ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মালয়েশিয়া

সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ী কাদের

দেশি পণ্যের প্রয়োজন বহুজাতিক বিপণন

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪
দেশি পণ্যের প্রয়োজন বহুজাতিক বিপণন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুয়ালালামপুর থেকে: ১৯৯৫ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে সফলভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন আব্দুল কাদের। কাদের কার্গো সার্ভিস সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি।

এছাড়াও বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স সিঙ্গাপুরের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

শিগগিরই মালয়েশিয়াতে কাদের কার্গোর কার্যালয় উদ্বোধন করছেন তিনি। এখন থেকে সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশের সঙ্গে কাদের কার্গো সেবা দেবে মালয়েশিয়াতেও।   এখানকার কার্যালয় উদ্বোধনসহ আনুষাঙ্গিক কাজে সম্প্রতি কুয়ালালামপুর আসেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বুকিত বিনতাংয়ের এক রেস্তোরাঁয় বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন আব্দুল কাদের।

ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশিদের সুবিধা, অসুবিধা, করণীয় নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।

কাদের বলেন, বাংলাদেশের বহু নামকরা পণ্য সিঙ্গাপুরের বাজারে রয়েছে।   তবে বাংলাদেশের জুস, মশলা, বিভিন্ন প্যাকেটজাত পণ্য সিঙ্গাপুরে বিক্রি হচ্ছে শুধু বাংলাদেশিদের কাছে। এর ফলে বিদেশি অর্থ কিন্তু দেশে আসছে না। আমাদের ব্যবসা করতে হবে বহুজাতির কাছে। চায়নিজ, ভারতীয়, ভিনদেশিদের কাছে বিক্রি করতে হবে।

তিনি জানান, সিঙ্গাপুরে বিদেশিরা এখনো আমাদের পণ্য কিনছেন না। বাংলাদেশি ক্রেতার কাছেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এভাবে পণ্যের প্রসার হয় না।

বাংলাদেশি পণ্যের বহুজাতিক বাজার তৈরি না হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের পণ্যের মান এখনো চায়নিজ বা ভারতীয়দের তুলনায় কম। আর এ কারণে ভিনদেশিরা বাংলাদেশি পণ্য একবার ব্যবহারের পর হয়তো দ্বিতীয়বার ব্যবহার করছেন না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশি পণ্যের সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে নিম্নমানের মোড়ক। অনেক সময় মোড়কের কারণে পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের দেশ থেকে আসা পণ্যের ভালো প্যাকিং হয় না।

বাংলাদেশি পণ্যের দুর্বলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের পণ্যের ওজন বা পরিমাণে ঘাটতি দেখা যায় অনেক সময়। দেখা যায়, মোড়কে লেখা আছে ৫০০ গ্রাম। অথচ রয়েছে ৪৫০ গ্রাম। এসব বিষয় বিদেশিদের কাছে অপ্রত্যাশিত। এ ক্ষেত্রে পণ্যের সরবরাহেও রয়েছে সমস্যা।

কাদের বলেন, অনেক সময় পণ্যের সরবরাহ হতে সময় লাগে অনেক বেশি। বাজারে হয়তো নির্দিষ্ট বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়েছে। তবে এ সময় দেখা গেলো, ওই পণ্যের সরবরাহ নেই।   তখন পণ্য বাজার হারায়।

বাংলাদেশি পণ্যের প্রচারণারও সমালোচনা করেন তিনি। বলেন, আমাদের পণ্যের আর্ন্তজাতিক প্রচারণা প্রয়োজন। সিঙ্গাপুরেও দেখা যায়, প্রচারণা আছে তবে তা শুধু বাংলাদেশ কমিউনিটি ভিত্তিক। অথচ ভারতের ও চায়নার পণ্যের বিজ্ঞাপন কিন্তু আর্ন্তজাতিক মিডিয়ার পাশাপাশি আমাদের দেশের মিডিয়াতেও দেখা যায়।

পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশ থেকে কৃষি পণ্য আসার ব্যবস্থা ভালো নয়। দেখা যায়, এমন বস্তায় করে আলু, পটল বা কাকরোল এসেছে, যেটা মানসম্পন্ন নয়। আবার এয়ারপোর্টেই হয়েতো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এসব পণ্য।

তিনি বলেন, সেদিনই বাংলাদেশের ব্যবসা সফল বলতে পারবো, যখন আমাদের পণ্য বহুজাতিক হবে। পণ্য হতে হবে এমন যেন, বিক্রেতা নয়, ক্রেতাই এসে খোঁজ করবে।

কার্গো ব্যবসার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আরো সহযোগিতামূলক আচরণ করার অনুরোধ জানান তিনি।  

বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে পণ্য ডেলিভারি দিলে বা পণ্য আনতে হলে, আমাদের বন্দরগুলোতে সহযোগিতার বদলে হয়রানি করা হয়। এসব কারণে আমাদের দেশের উন্নতি হয় না।

তিনি বলেন, আমি ব্যবসার প্রয়োজনে প্রায়ই ভিয়েতনাম যাই। ১৪ বছর ধরে আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ করে ৭৫ সালে তারা স্বাধীন হয়েছ। অথচ ভিয়েতনাম এখন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। কারণ তারা ব্যবসার ক্ষেত্রে সুন্দর নীতিমালা করেছে, যেটাতে ব্যবসায়ী ও সেবাগ্রহণকারী সুবিধা পাবে।   অথচ আমাদের দেশে কোনো নীতিমালা নেই।  

পরিবারের মধ্যে যে একটু দুর্বল সদস্য, তার প্রতি আমরা আলাদা যত্ন নেই।   তেমনি রাষ্ট্রেরও গরীবদের আগে সহযোগিতা করতে হবে। আর এসব সুবিধা দেওয়া হয় না বলেই বহিঃবিশ্বে আমাদের সন্মান নেই বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকার নবাবগঞ্জের আব্দুল কাদের ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো যান সিঙ্গাপুরে। শিপইয়ার্ডে কাজ করেন বেশ কিছুদিন। এর মধ্যেই ১৯৮৫ সালে দেশে গিয়ে বিয়ে করেন। এরপর ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু হয় ব্যবসা।

মিনিমার্টের পর একে একে রেস্টুরেন্ট, পিঠাঘর, ক্যাটারিং সার্ভিস, লিটল বাংলাদেশ নামের শপ করেন তিনি।

ব্যাবসায় সাফল্য আসতে থাকে। ১৯৯৮ সালে পরিবার নিয়েও চলে আসেন। এখন কাদেরের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনীসহ ৮ জন সদস্য সিঙ্গাপুরের নাগরিক।

ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, সেবামূলক মনোভাব থাকতে হবে। আমার রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশিরা খেতে আসলে অনেক সময় ১০ ডলার বিল হয়ে পড়লে শ্রমিকরা বলেন, ৪ রিঙ্গিত রয়েছে। আমি সেটাই নেই।

সিঙ্গাপুরের নাগরিক হলেও, দেশে ফেরার ইচ্ছে রয়েছে আব্দুল কাদের। বলেন, এখানে থেকে যে আয় করি, সেটাতো দেশের অর্থনীতিতেই ভূমিকা রাখছে।   হয়তো এখনকার বাস্তবতায় সম্ভব হবে না, তবে আমার ইচ্ছে অন্তত লাশটা যেনো দেশে যায়।   সেখানে মা বেঁচে আছেন এখনো, ভাই রয়েছেন, জীবিকার কারণেই শুধু এখানে থাকা।

তিনি বলেন, আমাদের প্রবাসীদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে সরকারকে আরো আন্তরিক হতে হবে। কারণ, চোর গুন্ডারা দেশের অর্থ বিদেশে পাঠায়। আর আমরা বিদেশের অর্থ দেশে পাঠাই। আর দেশেতো দাতব্য খাতেও অর্থ ব্যয় করি আমরা।

প্রবাস থেকে দূরদষ্টি দিয়ে নিজের দেশের অবস্থান ব্যাখা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ফুটবল মাঠে খেলোয়াড় এমনকি রেফারির চেয়েও কিন্তু অনেক সময় দর্শক বেশি বুঝতে পারে।   দর্শক বুঝতে পারে, কে ভাল খেলছে! কে খারাপ খেলছে! রেফারির চোখেও অনেক সময় সব ভুল ধরা পড়ে না।

একইভাবে আমরা দেশের বাইরে যারা থাকি, তারাও আপনাদের চেয়ে কিছুক্ষেত্রে দেশের অবস্থার ভাল পর্যবেক্ষণ করতে পারি।   দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যাই থাকুক, ব্যবসায়ী ও সেবাগ্রহীতারা যে হয়রানির শিকার হচ্ছে, সেটা আমাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এ হয়রানির শিকার সবাইকেই হতে হয়।

কাদের বলেন, মালয়েশিয়ার তুলনায় সিঙ্গাপুরে অবৈধ লোক কম। তবে গত কয়েক বছর ধরে কিছু এজেন্টের মাধ্যমে অবৈধ লোক আসছে বাংলাদেশ থেকে। এটা বন্ধ করে, বৈধ প্রক্রিয়ায় মানুষের সিঙ্গাপুরে কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধি করতে আমাদের সরকারকেই কাজ করতে হবে।

২০১১ সালে বাংলাদেশ বিজনেস চেম্বার অব সিঙ্গাপুরের যাত্রা শুরু হয়। কাদের জানান, সিঙ্গাপুর সরকারের অনুমোদন নিয়ে মাত্র ৩৪ জন সদস্য নিয়ে এ চেম্বার যাত্রা শুরু করে।   এই চেম্বার বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ী গ্রুপ ছাড়াও সিঙ্গাপুরে ব্যবসারত অন্যান্য দেশের গ্রুপগুলোর সঙ্গেও সর্ম্পক রক্ষা করে।

ব্যবসায়িক বিনিময়, সুবিধা প্রদানের জন্যে আলোচনা করে। বর্তমানে ১০০ জন সদস্য রয়েছেন এ চেম্বারে। প্রতি দু বছর অন্তর চেম্বারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে দ্বিতীয়বারের মতো কেউ প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি নির্বাচিত হতে পারবে না।

আব্দুল কাদের জানান, বর্তমানে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি মালিকানায় ১১০টির ওপর মিনি মার্কেট রয়েছে। ৪০টি ক্যাটারিং সার্ভিস রয়েছে। গার্মেন্টস পণ্য বিক্রি হচ্ছে ৩০ টি দোকানে।

বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের কার্গো সার্ভিস সর্ম্পকে তিনি বলেন, আমরা সবসময় গ্রাহকদের বন্ধুসুলভ সেবা দেয়ার চেষ্টা করি। সিঙ্গাপুরেও অনেক শ্রমিক রয়েছে। দেখা যায়, অনেকে নাম লিখতে পারেন না, এসএমএস পড়তে পারেন না।   আমরা তাদের বকা দেই, আবার হয়তো কাছে নিয়ে বোঝাই।

তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের মতো আমাদের দেশে যদি ২৪ ঘণ্টা সব চালু থাকতো, তাহলে আমি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পার্সেল আনা-নেওয়া করতে পারতাম। এখন বাংলাদেশ ও ওই দুই দেশের মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটি তিন দিন।

** মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরের ভিসা পেতে
** স্টুডেন্ট ভিসায় যেন শ্রমিক না আসে

বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।