ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

স্পেন

থাইল্যান্ড থেকে জেসমিন পাপড়ি

রাজার জন্য যতো ভালোবাসা!

জেসমিন পাপড়ি, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৫
রাজার জন্য যতো ভালোবাসা! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Jasmin_papri_1ব্যাংকক থেকে: থাইল্যান্ডের পথে চলতে ফিরতে চোখে পড়বে সম্ভ্রান্ত চেহারার এক মানুষকে। কিছুদূর এগুতেই আবার তিনি।

তারপর আবার; আবার। ব্যাংককের বিভিন্ন সড়ক, হাসপাতাল, হোটেল, শপিংমল, অফিস, মন্দির, স্কুল, বাড়িসহ প্রায় সব জায়গায়ই তাঁর ছবি। সোনালী রঙের ফ্রেমে বাঁধানো তেজস্বী চেহারার এই মানুষটি থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল আদুলইয়াদেজ, যিনি ‘কিং রামা নাইন’ নামেও পরিচিত।

থাইল্যান্ডের প্রতিটি মানুষের অন্তরে রাজা ভূমিবল। প্রায় ৭ দশক ধরে দেশটির রাজা তিনি৷ সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাজ সিংহাসনের অধিকারী থাকার রেকর্ডটিও তার৷

গত শনিবার (৫ ডিসেম্বর) ছিল রাজা ভূমিবলের ৮৮তম জন্মদিন। থাইবাসীর কাছে দেবতার মতো এই মানুষটির জন্মদিন পালনে সাজ সাজ রব ছিল দেশজুড়ে। জন্মদিন উপলক্ষে প্রায় প্রতিটি থাই নাগরিক হলুদ রঙের পোশাক পরেছিলেন।

বাড়িতে বাড়িতে থাইল্যান্ডের জাতীয় পতাকার পাশে স্থান করে নেয় রাজ পরিবারের হলুদ পতাকা। রাজার জন্মদিনের উৎসব উদযাপনে কোনো কার্পণ্য ছিল না থাই নাগরিকদের মধ্যে।

১৯৮০ সাল থেকে থাই রাজার জন্মদিনকে বাবা দিবস হিসেবেও পালন করে আসছে দেশটির জনগণ। কারণ হিসেবে স্থানীয়রা জানান, ১৯৫০ সালে রাজা হওয়ার পর থেকেই এদেশের প্রায় প্রত্যেকটি প্রদেশ, শহর, গ্রাম পরিদর্শন করে সাধারণ জনগণের দুঃখ-দুর্দশা শুনে তা সমাধানের চেষ্টা করতেন তিনি। গরীবদের প্রতি তার ভালবাসার নানা গল্প থাই নাগরিকদের মুখে মুখে।

থাই রাজ পরিবারের নিদর্শন গ্রান্ড প্যালেস ঘুরে দেখার সময় স্থানীয় গাইড প্রায়ূত মিসুক জানান, ১৯২৭ সালের ৫ ডিসেম্বর আমেরিকার ক্যামব্রিজের মাইন্ট উবারন হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান থাই রাজা ভূমিবল। জন্মগ্রহণের সময় তাঁর বাবা যুবব্রাজ মাহিদল হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করছিলেন। ১৯৩৩ সালে রাজা ভূমিবলের মা সাঙ্গোয়ান পরিবারসহ চলে যান সুইজারল্যান্ডে। সেখানেই শুরু হয় তার শিক্ষা জীবন। সুইজারল্যান্ডে একটি হাইস্কুলে ডিপ্লোমা শেষ করার পর ভূমিবল ১৯৪৫ সালে বিজ্ঞান বিষয়ে লাউসানি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সপরিবারে দেশে ফিরে আসেন তিনি।

ভূমিবলের বড় ভাই আনান্দা মাহিদল ল্যান্ড ১৯৪৬ সালে ৯ জুন রহস্যজনকভাবে খুন হন। সে সময় ভূমিবলকে রাজা করার প্রস্তাব এলেও মায়ের আপত্তিতে আবারও সুইজারল্যান্ডে ফিরে গিয়ে আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন তিনি। সেখান থেকে প্যারিসে বেড়াতে গিয়ে সেই সময় ফ্রান্সে নিযুক্ত থাই রাষ্ট্রদূতের মেয়ে রাজয়াওংসি সিরিকিত কিটি ইয়াকারার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। এরপর প্রণয়। ১৯৫০ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এর মাত্র এক সপ্তাহ পর ১৯৫০ সালের ৫ মে থাইল্যান্ডের রাজা হিসেবে শপথ নেন ভূমিবল।

রাজার জন্মদিনের কয়েক সপ্তাহ আগ থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় থাইল্যান্ডে। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। দিনটিতে দেশ জুড়ে ছুটি থাকে। তবে এ বছর ৫ ডিসেম্বর ছিল শনিবার। শনি ও রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় রাজার জন্মদিন উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা করা হয় সোমবার। যে কারণে টানা তিন দিন ছুটি ছিল দেশটিতে। আর উৎসবও চলেছে কয়েকদিন ধরেই।

এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সব দালান, অফিস, স্কুল, বাড়ি, হোটেল, শপিংমল রাজার প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো হয়। এভাবেই থাই জনগণ রাজার প্রতি তাদের আনুগত্য ও সম্মান প্রদর্শন করেন। থাই রীতি অনুযায়ী, সোমবারের রঙ হলুদ। রাজা ভূমিবল সোমবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই এদিন সবাই হলুদ রংয়ের পোশাক পরিধান করেন।

একইভাবে থাই রীতিতে রোববারের রং লাল, মঙ্গলবারের গোলাপি, বুধবারের সবুজ, বৃহস্পতিবারের কমলা, শুক্রবারের নীল ও শনিবারের রং বেগুনি। রাজ পরিবারের সদস্যদের জন্মদিন অনুসারে, দিন হিসাব করে, তার সঙ্গে মিলিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের পোশাক পরে তাদের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণ।
 
রাজা ভূমিবলের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে রাজধানী ব্যাংকক, রাচাদামান্যেন এভিনিউ, সানাম্লুয়াং, গ্র্যান্ড প্যালেসের চারপাশে ঝলমলে লাইট দিয়ে সাজানো ও আতশবাজি প্রদর্শন করাই রীতি। কিন্তু গত বছরের মতো এবারও শারীরিক অসুস্থতার কারণে জনসম্মুখে আসেননি রাজা। ছিল না আতশবাজির আয়োজনও। তবে তিনি যে হাসপাতালে আছেন তার আশেপাশে জড়ো হয়ে রাজার জন্য প্রার্থনায় অংশ নেয় থাই জনগণ। কেউ কেউ ছুটে গেছেন রাজপ্রাসাদের আশেপাশেও। তবে যে যেখানেই থাকুক না কেন থাই জনগণ রাজার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তার দীর্ঘায়ু কামনায় প্রার্থনার কোনো ত্রুটি রাখে না।

রাজ পরিবার থাই জনগণের কাছে অসীম শ্রদ্ধার। এর কারণ সম্পর্কে গাইড প্রায়ূত মিসুক জানান, রাজ পরিবারের স্বাধীনচেতা মনোভাব আর দৃঢ়তার কারণে এশিয়ার এই দেশটিকে বৃটিশরা কখনও উপনিবেশ গড়তে পারেনি।

রাজাকে ভালবাসার প্রকাশ শুধু অনুষ্ঠানে নয়, থাইদের আচরণেও প্রকাশ পায়। সিনসিয়া নামে একজন দোকানি রাজার অসুস্থতার কথা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেললেন। এমনকি ভূমিবলের পর রাজা কে হবেন- এমন আলোচনাও যেন সেখানে ‘পাপ’, বললেন তিনি।  

রাজার জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি এদিন থাইরা বাবা, দাদা এবং নানাদের সম্মান জানায়। এদিন থাই ঐতিহ্য অনুযায়ী, ছেলেমেয়েরা বাবাদের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে তাদের ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এ সময় বাবাকে তারা হলুদ রংয়ের ক্যানা ফুল উপহার দেয়। বাবারাও তাদের সন্তানদের জন্য মঙ্গল কামনা করেন।

** থাইল্যান্ডে বাংলাদেশিদের ‘শক্তি’
** রেন্টে বাইক!
** গাড়ির হর্নবিহীন শহর
** সময়ানুবর্তী রিজেন্ট এয়ার
** কলম দেখলেই এগিয়ে আসেন তারা!

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৫
জেপি/আরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।