ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্পেন

‘আমিও হাঁপাচ্ছি’

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৫
‘আমিও হাঁপাচ্ছি’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সুবর্ণভূমি আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর (ব্যাংকক ) থেকে: প্রচণ্ড গরম। যাত্রীরা প্রায় সবাই ঘামছেন দরদর করে।

একটু স্থুলাকৃতির যারা, তারা নেয়ে ঘেমে একাকার! অন্যদের কেউ খবরের কাগজকে পাখা বানিয়ে বাতাস করছেন। কেউ বা তাও না পেয়ে হাত চালিয়েছেন।

এর মধ্যে একটি শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ায় দ্রুত কেবিন ক্রু ছুটলেন। দ্রুত অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে তাকে কোনো মতে সামাল দেওয়া গেলো। কিন্তু ততক্ষণে গরমে হাসফাঁস অবস্থা যাত্রীদের।

অসহ্য গরমে কেউ পিণ্ডি চটকালেন বিমান কর্তৃপক্ষের। কেউ বা পণ করলেন, আর না। এরপর অন্য উড়ানে! যাত্রীদের প্রশ্নবানের নিশানা তখন পার্সার ইসমত আরা আদিবার দিকে।

BG0088সহাস্যে তিনিও শান্ত করতে যাত্রীদের বললেন,‘আমিও হাঁপাচ্ছি’! এই চিত্র বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট বিজি ০০৮৮ এর। বোয়িং ৭৩৭।

ঢাকার হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর থেকে গন্তব্য ব্যাংককের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ফ্লাইট ছাড়ার কথা সকাল পৌনে নয়টায়, কিন্তু বিলম্ব হচ্ছে।

বিমানে শুরু থেকে সর্বশেষ যাত্রীর আহরণ, তারপর উড্ডয়ন পর্যন্ত প্রায় আধাঘণ্টা সময় বিলম্বে অসহ্য গরমে ত্রাহি অবস্থা যাত্রীদের।

তারপর শুরু অবর্ণনীয় এক ভিন্ন ভোগান্তির। তা কেবলই যেন অনুভব আর অবলোকনের। বাইরের কাউকে বলার মতোও না।

থাইল্যান্ডের ব্যাংককে পৌঁছানোর আগে টয়লেটগামী যাত্রীদের সেই দুর্বিসহ ভোগান্তি আর দীর্ঘসময় মূত্রথলির চাপ তাদের মনে করিয়ে দিয়েছে বিমানের সেরা সেবার কথাই।

কীভাবে? সেই কথায় পরে আসছি। তার আগে যাত্রাপথের শাস্তির কথা! শাস্তি! অবাক হবারই কথা। গোটা ভ্রমণ জুড়েই হাটুগেড়ে বসে থাকা। তারমধ্যেই খাবার-দাবার। আর খাবারের ট্রলির ধাক্কা, খাবার শেষে পার্সারদের ‘সরি’ শোনা!

পড়া তৈরি না করে ক্লাসে গিয়ে শিক্ষক যেমন হাটুগেড়ে বসিয়ে রাখতেন। বিমানের ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীদের স্কুল জীবনের সেই শাস্তির কথাই মনে করিয়ে দিলো ফ্লাইট বিজি ০০৮৮।

ঢাকায় যেমন অধিক লাভের আশায় ৪০ সিটের বাসের অনুমোদন নিয়ে বাস মালিকদের অনেকে ৫২ সিট জুড়ে দেন। এখানকার চাপাচাপি করে বসা মনে করিয়ে দেয় বাসভ্রমণের সেই দগদগে স্মৃতিও।

উড়োজাহাজের মধ্যভাগ থেকে ‘গ্যালি এরিয়া’ (পেছনের অংশ) পর্যন্ত গায়ে ঘেঁষে ঘেঁষে আসন। কেবিন পার্সাররা সবচাইতে যে শব্দটি বেশি উচ্চারণ করেছেন সেটি ছিলো ‘সরি’।

আর তারপর বেশি প্রয়োগ করা শব্দটি ছিল-‘বুঝতে পারছি আপনাদের কষ্ট! ক‍ী করবো বলুন। আমরা তো কর্মচারী। এমন চাপাচাপি করে বসে যাওয়া খুবই কষ্টকর। সরি যদি অন্য সিট খালি থাকতো তাহলে সেখানে আপনাকে বসাতাম। ’

এবার ফিরি আগের যন্ত্রণার কথায়। যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির বোয়িং ৭৩৭। ককপিটের পর বিজনেস ক্লাসের ছয়টি সারিতে দু’টি করে ১২টি আসন। BG0088

তার পেছনে দুই সারিতে তিনটি করে এক লাইনের ছয়টি আসন। মাঝে সরু পথ। যাকে বলা হয় সিঙ্গেল আইল। ক্ষেতের আইল বললেও ভুল হবে না! একদম সঠিক উদাহরণ।

সেই ‘আইল’ দিয়ে সচারচার অন্যজনের আসা-যাওয়ার প্রয়োজন হলে ট্রেন লাইনের মতোই সিগন্যাল লাগবে। একজনকে যেতে দিতে হলে অন্যজনকে ঢুকে যেতে হবে সিটে। আর সিট ফাঁকা না থাকলে আগে পেছনে গিয়ে অন্যজনকে পথ করে দিতে হবে।

সেই ‘আইল’ ধরে সার্ভিস কার্ডে করে (খাবার ট্রলি) পার্সাররা যখন খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত তখনই তাদের দুই পাশে দীর্ঘ লাইন। একজন অন্যের ঘারে চোখ মেলে উকিঁ দিচ্ছেন সামনে। সবার গন্তব্য তখন পেছনে। টয়লেটে!

এক পর্যায়ে জ্বলে উঠলো সিট বেল্টের বাতি। ঘোষণা এলো- ক্যাপ্টেন প্রতিকূল আবহাওয়ার মুখে, যাত্রীরা যে যার আসনে গিয়ে বসুন। ততক্ষণে রাজধানীর যানজট উঠে এসেছে ফ্লাইট ০০৮৮ এ!

ঈদের আগে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ট্রাক বিকল হয়ে গেলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় সে অবস্থা যেন উড়ন্ত  প্লেনে। সেই বিকল ট্রাকের ভূমিকায় পার্সারসহ সার্ভিস কার্ড আর আটকে পড়া যানবাহনের ভূমিকায় টয়লেটগামী যাত্রীরা।

পার্সাররা বলেন,‘আমরা ক‍ী করবো বলুন! বোয়িং ৭৩৭ এ ওয়ান আইল। সিটগুলো চাপাচাপি থাকায় গোটা যাত্রাপথেই আঁটসাঁট করে বসে থাকতে হয় যাত্রীদের। অভ্যন্তরীণ রুটে স্বল্প পাল্লার দূরত্বে ঠিক আছে। ’

‘কোনোভাবেই আন্তজাতিক রুটে এ প্লেন মানায় না। সে তুলনায় এটা দিয়ে ব্যাংকক তো কাছে! তার চাইতে দূরে মাস্কট ও আবুধাবিতেও ফ্লাইট চলছে এই বোয়িং ৭৩৭ দিয়ে। আর যাত্রীদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় আমাদের,’-জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পার্সার।

ব্যাংককে ঘুরতে যাওয়া উত্তরার ব্যবসায়ী ইকরামের চোখে মুখে ক্ষোভের রেশ।

কেবিন পার্সার ইসমত আরা আদিবাকে লক্ষ্য করে কটাক্ষ করে বললেন, ‘এটা তো দেখছি প্লেন না। আমাদের সড়কে চলা তুরাগ পরিবহন। ’

কটাক্ষ এড়িয়ে ক্ষুব্ধ যাত্রীর দিকে সহাস্যে জুসের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে ইসমত আরা আদিবার জবাব,‘স্যার অরেঞ্জ না অ্যাপেল জুস! কোনটি দেবো!

ইমতিয়াজ নামের মধ্যম সারির একজন যাত্রী বাংলানিউজকে বলেন,‘পাশের আসনের সহযাত্রী টয়লেটের পথে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। খাবারের উচ্ছিষ্ট থালাবাটি বাধ্য হয়েই সহযাত্রীর আসনে রাখতে হয়েছে।

‘আমি একা না অন্যরাও সেই আসনকে গারবেজ পয়েন্ট বানিয়েছে। জানি এটা ঠিক না। অন্যায়। তা সত্ত্বেও উপায় ছিলো না। ফুড টেবিলের যাতা (ধাক্কা) খেয়ে আমার বুকের হাড্ডি নড়ে গেছে। ’

নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা সুশীলন নামের বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা বকুল উজ্জ জামান বাংলানিউজকে বলেন, দেশের পতাকাবাহী উড়োজাহাজে এ ভোগান্তি কী দেখার কেউ নেই।

জানালেন, ২৬ মিনিট রো’তে দাঁড়িয়ে থেকে টয়লেটের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছেন। এতো সরু পথ আসলে ভোগান্তির মাত্রা বাড়িয়েছে।

তিনি বলেন, দুই সারিতে তিনটি ও দু‘টি করে ৫টি আসন হলে এই দুর্ভোগ হতো না।

‘এই ভোগান্তি আপনারা দেখলেন। তা কেবল দেখার জন্যেই। আমরা যে কারো সঙ্গে শেয়ার করবো তাও সম্ভব না,’ বলছিলেন সাদিয়া জাহান নামে আরেক যাত্রী।

ভোগান্তির অবসান হলো যখন ফ্লাইট বিজি ০০৮৮ ব্যাংককের সুবর্ণভূমি আন্তজার্তিক বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে।

কটপিট থেকে বেরিয়ে আসা ক্যাপ্টেন তাসমিন দোজা বাংলানিউজকে বলেন, কোন সিটই কাষ্টমাইজ করা হয়নি। বোয়িং যেভাবে সিট বানিয়েছে সেভাবেই আছে।

এ ধরনের প্লেন দিয়ে অন্যান্য সংস্থাও দেশ-বিদেশে ফ্লাইট চালাচ্ছে বলে জানান তিনি।

কিন্তু যাত্রীদের দুর্ভোগ? উত্তর মেলেনি কারো কাছেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ০৯, ২০১৫
এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।