ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের ‘ত্রাতা’ ওয়াহিদুরের গল্প

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৭
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের ‘ত্রাতা’ ওয়াহিদুরের গল্প প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মো. ওয়াহিদুর রহমান। ছবি: বাংলানিউজ

কুয়ালালামপুর থেকে: ১৯৯১ সালে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার সময় মনস্থির করেন তখনকার উঠতি অর্থনীতির দেশ মালয়েশিয়ায় যাবেন। উদ্দেশ্য ছিলো কিছু অর্থকড়ি উপার্জন করে দেশে ফিরে নিজেকে পরিবার ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা। 

আর সেই বিদেশে পাড়ি জমানো যুবকটির নিখাদ চাওয়া বদলে দিয়েছে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মো. ওয়াহিদুর রহমান অহিদের জীবন। বিদেশ-বিভূঁইয়ে মেধা আর কঠোর শ্রমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনন্য উচ্চতায়।

এখন মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের আদর্শ তিনি।  

কারণ, যেখানে একদিন জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন, সেখানেই আজ বাড়ি-গাড়ি, যশ-খ্যাতি সব হয়েছে তার। তিনি নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও। কাজ করে যাচ্ছেন প্রবাসীদের কল্যাণে।  

সম্প্রতি কুয়ালালামপুরে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে ওয়াহিদুর তুলে ধরলেন প্রবাস জীবনে নিজের সংগ্রামের দিনগুলোর কথা।  

জানালেন, প্রথমে মালয়েশিয়ায় এসে চাকরি দিয়ে শুরু করেন প্রবাস জীবন। তবে প্রথম দিকের দিনগুলো খুব সুখকর ছিলো না। এরপরও নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৯১ সালে বছরখানেক চাকরির পর ব্যবসায় হাত বাড়ান তিনি।

তবে পুরোপরি ব্যবসায় মন দেন ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে। চাকরি ছেড়ে বন্ধুদের পরামর্শে মালয়েশিয়ায় শুরু করেন জনশক্তি আমদানি। ১৯৯৪ সালে জনশক্তি আমদানি বন্ধ করে দেয় মালেশিয়া সরকার। এবার পা বাড়ান অন্য ব্যবসায়। তখন মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ-মরিচসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি আমদানি করে সাফল্য পান তিনি।

ব্যবসায় কঠোর পরিশ্রম বদলে দেয় ওয়াহিদুরের জীবন। হাটিহাটি পা পা করে  শুধু মালয়েশিয়ায় বাঙালি কমিউনিটিতেই নয়, স্থানীয়দের কাছেও এখন অনুকরণীয় তিনি। সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারও তাকে দিয়েছে ‘সিআইপি’ (বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) স্বীকৃতি।
 
ওয়াহিদুর জানালেন, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানি তো আছেই, বাংলাদেশি অনেক নামি-দামি কোম্পানির পণ্যেরও মালয়েশিয়ায় পরিবেশক তার প্রতিষ্ঠান। সেইদিনের তরুণ ওয়াহিদুরের বর্তমান বয়স ৪৫ বছর পেরিয়েছে। তার হাত ধরেই কর্মসংস্থানে ঢুকেছে হাজারও বাংলাদেশি তরুণ।
 
আলাপকালে মালয়েশিয়ায় কাটানো জীবনের ২৬ বসন্তের কথাও উল্লেখ করলেন ওয়াহিদুর। বললেন, যখন এখানে পাড়ি জমাই তখন আমার বয়স ১৯ বছর। বাবা নেই, সংসারে মা ছাড়া আরও তিন ভাই ও তিন বোন।

১৯৯১ সালের শুরুর দিকে এক বড় ভাইয়ের দোকানের সামনে বসে মালয়েশিয়ায় আসার গল্প করছিলেন বন্ধুরা। সেই বন্ধুরাও মালয়েশিয়ায় নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত।  

ওয়াহিদুর বলেন, মালয়েশিয়ায় ব্যবসার পরিবেশ বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। তবু দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ রয়েছে। এমনকি বড় ধরনের বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে কাজও করছি।
 
মালয়েশিয়ায় বাঙালি কমিউনিটির অবস্থান সুদৃঢ় জানিয়ে তিনি বলেন, এদেশে প্রায় আড়াই সহস্রাধিক রেজিস্টার্ডভুক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করি আমরা।  

দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়ে এই প্রবাসী বলেন, আগে ব্যাংক মারফত টাকা পাঠালে ৩০ রিংগিত কেটে রাখা হতো। পিন নম্বরে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়াসহ কিছু উদ্যোগ নেন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। ফলে হুন্ডি মারফত টাকা পাঠানো কমে আসে। এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয়, এই জায়গাটিতে কাজ করলে বাংলাদেশ সরকার আরও লাভবান হবে।

‘কেননা প্রবাসীরাও বোঝেন, হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর ক্ষতির বিষয়টি। অনেক সময় খোয়া যায়। বিকাশে টাকা দিলে সরকার রেমিট্যান্স হারায়। ’
 
নিজের এ অবস্থানে আসার পেছনে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করে ওয়াহিদুর বলেন, ‘ভাগ্য বদল করতে এখানে এসে যা করতে চেয়েছি, তার চেয়েও বেশি পেয়েছি। এখানে ব্যবসার সুযোগ আছে। শুধু সঠিক পথে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। ’
 
বাংলাদেশে চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া উপযোগী দেশ বলেও মনে করেন এই প্রবাসী ব্যবসায়ী।  

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবৈধ অভিবাসীদের জন্য দেশের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়। তাই যারা অবৈধ তাদের উচিত বৈধতা নেওয়া।  নয়তো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অভিযানে কেউ পাকড়াও হলে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। যদিও সংখ্যার দিক থেকে এটি খুবই কম।

স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে স্থায়ীভাবেই মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন ওয়াহিদুর। তিনি জানান, নিজের হাতে গড়া ব্যবসা-বাণিজ্য, সবই তার এখানে। এ দেশের সরকারও স্থায়ীভাবে আবাসন করার অনুমতি দিয়েছে।  

প্রবাসীদের কাছে ওয়াহিদুর রহমান পরিচিত ‘বিপদাপদের ত্রাতা’ হিসেবে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কেউ মারা গেলে তার মরদেহ স্বদেশে পাঠানো, কিংবা কেউ কোনো বিপদে পড়লে তাকে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধারে আন্তরিক তৎপরতার জন্যই এই পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। ওয়াহিদুর রহমান প্রশংসিত তার দেশের এলাকায় নানা জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যও।

সবশেষে জানালেন বাংলাদেশে থাকা মা ও চার ভাই এবং তিন বোনের কথাও। বললেন, ভাইয়েরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড় ভাই প্রকৌশলী, ছোট ভাই ব্যবসায়ী এবং আরেক ভাই আছেন শিক্ষকতায়।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৭
এনইউ/এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।