ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

স্পেন

পাতায়ার ‘ডন’

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৫
পাতায়ার ‘ডন’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পাতায়া (থাইল্যান্ড) থেকে: এসেছিলেন শূন্য হাতে। প্রথমে বেতন বলতেই পাননি কোনো অর্থ।

বছরখানেক ছিলেন পেটেভাতে।

এক সময়ের অচেনা শহর থাইল্যান্ডের পাতায়ায় নিজের হয়েছে একে একে ৭২টি দোকান ও চারটি রেস্টুরেন্ট।

এমন এক সময় গেছে, যখন গাড়িতে উঠতেও যার হিসাব করা লাগতো, এখন তিনি নিজেই চালান দামি ব্র্যান্ডের মার্সিডিজ কার। তার অধীনে কাজ করছেন বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার ও থ্যাইল্যান্ডের দুই শতাধিকের বেশি নাগরিক।

তবে চালচলন ও বেশভূষাও নিতান্তই স্বাভাবিক। গাড়ি, বাড়ি ফ্ল্যাট, বাংলোবাড়িসহ এই সৈকত নগরী পাতায়ায় গড়ে তুলেছেন আরেক সাম্রাজ্য।

রূপকথার মতো শোনালেও এর সবই বাস্তব। পরিশ্রম করে শূন্য থেকে শত-সহস্রের শীর্ষে অবস্থান করছেন। অনেকের কাছেই তিনি এখন জলজ্যান্ত একটি উদাহরণ। অনেকের কাছে আবার আদর্শ। এই মানুষটার নাম মাহবুব আলম তালুকদার। থ্যাইল্যান্ডে তার পরিচিতি প্রিয় ‘ডনভাই’ হিসেবে।

আলো ঝলমলে সৈকত নগরী পাতায়ায় যে কোনো বাংলাদেশির কাছেই শ্রদ্ধেয় এই ডনভাই। কীভাবে রূপকথা পরিণত হলো বাস্তবে, কোন যাদুমন্ত্রে শূন্যহাতে এসে আজ এই সাম্রাজ্যের শীর্ষে!

DON_2এর উত্তর জানতে খুঁজে বের করা হলো মাহবুব আলম তালুকদারকে।

বাংলানিউজের পরিচয় পেয়ে বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে প্রথমেই বিনম্র উচ্চারণ, ‘এ আর এমন কী! পরিশ্রম করেছি। এখনো করছি। নিজের আত্মীয়-স্বজনকে প্রতিষ্ঠা করেছি। দেশের বহু মানুষের ভাগ্যের চাকা খুলে দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরেছি। এই তো!

তিনি বলেন, একে আপনারা যদি বলেন সাফল্য, তবে তা সাফল্যই। আমি মনে করি, নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর লক্ষ্য স্থির করে পরিশ্রম করলে কোনো কিছুই বিফলে যায় না। ’

পাতায়ায় বিচ রোডে পাঁচ তারকা চেইন ডুসিথানি হোটেলেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ডুসিট টেইলার্স’। ভিনদেশি অতিথিরা আসছেন আর ডনের কারিগরদের নিপুণ হাতে তৈরি সার্ট, প্যান্ট, স্যুট গায়ে জড়িয়ে ফিরছেন নিজ দেশে।

মাহবুব আলম তালুদারের জন্ম বরিশালের পুরানপাড়ায়। বাবা আমান উল্লাহ তালুকদার ছিলেন বাংলাদেশ বিমানের সেলস অ্যান্ড পারচেজ বিভাগের সিনিয়র অফিসার। সেই সুবাদে বেড়ে ওঠা রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বিজলী মহল্লায়।

১৯৮০ সাল। ডন অচেনা পাতায়া নগরীতে পা রেখে কাজ নিলেন ‘জাহেদ ভাই’ নামে এক পাঞ্জাবির দর্জির দোকানে। বেতন বলতে কী জিনিস, তা চোখে দেখেননি প্রথমে। বছর দেড়েক ছিলেন পেটেভাতে। অর্থাৎ কাজের বিনিময়ে খাদ্য। তারমানে তিন বেলা খাওয়া ও থাকার সুবিধা।

সেই থেকে স্বপ্নগুলোকে ছড়িয়ে দেন ডানা মেলে। আট বছর বাদে ১৯৮৮ সালে নিজেই ক্ষুদ্র উদ্যোগে পাতায়ার বর্তমান রয়েল গার্ডেন প্লাজার কাছে শুরু করেন দর্জির দোকান। ‘ডন ফ্যাশন’ নামের সেই টেইলার্সে নামিদামি ব্র্যান্ডের কাপড়ে তৈরি নিত্য নতুন ডিজাইনের কাপড়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিলেন ভিনদেশি পর্যটকদের মধ্যে। গড়ে তুললেন তালুকদার গ্রুপ; যার অধীনে একে একে এই শহরেই তার টেইলার্সের দোকানের সংখ্যা দাঁড়ালো ৭২টিতে।

বহু বাংলাদেশিকে থাইল্যান্ডে এনে কাজ দিলেন নিজের দোকানে। শুরু হলো ভিন দেশে নতুন এক বাংলাদেশের যাত্রা। একইভাবে বাংলাদেশিদের রসনা বিলাস পূরণে একে একে প্রতিষ্ঠা করেন চারটি রেস্টুরেন্ট।

এই শহরে টেইলারিং ব্যবসায় প্রথম আর রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় দ্বিতীয় কোনো বাংলাদেশি হিসেবে রেকর্ড গড়েন তিনি।

বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের সব কাপড়ই মিলবে ডনের টেইলারিং শপে। সেখানে বাংলাদেশি কারিগরদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় পূর্ণতা পায় এই দর্জিবাড়ির শিল্প। অসাধারণ বুনন আর শেলাইয়ের টানেই ভিনদেশিদের অনেকেই ছুটে আসেন এখানে।

ডনের সাফল্যের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, থাই ভাষাসহ ভালো ইংরেজি রপ্ত করতে পারা। ইউরোপ কিংবা আমেরিকার পর্যটকদের একটি বড় অংশের হ্যান্ডমেইড কাপড়ের ঠিকানা ডনের টেইলার্স।
DON_1
ডন বাংলানিউজকে জানান, তার দোকানে মাত্র একশ থেকে তিনশ ডলারে মিলবে দামি কাপড়ে হালফ্যাশনের নানান স্যুট। উন্নতমানের কাপড় আর সস্তা শ্রমের কারণে ইউরোপ, আমেরিকার চাইতে সাশ্রয়ী হওয়ায় পর্যটকদের বাড়তি আগ্রহ থাকে নতুন পোশাকে। আবার দিনে অর্ডার দিয়ে দিনেই স্যুট পাওয়ার বিষয়টি পর্যটকদের মাঝে আলাদা আগ্রহ তৈরি করে বলে জানালেন ডন।

এদিকে, ডনের হাতধরে এই পাতায়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনেকেই। কে ডনকে কৃতজ্ঞচিত্তে মনে রাখলো, কী রাখলো না, সেদিকে কোনো নজর নেই তার।

তিনি বলেন, সবাই প্রতিষ্ঠিত হোক, এটাই তো চেয়েছিলাম। আর এভাবেই একদিন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে বিশ্বে। মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আমার দেশ। মানুষ বিনম্রভাবে শ্রদ্ধা জানাবে আমাদের মেধা আর পরিশ্রমকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৫
এবি

** বাংলার আলোয় আলোকিত পাতায়া

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।