ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

কৃষি

দক্ষিণের চিংড়িতে স্বপ্ন দেখছেন উত্তরের মানুষ

শরীফ সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৭
দক্ষিণের চিংড়িতে স্বপ্ন দেখছেন উত্তরের মানুষ চিংড়ি হাতে শহীদুল

পবার কর্ণহার (রাজশাহী) থেকে ফিরে: দুই বছর আগের কথা। উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ডাক পান বেকার যুবক শহীদুল ইসলাম। মাত্র তিন দিনের প্রশিক্ষণ। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ শেষে মাত্র ২শ’ পিস পিএল (পোস্ট লার্ভা) চিংড়ি দেওয়া হয় তার হাতে। পুকুরের মিঠা পানিতে সেই চিংড়ি ছাড়া হয়। মাত্র ছয় মাসে তা বড় হয়ে ওঠে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

এই ছিল রাজশাহীর পবা উপজেলার হুজুরীপাড়া ইউনিয়নের কর্ণহার গ্রামের শহীদুল ইসলামের বেকার যুবক থেকে সফল চিংড়ি চাষি হয়ে ওঠার কথা। তার সাফল্যগাথার গল্প শুনে এখন আশপাশের গ্রামের যুবকরাও উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন।

প্রতিদিনই কেউ না কেউ যাচ্ছেন শহীদুলের চিংড়ি প্রকল্প দেখতে।

কেবল গ্রামের লোকজনই নন, ঢাকা থেকে বিভিন্ন সময় বড় বড় মৎস্য কর্মকর্তারাও যাচ্ছেন চিংড়ির পুকুর দেখতে। পরীক্ষামূলক চাষের এ সফলতায় খোঁজ-খবর রাখছেন জেলার শীর্ষ মৎস্য কর্মকর্তারাও।      
   
মিঠাপানিতে গলদা চিংড়ি চাষ করা পবার কর্ণহারের ছোট্ট জলাভূমিটি তাই এখন ‘চিংড়ির জাদুঘর’ হয়ে উঠছে। শহীদুলের শূন্য দশমিক ৫ একরের পুকুরটি যেনো কাঁচা সোনার খনিতে পরিণত হয়েছে।  

আর হবেই বা না কেনো। উত্তরাঞ্চলের মধ্যেই তিনিই প্রথম। আর তিনিই সেরা। পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষ করে অভাবনীয় সফলতা পাওয়া শহীদুলকে এখন গাঁয়ের লোক এক নামেই চেনেন। হাতে চিংড়ি ধরে দেখাচ্ছেন শহিদুলসফল চিংড়ি চাষি শহীদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ২০১৫ সালে পবা উপজেলার সাবেক সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শাহেদ আলীর কাছে চিংড়ি চাষের প্রশিক্ষণ পান। পরে উপজেলা মৎস্য অফিসের মাধ্যমে সরকারি অনুদান নিয়ে নাটোর থেকে পিএল (পোস্ট লার্ভা) বা পোনা চিংড়ি সংগ্রহ করেন।  

এর আগে চিংড়ি চাষের জন্য তার এই পুকুরটি উপযোগী করে তোলেন। ওই বছরের ২৭ জুন পুকুরে ২শ’ পিস পিএল চিংড়ি ছেড়ে দেন। পুকুরের স্বাদু পানিতে মরে যাওয়ার ইতিহাস পাল্টিয়ে চিংড়িগুলো ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে ওঠে। এর পরেই বুকে সাহস জাগে শহীদুলের।  

পরে ২০১৬ সালের জুন মাসে পবা উপজেলা মৎস্য অফিসের সহযোগিতায় তার দেড় বিঘা (০.৫০ একর) পুকুরে ১৩ হাজার পিএল চিংড়ি ছাড়েন। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই একেকটি চিংড়ির ওজন হয় ৭০/৮০ গ্রাম। এর মধ্যে পাইকারি ৮ থেকে ১০ টাকা দরে পাঁচ হাজার চিংড়ি বাজারে বিক্রি করেন। কিছু নিজেও খান। দেখেন স্বাদে-গুণে দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়ির চেয়ে এগুলোও কোন অংশে কম নয়।

শহীদুল ইসলাম বলেন, মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শে অবশিষ্ট চিংড়ির সঙ্গে তিনি মিশ্রভাবে কার্পজাতীয় মাছ চাষ শুরু করেন। মাত্র ছয় মাসের নিবিড় পরিচর্যায় এখন একেকটি পিএল চিংড়ি ১শ’ থেকে দেড়শ’ গ্রাম ওজন হয়েছে। বর্তমানে রাজশাহীর বাজারে ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা কেজি দরে চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে। পাত্রে রাখা চিংড়িচিংড়ির খাবার ও রক্ষণাবেক্ষণ দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে তার ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন এই চিংড়ি বিক্রি করলে প্রায় এক লাখ টাকা লাভ হবে বলে জানান শহীদুল।  

তিনি আরো বলেন, তার চিংড়ি পুকুর দেখতে এখন আশপাশের গ্রাম ও দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসছেন। এতে ভালোই লাগে তার। কখনও বিরক্তি আসেনা। মিঠা পানির চিংড়ি নিয়ে এরই মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সরকার এগিয়ে আসলে তার বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচবে। ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পেলে তার এই স্বপ্নের পালে বাতাস লাগবে। আরও দু’টি পুকুর নিয়ে রাজশাহী জেলায় তিনি চিংড়ি চাষকে বাড়াতে চান বলেও জানান শহীদুল ইসলাম।    

রাজশাহীর পবা উপজেলার সাবেক সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শাহেদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহীর পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষ এখন আর অসম্ভব নয়। এজন্য একটু বিশেষ পরিচর্যা যথেষ্ট। এছাড়া চিংড়ির সঙ্গে কার্পজাতীয় মাছও চাষ করা যায়। এতে খরচ ও সময় দু’টোই বাঁচে। আর লাভও দ্বিগুণ। বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষ হলে এই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘুরবে বলে জানান তিনি।

রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সাহা বাংলানিউজকে জানান, পবার কর্ণহারের শহীদুল অন্য চাষিদের জন্য অনুকরণী। তবে শহীদুল যদি ব্যাংকে ঋণের আবেদন করেন তাহলে তারা শতভাগ সুপারিশ করে তা পাস করিয়ে দেবেন বলেও জানান।

মৎস্য কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সাহা বলেন, আগে রাজশাহীতে চিংড়ি পোনা পাওয়া যেতোনা। এখন পাওয়া যায়। তাদের উদ্যোগে নতুন নতুন হ্যাচারি করা হচ্ছে। তাই নতুন নতুন চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জেলা মৎস্য অধিদফতর উত্তরাঞ্চলে চিংড়ি চাষে বিপ্লব ঘটাতে চায় বলে জানান এই মৎস্য কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৭
এসএস/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।