো। ধরো বোটে তুলি আগে। ’
হায়দার মাহমুদ বললেন, ‘লোকটা ভাগ্যবান; দুইবার বাঁচলেন। ’
রাহাত কবির মৃদু হেসে বললেন, ‘সবই সম্ভব। উপরওয়ালা ইচ্ছে করলে সবই পারেন। না হলে সুনামির থাবা আর হাঙরের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাঁচলেন কীভাবে এই মানুষটা! জানো হায়দার, আজ আমার খুবই ভালো লাগছে এই লোকটাকে উদ্ধার করতে পেরে। কত লোকই তো উদ্ধার করলাম আজ, অথচ এমন রোমহর্ষক ঘটনা কারো বেলায় ঘটেনি। ’
হায়দার মাহমুদ বললেন, ‘রাহাত ভাই, বিশ্বাস করেন আমারও খুব ভালো লাগছে এখন। মনে হচ্ছে দায়িত্বের বাইরেও আমরা ভালো একটা কাজ করতে পেরেছি। এর জন্য অবশ্য আপনার কৃতিত্বই বেশি। আপনি রিস্ক না নিলে হয়তো আমরা হাঙরগুলোকে এড়িয়ে যথাসময়ে তার কাছে পৌঁছতে পারতম না। আর সময়ের সামান্য হেরফের হলে লোকটাকে উদ্ধার করাও যেত না, এটা সত্যি। ’
‘আমার একার কৃতিত্ব নয় ভাই, আমাদের সবারই প্রচেষ্টা ছিল, তাই দ্রুত তার কাছে আসতে পেরেছি। ’

নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে তিয়াসকে টেনে স্পিডবোটে তুললেন তারা। তিয়াসের শরীর বেশ ঠাণ্ডা। হাত-পা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় ওর দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন। তাই উদ্ধারকর্মীরা দেরি না করে ওকে জাহাজে নিয়ে এলেন। জাহাজে এসে বিস্তারিত ঘটনা সবাইকে জানালেন। রোমহর্ষক ঘটনাটা সবাই শুনে তিয়াসের প্রতি তাদের মমতা বেড়ে গেল। সেবাকমীর্রা ওকে কেবিনে এনেই জামাকাপড় পরিবর্তন করলেন দ্রুত। এরই মধ্যে কেবিনে চলে এলেন জাহাজের ডাক্তার সাহেবও। তাকেও ঘটনার বৃত্তান্ত জানানো হলো। ডাক্তার সাহেব মনোযোগ সহকারে তিয়াসকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। মারাত্মক সমস্যা না হওয়ায় তেমন কোন ওষুধপত্র খেতে দেননি তিয়াসকে। তবে শরীরের দুর্বলতা কাটানোর জন্য একটা স্যালাইন পুশ করলেন শুধু। কেবিন ত্যাগের মুহূর্তে একজন সেবাকর্মীকে ডেকে বললেন, ‘রোগীকে একটু পর্যবেক্ষণে রেখো। আর দ্রুত শরীরে গরম সেঁক দেওয়ার ব্যবস্থা করো। ’
সেবাকর্মী বললেন, ‘এখুনি সব ব্যবস্থা করছি স্যার। ’
ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘জ্ঞান ফিরলে আমাকে জানাবে। আর গরম এক গ্লাস হরলিক্স খাওয়াতে চেষ্টা করবে। আপাতত এই পথ্য-ই রোগীর জন্য। পরবর্তীতে দেখে শুনে অন্য ব্যবস্থা নেবো। তবে রোগীর অবস্থা ততটা খারাপ না। ভয় আর ঠাণ্ডায় বেচারি অচেতন হয়েছেন। একটু সেবাযত্ন করলেই দেখবে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন। ’

উদ্ধারকর্মীদের সেবা-শুশ্রূষায় তিয়াসের শরীরের উষ্ণতা খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েক ঘণ্টা পর ধীরে ধীরে ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। এরপর ডাক্তার সাহেবের পরামর্শ মোতাবেক সেবাকর্মীরা তিয়াসকে কিছু পুষ্টিকর খাবার আর এক গ্লাস হরলিক্স খাইয়ে দিলেন।

জ্ঞান ফিরে এলেও তিয়াস খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। সারাদিন ঢেউ আর স্রোতের সঙ্গে বলপ্রয়োগ করায় শরীর নিস্তেজ হয়ে এসেছে। কোনো কথা না বলে এদিক-সেদিক তাকিয়ে সামান্য খাবার খেয়ে তিয়াস আবার ঘুমিয়ে পড়ল। এরই মধ্যে ডাক্তার সাহেব আরেকবার কেবিনে এসে ওকে দেখে গেলেন। রোগী আশঙ্কামুক্ত হওয়ায় আর বাড়তি ওষুধপত্র খেতে দেননি। তিনি শুধু তিয়াসকেই নয়, উদ্ধারকৃত সবাইকে ঘুরেফিরে দেখছেন। তবে তিয়াসের প্রতি একটু বেশি যত্নশীল হয়েছেন হাঙরের কবল থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পাওয়ার ঘটনা শুনে।

উদ্ধারকৃত সবাইকে জাহাজে রাতে থাকতে হবে। গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলে ফিরতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। তাছাড়া উদ্ধার অভিযান এখনো চলমান রয়েছে। যার ফলে তিয়াসকে জাহাজেই রাত কাটাতে হবে।

সারারাত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল তিয়াস। একবারের জন্যেও চোখের পাতা খোলেনি। চোখ খুলেছে সকাল সাতটা নাগাদ। চোখ খোলার পর এই প্রথম ওর মনে পড়েছে অর্পিতার কথা। অর্পিতা বেঁচে আছে কি না, তা নিশ্চিত নয় সে। শুধু খেয়াল আছে স্রোতের টানে ভেসে যেতে দেখেছিল অর্পিতাকে। পরবর্তীতে কী হয়েছে, তা আর জানার সুযোগ হয়নি। তিয়াসের বুকটা দুমড়ে মুচড়ে আসছে অর্পিতার কথা মনে হতেই। চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। কিন্তু পারছে না; লোকলজ্জায়। দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নামতে লাগল তিয়াসের। বারবার চোখ মুছছে। মনে পড়ছে মায়ের কথাও। মা ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান দ্রুত সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। বাবা বেঁচে না থাকায় মা মেহেরুন্নেসা দায়িত্ব নিয়ে সব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন। ওর একমাত্র ছোট বোন মৌমি’র বিয়ের কথাবার্তাও চলছে এরই মধ্যে। বোনের জন্য পাত্রও মোটামুটি ঠিক করা আছে। তিয়াসের অনুষ্ঠানের পর পরই বোনের বিয়েশাদি হবে। বাবা দবিরুল ইসলাম বেঁচে থাকলে এতটা চাপ সইতে হতো না মা’কে। বাবাই সামলে নিতেন সব কিছু।

তিয়াসের বাবা ছিলেন একটি সরকারি কলেজের অধ্যাপক। পেনশনে আসার দুই বছরের মাথায় গত হয়েছিলেন। তার রেখে যাওয়া তিনতলার বাড়ি ভাড়া আর মাসিক পেনশনের টাকা দিয়েই এখন সংসার চলছে। বাড়িটা রামপুরায়। ভাড়া-টাড়া ভালোই পাচ্ছেন। সংসারে টানাপোড়েন না থাকলেও ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভীষণ টেনশনে আছেন ওর মা। বিশেষ করে সন্তানদের বিয়েশাদি না দেওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। তাই জলদি জলদি ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছেন ওর মা। অথচ গতকাল ঘটে গেল ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা। যে ঘটনার সবটাই তিয়াসের মায়ের অজানা। বড়জোর হয়তো সুনামির কথা জেনেছেন, তাতে যে তার নিজের সন্তান আর হবু পুত্রবধূ উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে গেছে, সে বিষয়ে তিনি ঘুণাক্ষরেও জানেন না। তিনি শুধু জানেন ছেলে দু-এক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। এলেই কয়েক দিনের মধ্যে ধুমধাম করে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান সারবেন।

আর কিছু ভাবতে পারছে না তিয়াস। উদ্ধারকর্মী রাহাত কবিরকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনার বিস্তারিত জানাল সে। তারপর অর্পিতাকে খুঁজে বের করতে রাহাত কবিরকে বারবার অনুরোধও জানাতে লাগল। তিয়াস জানে না, ভেসে থাকতে দেখলে যতটা সহজে উদ্ধার করা সম্ভব, না দেখলে সমুদ্রে কাউকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। বিষয়টা বুঝেও না বুঝার মতো বারবার অনুরোধ করে যাচ্ছে তিয়াস। তার ওপর বাংলাদেশের জলসীমার বিষয়টাও জড়িত এরমধ্যে। জলসীমার বাইরে উদ্ধারকর্মীদের পক্ষে যাওয়াও মোটেও সম্ভব নয়। বিশেষ করে অর্পিতা এমন কোনো বিশেষ ব্যক্তি নয় যে, ওর জন্য উদ্ধারকর্মীরা হন্যে হয়ে খুঁজবে। যতটুকু সম্ভব পর্যবেক্ষণ করার তাই করবেন হয়তো। এর বেশি কিছু উদ্ধারকর্মীদের পক্ষে সম্ভব নয়।

খানিকটা সুস্থ হয়েছে তিয়াস। সকাল নয়টা নাগাদ রাহাত কবির তিয়াসের কাছে এলেন আবার। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তিয়াস, কোথায় পৌঁছে দিলে আপনার জন্য ভালো হবে সেন্টমার্টিন না কি টেকনাফ?’
তিয়াস বলল, ‘ভালো হয় আমাকে সাগরে ফেলে দিলে, দয়া করে এই কাজটা করেন। সেন্টমার্টিন ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার। ’
‘আপনি শান্ত হোন। জানি আপনার মনের অবস্থাটা মোটেই ভালো না। সবই তো শুনলাম, এখন আমার পরামর্শ হচ্ছে সেন্টমার্টিন চলে যান। আপনার হবু স্ত্রীকে পেলে আমরা পৌঁছে দেবো হোটেল কক্ষে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। তিনি যদি বেঁচে থাকেন, বিশেষ করে দেশের জলসীমার মধ্যে থাকেন, তাহলে তাকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব আমরা। ’

তিয়াস চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি আর। সঙ্গীকে সমুদ্রে ফেলে একাকী চলে যেতে হবে, এরচেয়ে দুর্ভাগ্য একটা মানুষের আর কী হতে পারে। এই মুহূর্তে আর কোনো উপায়ও নেই। ঘটনাটা ডাঙায় হলে ভালোমন্দ নিশ্চিত না হয়ে কোনো মতেই ফিরে যেত না। নানান কিছু ভেবে পরিশেষে তিয়াস বলল, ‘আমাকে সেন্টমার্টিন পৌঁছে দেন। ওখানে আমার হবু শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন। তারা নিশ্চয়ই পাগলের মতো হয়ে আমাদের খুঁজছেন। তাছাড়া এখনো বিস্তারিত কিছু জানেন না তারা। ঘটনাটা তাদের আগে জানাতে হবে। ’
রাহাত কবির বললেন, ‘ঠিক আছে আপনাকে সেন্টমার্টিন পৌঁছে দিচ্ছি। আপনার মতোই আরও কয়েকজন ওখানে যাবেন। অপেক্ষা করুন একটু। ’
তিয়াস জিজ্ঞেস করল, ‘সেন্টমার্টিনের পর্যটকদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, কিছু জানাতে পারবেন ভাই?’
‘সুনামির সময় যারা সৈকতে ছিলেন, তাদের ভাগ্য মন্দই জেনেছি। তবে যারা হোটেলে বা উঁচু জায়গায় ছিলেন, তাদের তেমন সমস্যা হয়নি। ’

কথাটা শুনে তিয়াসের কলজে কেঁপে উঠল। হবু শ্বশুর-শাশুড়ির পরিণতি কী হয়েছে কে জানে! প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে তাদের রুম হোটেলের তিন তলায়। আসার সময় রুমের বারান্দায় দু’জনকে বসে গল্প করতে দেখেছেন। নিশ্চয়ই তারা সৈকতে যাননি, না গেলে অবশ্যই তারা সুস্থ আছেন।

রাহাত কবির কেবিন ত্যাগ করার সময় বললেন, ‘আপনি প্রস্তুত থাকুন, এখুনি আমাদের স্পিডবোট সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। জাহাজ প্রায় সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি চলে এসেছে। এখুনি বোট ছাড়বে। ’

কথা বাড়ানোর সুযোগ নেই আর। নেই জাহাজে অবস্থান নেওয়ারও সুযোগ। অর্পিতার জন্য অপেক্ষা করা আর হলো না। তিয়াস মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে অবশেষে সেন্টমার্টিনগামী বোটে চড়তে বাধ্য হলো।

স্পিডবোট সাঁ সাঁ করে ছুটে চলছে উদ্ধারকৃত ৪-৫ জনকে নিয়ে। গন্তব্য সেন্টমার্টিন। দ্বীপের দূরত্ব যত কমে আসছে, ততই তিয়াস আহত পাখির মতো ছটফট করতে লাগল। সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। অর্পিতাকে সমুদ্রে ফেলে রেখে ওর বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস তিয়াসের নেই। তারা জানেন দু’জনই নিখোঁজ। সেই জানাই ভালো ছিল। এমতাবস্থায় তাদের ভুল ভাঙাতে কিছুতেই মনে সায় দিচ্ছে না তিয়াসের। চলবে...

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৩


আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২৩
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।